টিআই’র প্রতিবেদনে ‘দুর্নীতিতে ১৩তম বাংলাদেশ’

0
777

অবি ডেস্কঃ সরকারের পক্ষ থেকে দুর্নীতির বিষয়টি অস্বীকার করা হলেও দুর্নীতিতে বাংলাদেশ ১৩তম স্থান অধিকার করেছে টিআই‘র রিপোর্টে।
* ব্যাংক কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা জরুরি,
* মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও বিচার বিভাগকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখতে হবে,
* দুদকের স্বাধীনতায় ঘাটতি রয়েছে ,
* গণমাধ্যম ও সুশীলসমাজের কথা বলার সুযোগ সংকুচিত,

 

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতি সূচকে বিশ্বে চার ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। ১৮০টি দেশের মধ্যে ২০১৮ সালে অধঃক্রম অনুযায়ী (খারাপ থেকে ভালো) বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম, যা আগের বছর ছিল ১৭তম। অর্থাৎ বাংলাদেশে দুর্নীতি বেড়েছে। আবার সূচকের ঊর্ধ্বক্রম অনুযায়ী (ভালো থেকে খারাপ) বাংলাদেশের অবস্থান ৬ ধাপ পিছিয়ে ১৪৩ থেকে ১৪৯তম অবস্থানে চলে এসেছে।

অন্যদিকে দুর্নীতির পরিস্থিতি উন্নয়ন সংক্রান্ত স্কোরে ১০০ নম্বরের মধ্যে এবার বাংলাদেশ পেয়েছে ২৬। আগের বছর ছিল ২৮। এর মানে টিআই’র তিন সূচকেই বাংলাদেশে দুর্নীতি বেড়েছে।

বাংলাদেশের এই অবস্থান এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চতুর্থ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয়। এছাড়া বিশ্বে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ সোমালিয়া এবং সবচেয়ে কম ডেনমার্ক। জার্মানিভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) ‘দুর্নীতির ধারণা সূচক (করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স বা সিপিআই)-২০১৮’ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য।

২৯ জানুয়ারী মঙ্গলবার বিশ্বে একযোগে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। এদিন বাংলাদেশে টিআই’র সহযোগী প্রতিষ্ঠান টিআইবি এক সংবাদ সম্মেলনে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সংস্থাটির নিজস্ব কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এবং নির্বাহী ব্যবস্থাপক অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের।

দুর্নীতি প্রতিরোধে বেশকিছু সুপারিশ করেছে টিআই। এগুলো হল- দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, দুদককে আরও স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া এবং অবাধ গণমাধ্যম ও সক্রিয় নাগরিকসমাজ বিকাশে উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা। সংবাদ সম্মেলনে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, একধরনের বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি করে দুর্নীতিবাজদের পৃষ্ঠপোষকতা করা হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে দুর্নীতির বিষয়টি অস্বীকার করা হয়। কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করলে নাগরিকসমাজ ও গণমাধ্যমকর্মীদের নাজেহাল হতে হয়। ফলে দুর্নীতিবাজরা এতে উৎসাহিত হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে আরও কয়েকটি কারণে দুর্নীতি কমানো যাচ্ছে না। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- রাজনীতিবিদদের প্রতিশ্রুতির ঘাটতি, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবহিদিতার অভাব, রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য অবস্থান সংকুচিত করে দেয়া এবং গণমাধ্যম ও সুশীলসমাজের প্রতিনিধিদের কথা বলার সুযোগ সীমিত করে দেয়া।

তিনি বলেন, আর্থিক খাতে একের পর এক কেলেঙ্কারি ও জালিয়াতির ঘটনা ঘটলেও তাদের বিচারের আওতায় আনার দৃষ্টান্ত নেই। বিচারিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনৈতিক আনুগত্যের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করার পরামর্শ দেন তিনি।

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। সে কারণে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করে নাগরিকদের জন্য স্বচ্ছ জবাবদিহিতামূলক আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে বাধ্য সরকার। কিন্তু দেশে দুর্নীতি বাড়ছে।

অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান যে পর্যায়ে, তার তুলনায় দেশ থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার হচ্ছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্টে এসব তথ্য উঠে এসেছে। তিনি বলেন, দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রতিবন্ধকতার মধ্যে আরও রয়েছে- শীর্ষ দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দৃষ্টান্ত দেখা যাচ্ছে না।

আর্থিক খাত, জনবল নিয়োগ ও বিভিন্ন চুক্তি বাস্তবায়নে রাজনৈতিক প্রবল নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এলে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে থেকে তা অস্বীকার করা হয়। এতে দুর্নীতিবাজরা উৎসাহিত হয়। এ ছাড়াও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) স্বাধীনতায় ঘাটতি রয়েছে।

টিআই’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুর্নীতির পরিস্থিতি উন্নয়ন সংক্রান্ত স্কোরে ১০০ নম্বরের মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর ২৬। আর গত বছর ছিল ২৮। কিন্তু বিশ্বের সব দেশের গড় স্কোর ৪৩। বিশ্বের গড় স্কোরের চেয়ে ১৭ ধাপ পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। অর্থাৎ দুর্নীতির ব্যাপকতা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ার ৮টি দেশের মধ্যে আফগানিস্তানের পরেই রয়েছে বাংলাদেশের অবস্থান। এ ছাড়াও এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ৩১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ চতুর্থ।

সংবাদ সম্মেলনে ড. ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, বিশ্বের বেশকিছু দেশে নাগরিক স্বাধীনতা সংকুচিত হওয়ায় দুর্নীতি বাড়ছে। বাংলাদেশেও এ প্রবণতা দেখা যায়। আর যেসব দেশে গণমাধ্যম ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিও) কম সুরক্ষা পায়, ওইসব দেশে দুর্নীতি বেশি।

টিআইবির এই নির্বাহী পরিচালক বলেন, আইন প্রয়োগে ঘাটতি রয়েছে। বিশেষ করে ব্যাংকিং ও অর্থনৈতিক খাতসহ বিভিন্ন খাতে ক্রমবর্ধমান অনৈতিক প্রভাব বিস্তার, অনিয়ম-দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলায় দায়ীদের বিচারের আওতায় আনা যায়নি। প্রতিবেদন অনুসারে কম দুর্নীতিগ্রস্ত তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছে ডেনমার্ক।

দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে নিউজিল্যান্ড, তৃতীয় স্থানে যৌথভাবে রয়েছে ফিনল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, সুইডেন ও সুইজারল্যান্ড। সর্বনিম্ন অবস্থান করছে সোমালিয়া। এর আগে সিরিয়া, দক্ষিণ সুদান ও ইয়েমেন। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে ভুটান। ওপরের দিকে দেশটির অবস্থান ৬৮। এরপর ভারত ৪১, শ্রীলংকা ৩৮, পাকিস্তান ৩৩, মালদ্বীপ ২২, নেপাল ৩১ এবং আফগানিন্তান ১৬তম।

ড. ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, দুর্নীতির ক্ষেত্রে একধরনের অস্বীকৃতির মানসিকতা বিরাজ করছে। কোনো কর্মকর্তার দুর্নীতির কথা বললে সেটি অস্বীকার করা হয়। বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশ করলে এক্ষেত্রে হয়রানি ও নাজেহাল হতে হয়। এটি গণমাধ্যমকর্মী ও নাগরিকসমাজ সবার জন্য একইভাবে প্রযোজ্য। তিনি বলেন, নাগরিকসমাজ ও গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য কাজের ক্ষেত্র ক্রমাগত সংকুচিত হচ্ছে। এটি দুর্নীতি প্রতিরোধের ক্ষেত্রে অত্যন্ত বড় প্রতিবন্ধকতা। মানুষের কণ্ঠস্বর প্রকাশ করা অত্যন্ত জরুরি। তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে এ অধিকার সংকুচিত হয়েছে। তাই সংসদের প্রথম অধিবেশনেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন করতে হবে।

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, কোনো দেশেই সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া দুর্নীতি প্রতিরোধ হয় না। আর নির্বাচনে আগে ও পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের ঘোষণা দিয়েছেন। এটিকে রাজনৈতিক সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ বলে আমরা মনে করি। তবে কারও প্রতি দয়া-করুণা না করে এর কার্যকর প্রয়োগ করতে হবে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, দুর্নীতি প্রতিরোধে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা জরুরি। ব্যাংকসহ দেশের আর্থিক খাতে বড় ধরনের জাল-জালিয়াতি হয়েছে। কিন্তু এর সঙ্গে জড়িত শীর্ষ ব্যক্তিদের শাস্তি হয়নি। এতে আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ব্যাহত হচ্ছে। তার মতে, আর্থিক খাতের অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা জরুরি। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে সরে এসে, দুর্নীতি করলে শাস্তি পেতে হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়াও কার্যকর প্রতিষ্ঠান দরকার। এর অন্যতম হল জাতীয় সংসদ। বর্তমান সংসদ যেভাবে, যে পরিপ্রেক্ষিতে, যে ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে নির্বাচিত হয়েছে, তাতে বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলের প্রাধান্য রয়েছে। তারপরও সংসদ কার্যকর হোক, সেটি আমরা চাই। পাশাপাশি দুদককে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।

প্রতিবেদনে ২০১৬-২০১৮ পর্যন্ত তথ্য ব্যবহৃত হয়েছে। জরিপগুলোয় মূলত ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী, সংশ্লিষ্ট খাতের গবেষক ও বিশেজ্ঞদের ধারণার প্রতিফলন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তথ্যসূত্র হিসেবে ৮টি জরিপ ব্যবহৃত হয়েছে।

এগুলো হল- বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি পলিসি অ্যান্ড ইন্সটিটিউশনাল অ্যাসেসমেন্ট, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম এক্সিকিউটিভ ওপিনিয়ন সার্ভে, গ্লোবাল ইনসাইট কান্ট্রি রিস্ক রেটিংস, বার্টেলসম্যান ফাউন্ডেশন ট্রান্সফরমেশন ইনডেক্স, ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট রুল অব ল, পলিটিক্যাল রিস্ক সার্ভিসেস ইন্টারন্যাশনাল কান্ট্রি রিস্ক গাইড, ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট কান্ট্রি রিস্ক রেটিংস এবং ভ্যারাইটিস অব ডেমোক্র্যাসি প্রজেক্ট ডাটাসেট রিপোর্ট। সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, সিপিআই নির্ণয়ে টিআইবির কোনো ভূমিকা নেই। এমনকি টিআইবির গবেষণা থেকে প্রাপ্ত কোনো তথ্যও এখানে বিবেচনায় নেয়া হয় না। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতোই টিআইবি ধারণাসূচক দেশীয় পর্যায়ে প্রকাশ করে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

nineteen − 8 =