আল-আমিন পলাশ: দেশে কর্মরত বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন সাম্প্রতিককালে ২০১৮ সালের শিশু ও নারী ধর্ষণের যে চিত্র তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে তা খুবই উদ্বেগজনক। বলা যায় ধর্ষণ এক প্রকার ক্যানসারের ভাইরাসে পরিনত হয়েছে। যে সকল মানবাধিকার সংগঠন দেশে স্বেচ্ছাসেবী সমাজ কল্যাণের ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে চলেছে তাদের মধ্যে বিশেষকরে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), অধিকার, বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ অন্যতম।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম ২০১৮ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলেছে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে মোট ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৫৭১টি। এর মধ্যে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৯৪ টি। প্রতিবন্ধি ২৮টি শিশুকে ধর্ষণ করা হয়। ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয় ৯৬ জন। ৬০ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। আর ধর্ষণের শিকার ৬ জন আত্মহত্যার চেষ্টা করে। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের ২০১৮ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী সে বছরে যৌন নির্যাতনের শিকার হন ১৫৭ জন। এর মধ্যে ৯ জন আত্মহত্যা করেন। ২ জনের মৃত্যু হয়। আহত হয় ৩৩ জন। লাঞ্ছিত হয় ২৭ জন। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যে, ২০১৯ সালের শুধু জানুয়ারী মাসেই ধর্ষণ, ধর্ষণ চেষ্টা ও নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ২৯৮টি। আর ২০১৮ সালে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে মোট ৩৯১৮টি। তিনটি মানবাধিকার সংগঠনের প্রাপ্ত তথ্যে যে চিত্র উঠে এসেছে তার মধ্যে সর্বাধিক বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদন তৈরী করেছে বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম। কেননা মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের দেশের সর্বত্র তৃণমূল পর্যায়ে কার্যক্রম না থাকায় তাদের প্রতিবেদনে প্রকৃত চিত্রটি উঠে আসা প্রায় অসম্ভব। অন্যদিকে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ নারী ও শিশুর শারিরীক নির্যাতন , যৌন হয়রানি বা এ জাতীয় কার্য্যক্রমকে আলাদা আলাদা করে প্রকাশ না করায় নারী ও শিশু ধর্ষণের বিষয়টি পরিষ্কার করে নিশ্চিত করা যায়নি। আবার বাংলাদেশ মহিলা পরিষদকে একদল অসাধু মহিলারা আইনী লড়াইয়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যাবহার করে বিধায় অসংখ্য মিথ্যা নারী নির্যাতনের ঘটনা এখানে লিপিবদ্ধ হয়। কেননা ইতিপূর্বে আদালতে দায়ের হওয়া যৌতুক ও নারী নির্যাতন মামলার রায়ে আঁশি শতাংশেরও বেশি মামলা মিথ্যা প্রমানিত হয়েছে। যদিও এ জাতীয় মামলার অধিকাংশই বিচারের মাঝপথে মিমাংসার মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়। সে কারনে সকল নারী নির্যাতন ও যৌন হয়রানী একসাথে নথিজাত হওয়ায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পরিসংখ্যানটি এত বৃহৎ আকার পেয়েছে।
এতসব সত্যেও ধর্ষণ যে একটি ভয়ঙ্কর সামাজিক ব্যাধিতে রুপান্তরিত হয়েছে সেকথা অনস্বীকার্য্য। অভিজ্ঞদের ধারণা ধর্ষকরা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ধর্ষণের বিরুদ্ধে কঠোর আইন ধাকলেও তা ঠেকানো যাচ্ছেনা। কেউ কেউ মনে করেন আইন প্রয়োগে দীর্ঘসূত্রিতা, দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন থাকলেও এ সংক্রান্ত নীতিমালা না থাকাই ক্রমশঃ ধর্ষণ বৃদ্ধির অন্যতম কারন। তবে একথা সত্য যে, ধর্ষণ মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রিতা রয়েছে। গড়ে হিসাব করে দেখা যায় যে, বছরে নিষ্পত্তি হচ্ছে মাত্র ৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ ধর্ষণ মামলা। আবার অনেকে এ ব্যাপারে পুলিশের বিরুদ্ধে নারী ও শিশুদের নিরাপত্তার বিষয়ে ব্যার্থতার অভিযোগ আনেন। তবে এ ব্যাপারে সর্বাধিক যুক্তিযুক্ত বক্তব্য দিয়েছেন উইমেন সাপোর্ট এ্যান্ড ইনভেষ্টিগেশন ডিভিশনের উপ-পুলিশ কমিশনার ফরিদা ইয়াসমিন। রাস্তা বা পাবলিক প্লেসে নারী ও শিশু নির্যাতিত হলে তার নিরাপত্তা প্রদান করা পুলিশের দায়িত্ব। কিন্তু বাড়ীতে বা হোটেলে নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে সেক্ষেত্রে তদন্ত করে আইনানূগ ব্যাবস্থা গ্রহন করা পুলিশের দায়িত্ব বটে। তবে সেখানে ধর্ষণ ঠেকাতে নিরাপত্তা ব্যাবস্থা নিশ্চিৎ করা পুলিশের পক্ষ্যে অসম্ভব। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় ধর্ষকের এ মনোভাবকে পার্সোনাল সাইকোপ্যাথি টেনডেন্সি বলা হয়েছে। মনোবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞদের ধারনা পার্সোনাল ডিজঅর্ডার থেকে পার্সোনাল সাইকোপ্যাথি টেনডেন্সির জন্ম হয়। এতে ধর্ষকের মধ্যে সামাজিক দায়িত্ববোধ লোপ পায় এবং নৈতিক চরিত্রের অবনতি ঘটে। চিকিৎসা বিজ্ঞান বা মনোবিজ্ঞান গবেষকরা এ রোগটির নাম যা-ই দিক না কেন এ রোগটি জন্মের অন্যতম কারন হচ্ছে- ব্যাপক হারে মাদক সেবন, পরিবারে বহিরাগতদের অবাধ যাতায়াত অর্থাৎ পারিবারিক পর্দাপ্রথা না থাকা, কিশোর-তরুণ ও যুবকদের মধ্যে পর্ণগ্রাফি দেখার অবাধ সুযোগ এবং নগ্ন সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। এ চারটি কারনের মধ্যে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ কারন দুটি হচ্ছে মাদক সেবন ও পর্ণগ্রাফি। কেননা মাদক সেবনকারীর শারিরীক ক্ষতি যতটা হয় তার চেয়ে বেশি জীবনের ও সামাজিক মূল্যবোধ লোপ পায়। আর পর্ণগ্রাফি তার মনের মধ্যে বিকৃত যৌনাচারের মনোভাব তৈরী করে। ফলে সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে সরে এসে তারা বিকৃত যৌনাচারে লিপ্ত হয়। তাদের বিকৃত লালসার শিকার হয় প্রতিবন্ধী, শিশু ও বৃদ্ধারা।
কেননা এদের কাছ থেকে শক্তিশালী প্রতিবাদ পাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। কিন্তু একটি বাস্তব সত্য কখনোই সমাজের সামনে আসেনা বা পত্রপত্রিকার পাতায় প্রকাশিত হয়না। এমনকি পরিবারের লোকেরাও জানতে পারেনা। তা হলো আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি ধর্ষণ, ধর্ষণ চেষ্টা বা যৌন হয়রানির শিকার হন ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সী বিবাহিত ও অবিবাহিত নারীরা। সমাজে কলঙ্ক হলে অবিবাহিতদের আর বিয়ে হবেনা আর বিবাহিতদের সংসার ভাঙ্গবে এই ভয়ে এসব নারী মুখবুজে যৌন হয়রানীর কথা হজম করে নেয়। কিন্তু শিশু, প্রতিবন্ধী ও বৃদ্ধাদের সে ভয় নেই বলেই আমরা কেবল তাদের যৌন হয়রানীর খবরটি অনায়াসে শুনতে পাই। আর সবচেয়ে বেশি যৌন হয়রানীর শিকার হন যারা তাদের খবর খবরের অন্তরালেই থেকে যায়।
ওয়ান ইলেভেনের পূর্বে অর্থাৎ বিএনপি-জামায়াত সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীণ সময়ে তথ্য মন্ত্রণালয় তিন বার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে তৎকালীণ সময়ে বাংলাদেশে থাকা ৮০টি পর্ণ-ওয়েবসাইট বন্ধের জন্য অনুরোধ করেছিল। কিন্তু তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় বিশেষ কোন পদক্ষেপ গ্রহন করেননি। আর এখন বাংলাদেশে হাজার হাজার পর্ণ-ওয়েবসাইট। বর্তমান সরকারও এ ব্যাপারে বিশেষ কোন ভূমিকা পালন করতে পারেননি।
মাদকের বেলাতেও প্রায় একই অবস্থা। আওয়ামীলীগ সরকারের বিগত সংসদ থাকাকালীণ সময়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ সরকারকে অনুরোধ করেছিলেন মাদক নিয়ন্ত্রনে মেজিষ্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেয়া হোক। কিন্তু তখন সরকার তার কথায় কর্ণপাত করেননি। আর এখন মাদক নিয়ন্ত্রনের নামে কথিত বন্ধুকযুদ্ধের মাধ্যমে দেশের সর্বত্র চলছে অসংখ্য বিচার বহিঃর্ভূত হত্যা। আইন করে যেমন দেশ থেকে নারী নির্যাতন বন্ধ করা যায়নি। তেমনি আইন করে বা আইনের দ্রুত প্রয়োগ করেও ধর্ষণ ঠেকানো যাবেনা। কিংবা স্কুল, কলেজে সচেতনতা বৃদ্ধি করলেও ধর্ষণ কমবেনা। ধর্ষণের শুধুমাত্র প্রতিরোধক হলো মাদক নির্মূল করা, পর্ণগ্রাফি পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করা, নগ্ন সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বন্ধ করা ও পারিবারিক পর্দাপ্রথা চালু করা। লেখক- সাংবাদিক।