অলক্ষ্যে লক্ষ্যে পৌঁছার উপলক্ষ

6
896

এম এ বার্ণিক: বনানী কাস্টমস মসজিদ। শরীফ সাহেব এখানে সালাত আদায় করতে এসেছেন। মসজিদে ঢুকেই দেখতে পেলেন এককোণে একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। বয়স দশ-এগার বছর। ছেলেটাকে দেখা মাত্রই বিস্ময়ে বিস্মৃত স্মৃতি জেগে ওঠে তার। প্রায় ছাব্বিশ বছর আগে যে আত্মজ তাকে ছেড়ে জন্মের কিছুকাল পরে চিরবিদায় নেয়, এই যেনো সেই হারাধন দাঁড়িয়ে আছে। ভাবেন, “আমি কি স্বপ্ন দেখছি?” স্তম্ভিত শেষে সম্বিত ফিরে আসে। সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে বার বার পরীক্ষা করছেন। অবিকল যেন তার লোকান্তরিত পুত্রধন। সন্তর্পণে বাচ্চাটার দিকে এগিয়ে যান। তার মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “বাবা, তোমার নাম কি?” কঠিনকন্ঠে উত্তর দিলো, “আরহাব।”

 

সালাত শেষে শরিফ সাহেব বার বার ছেলেটার দিকে তাকালেন। তার পিতৃহৃদয়ের অপত্য¯েœহ বিগলিত হয়ে ওঠে। বাকরুদ্ধ হয়ে যায় তার। ভাবলেন, আজ আর নয়। আরহাবকে ¯েœহশিস করে ¯েœহসিক্ত পরিবেশ থেকে বিদায় নিলেন। পথ চলছেন আর আরহাবের প্রতি ¯েœহাপ্লুত হয়ে ওঠছেন। পিতৃ¯েœহের মর্মবেদনায় বিধুর শরীফ সাহেব বিমূঢ় হয়ে পড়েছেন। তার ছেলে নেই। দুটো মেয়ে আছে। বেদনাক্লিষ্ট মনে ভাবছেন, আরহাব কি তার পিতৃ¯েœহের তরঙ্গাকুল আবেদন অনুধাবন করতে পারবে। মনে হলো, আরহাবের প্রতি তার মায়ামমতা ঘেরা একটা ¯েœহের বন্ধন তৈরি হয়ে গেছে।

প্রায় প্রতিদিন সালাত উপলক্ষে শরীফ সাহেবের সাথে আরহাবের দেখা হয়। শরীফ সাহেব মনে মনে আরহাবকে অনেক আপন করে ফেলেছেন। কিন্তু আরহাবকে বুঝতে দেন না। একসাথে সালাত আদায়, একটু কুশল বিনিময়, তারপর প্রস্থান। ছেলেহারা পিতার কাছে আরহাব কোনো উপলক্ষ নয়, লক্ষ্য। তাই আরহাবকে দেখলেই তার চোখ অশ্রুশিক্ত হয়ে ওঠে। আরহাবের মধ্যেই শরীফ সাহেবের তনয়তপস্যা। কল্পলোকে বিকল্প এক সন্তানের অস্তিত্ব খুঁজে পান তিনি।

আরহাবের পুরো নাম সৈয়দ আরহাব আজম। তার পিতার নাম সৈয়দ ওমর আজম। বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগরে। ঢাকায় লব্ধপ্রতিষ্ঠ ব্যবসায়ী। নিজে ব্যবসায়ী হলেও ছেলেকে সমাজের একজন জ্ঞানী-গুণী মানুষ হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে আগ্রহী। আল-কুরআন ও আল-হাদিসের ভিত্তিতে ইসলাম ধর্মের মর্মবাণী অনুধাবন ও জীবনে বাস্তবায়নে নিজে যেমন উৎসাহী, তেমনি ছেলেকেও সে বিষয়ে উদ্দীপ্ত করাতে সদা সচেষ্ট। তবে এসব ক্ষেত্রে আরহাবের মায়ের ভূমিকা অধিকতর বেশি। কর্মব্যস্ত পিতার অবর্তমানে মায়ের মাতৃছায়ায় আরহাব প্রতিনিয়ত পরিশীলিত ও পরিশুদ্ধভাবে প্রতিপালিত হচ্ছে।

শরীফ সাহেব একদিন আরহাবকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার জীবনের লক্ষ্য কী?” আরহাব উত্তর দিল, “মহানবীর আদর্শে মানুষের মতো মানুষ হওয়া।” আবার জিজ্ঞেস করলেন, “এ প্রেরণা তুমি কোথা হতে অর্জন করলে?” আরহাব উত্তর দিল, “প্রথমে মাতা-পিতা এবং অত:পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে।” বর্তমান সমাজে অধিকাংশ মাতাপিতা কর্মব্যস্তার কারণে সন্তানকে যথাযথভাবে গাইড করে গড়ে তুলতে পারেন না। কোন কোন পারিবারিক পরিসরে সারাদিন মাতাপিতার অবর্তমানে ছেলে-মেয়েরা কাজের লোকের তত্ত্বাধানে বড় হয়। ফলে চালনে-বলনে তারা কাজের লোকদের অনুসরণ করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আদর্শ শিক্ষার্থী গড়ে তোলা শিক্ষা নেই বললেই চলে। শিক্ষার্থী শিক্ষা গ্রহণ করে, বড় হয়, সত্য-মিথ্যার পার্থক্য বোঝে না। তাই আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে না। আরহাবের মাতাপিতা সেদিক থেকে যথেষ্ট সচেতন। কষ্টেসৃষ্টে হলেও আপন সন্তানকে সযতেœ লালিত অভিষ্টে পৌঁছাতে চান।

লেখা-পড়ার সাথে নীতি-নৈতিকতা শেখানো অধিকতর একটি প্রয়োজনীয় বিষয়। এজন্যে দরকার পারিবারিক পরিবেশ ও শিক্ষাঙ্গন থেকে যথাসময়ে যথাযথ হিতোপদেশ ও অনুশাসন। নিজের ছেলে কিংবা শিক্ষার্থীর উচিত তথা ন্যায্য বা যুক্তিসঙ্গত কাজটি করছে কিনা, ন্যায়-বিচার বা ইনসাফের শিক্ষা অর্জন করছে কিনা, তা পর্যবেক্ষণে রাখা। অনধিকার চর্চা, পরস্বাপহরণ ও কর্তৃত্ববহির্ভূত কাজ ছোটবেলায় যারা করে, বড় হলে তারা সামাজিক বিশৃংখলার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই আরহাবের মাতাপিতা নিজ ছেলেকে সঠিক ধারায় পরিচালনার জন্য একটি আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শরাণাপন্ন হয়েছেন।

অন্যের সন্তান কখনো নিজের হয়না। ‘শোলের পোনা, গজারের পোনা- যার যার কাছে তার তার সোনা’। ‘পরের পোলা, দেখতে ভালা- পুত্রহীনের অন্তর জ্বালা’। এ ধরনের রাশি রাশি প্রবাদের প্রচলন থাকা সত্ত্বেও শরীফ সাহেব সাময়িক চোখের নেশা মেটাবার জনা আরহাবকে পিতৃচোখে দেখতে থাকেন। আরহাবের উপস্থিতিতে মায়ার জলে চোখ ছলছল করে ওঠে। আরহাবের অনুপস্থিতিতে কষ্ট-বেদনায় ছন্ন হয়ে পড়েন। যার ছেলে আছে, তার কাছে ব্যাপারটা ছেলেমি মনে হবে। যার ছেলে নেই, তার কাছে ব্যাপারটা কিছু না হলেও অন্তত কিছু বলে বিশ্বাস হবে।

পৃথিবীর জীবন ক্ষণস্থায়ী। ‘কা তব কান্তা’- এ পৃথিবীতে কে কার! ছেলে-মেয়ে সবই মায়ার ছলনা। তারপরও মানুষ সন্তান নিয়ে সুখ পায়। দয়াময় আল্লাহতা’য়ালা চক্ষু শীতলকারী সন্তান-সন্ততির জন্য প্রতিপালকের নিকট প্রার্থনা শিখিয়েছেন (আল-কুরআন, ২৫ সূরা ফোরকান, আয়াত ৭৪)। সন্তান-সন্ততিকে শোভনীয় করা হয়েছে মানুষের জন্য (আল-কুরআন, ৩ সূরা আল ইমরান, আয়াত ১৪)। তাই আরহাবকে দেখে শরীফ সাহেবের মনে হয়, ওমর আজম পরিবারে ওকে পাঠিয়ে পরিবারটিকে শোভনীয় করা হয়েছে। আবার আরহাবের মতো সন্তানের দিকে তাকালে মাতাপিতার চক্ষু শীতল না হয়ে পারে না। কারণ, নেক সন্তান আল্লাহ্র নেয়ামত, দুনিয়ার জীবনের সৌন্দর্য (আল-কুরআন, ১৮ সূরা আল কাহ্ফ, আয়াত ৪৬)।

সহীহ্ হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী, নেক সন্তান মানব জীবনের ছদকায়ে জারিয়ারূপে গণ্য হয়। নেক সন্তানের ভালো আমল থেকে মৃতব্যক্তি উপকৃত হয়। তাই মানুষের লক্ষ্য পৌঁছার জন্য অনেক উপলক্ষের প্রয়োজন হয়। বেহেশ্তে যাওয়ার মতো লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য কারো কারো নেক সন্তান উপলক্ষ হতে পারে। কিন্তু উপলক্ষ কখনো লক্ষ্য হয় না। আরহাব কিংবা সকল সন্তানেরাই একেকটি উপলক্ষ মাত্র।

পরকালের শান্তি অন্বেষায় এসব উপলক্ষ যতই গৌণ হোক না কেন, সময়ে মাপকাঠিতে কখনো তা ফেলনা নয়। সন্তানের প্রতি মাতা-পিতার কর্তব্য একটা পর্যায়ে চূড়ান্ত হয়ে যায়, কিন্তু মাতা-পিতার প্রতি সন্তানের কর্তব্যের সীমা-পরিসীমা নেই। আরহাব যখন বড় হবে, লেখাপড়া শিখে কর্মক্ষম হবে, নিজের অবস্থানে দাড়িয়ে যাবে, তখন মাতাপিতার প্রতি তার দায়িত্ব ও কর্তব্য ক্রমাগতভাবে বাড়তে থাকবে। সন্তান যখন পিতা হয়, পিতা তখন বৃদ্ধবয়সী এক শিশুতে পরিণত হতে থাকে। সন্তান তখন উপলক্ষ হয়ে পিতার পাশে দাড়ানো অনিবার্য হয়ে পড়ে। কোন পিতার এমনটা লক্ষ্য না থাকলেও উপলক্ষই তখন সাক্ষ্য বহন করে। এটাই হলো জীবনের সাক্ষ্য। জীবনকে বিলিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে কতটা হিম্মত রয়েছে, সেই সাক্ষ্যই সন্তানের প্রমাণ করার সুযোগ থাকে এখানে।

পুত্রহীন এক পিতার কাছে বৃদ্ধ বয়সের ভার বহনের কোন উপলক্ষ নেই। শুধু ফ্যালফ্যালিয়ে অন্যের সন্তানের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আত্মতৃপ্তি লাভের কোন সুযোগ নেই। হারানো সন্তানের চেহারার সাথে কারো চেহারার মিল থাকতে পারে, সেটাকে উপলক্ষক ভেবে উপলক্ষ বানানো যায়, কিন্তু নিজ সন্তানের লক্ষ্যে পৌছা যায় না। শরীফ সাহেব অলক্ষ্যে পুত্রস্নেহে বিমোহিত হয়ে লক্ষ্যে পৌছার জন্য আরহাবকে উপলক্ষ ভাবলেও, তার বাস্তবতা নেই। কারণ, উপলক্ষ কখনো লক্ষ্য হয় না।

মনে হয়, শরীফ সাহেব অলক্ষ্যেই লক্ষ্যে পৌছার জন্য আরহাবকে উপলক্ষ ভাবেন। আরহাবের কচিমনে এমব ভাবনার কোন প্রভাব পড়ে না। প্রতিবেশী এক পুত্রহীন আঙ্কেলের ব্যথা বোঝার বয়স কিংবা সময় কোনটাই তার হয়নি। এ নিয়ে শরীফ সাহেবের মাথাব্যথা থাকলেও আরহাবকে তা স্পর্শ করে না। কারো চোখে পানি দেখলে আরেক জন অশ্রুসিক্ত হওয়া মানবধর্ম, ব্যথায় ব্যথিত হওয়া আর মর্মজ্বালা উপলব্ধি করে সন্তানের কাতারে শামিল হওয়া একরকম কাজ নয়।

আরহাবের পিতা আছে, মাতা আছে, আপন আত্মীয়তার সবগুলো অনুষঙ্গ বিদ্যমান। কোন এক অচেনা লোক হঠাৎ করেই তার আপনজনের জায়গা দখল করতে পারে না। পরিচয় সূত্রে কল্পকাহিনী শুনে আফসোস করা যায়, কিন্তু জায়গা দখল করা যায় না। যার যার স্থান তার তার জন্য জন্মসূত্রেই বরাদ্দ হয়ে আছে। জায়েদকে পুত্রস্নেহে লালন করেও হযরত মুহম্মদ (স.) আল্লাহর নির্দেশে পিতৃস্থানে সমাসীন হতে পারেননি। এটাই আল্লাহর নিয়ম, বিশ্বমন্ডল আল্লাহর নিয়মেই চলে। সুতরাং আরহাবকে যতটাই পুত্রতুল্য ভাবা হোক না কেন, শরীফ সাহেবের অবস্থান পিতা-তনয় হওয়ার সুযোগ নেই। বস্তুত স্নেহে মোহে মানুষেরা কোনটা লক্ষ্য আর কোনটা উপলক্ষ তা উপলব্ধি করতে পারে না।

[লেখক: এম এ বার্ণিক, সভাপতি, ইতিহাস গবেষণা সংসদ]

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

15 − 5 =