আখেরে ইতিহাসের পাতায় এ নির্বাচনের স্থান কোথায় হবে, সেটাই প্রশ্ন

0
467

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নামে যে ঘটনা ঘটে গেল, তাকে আওয়ামী লীগের মহাবিজয় বলতে একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী অজ্ঞান। অন্যদিকে বিদেশ থেকেও অভিনন্দন জানিয়ে বার্তা আসছে।

 

কিন্তু আখেরে ইতিহাসের পাতায় এ নির্বাচনের স্থান কোথায় হবে, সেটাই প্রশ্ন। বহুবার বলা হয়েছে যে, গায়েবি মামলাকে বিরোধী দলের ওপর করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে সরকার তার মতো একটি নির্বাচন সম্পন্ন করেছে। কিন্তু গায়েবি মোকাদ্দমা সরকারকে ইতিহাসের পাতায় কোথায় স্থান করে দেবে সরকারের লোকজন উপলব্ধি করতে পারছেন না। উপলব্ধি করতে না পারার কারণ এও হতে পারে যে, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহলের গ্রিন সিগন্যাল থেকেই গায়েবি মোকাদ্দমার উৎপত্তি। যার কারণে এতো সমালোচনার পরও সরকার বা কোনো মহল বা সরকারি ঘরানার বুদ্ধিজীবী গায়েবি মামলার অস্তিত্ব স্বীকারই করেন না। গায়েবি মোকদ্দমা কী? পত্রিকান্তরে প্রকাশিত সংবাদ থেকেই বুঝা যাবে। সংবাদটি নিম্নরূপ ‘পঙ্গু তারা মিয়া, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যার বিরুদ্ধে পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে মামলা দেয়া হয়েছিলো, তাকে নিয়ে জাতীয় দৈনিকে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর ২৩/০১/২০১৯ ইং তিনি হাইকোর্ট থেকে ছয় মাসের জামিন পেয়েছেন। পুলিশের করা ওই মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়েছিল, গত ২৮ ডিসেম্বর অর্থাৎ নির্বাচনের দু’দিন আগে বিকাল ৪টার পর সুনামগঞ্জের মল্লিকপুর বাজারে চাপাতি, হকিস্টিক ও লোহার রড নিয়ে পুলিশের ওপর আক্রমণের ঘটনা ঘটে। মামলায় ৫২ জনকে আসামি করে পুলিশ। তারা মিয়া সেই ৫২ জনের একজন। তবে জামিনের সময় শেষ হয়ে গেলে তারা মিয়াকে সুনামগঞ্জের নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। জানা গেছে, ডান হাতটি অস্বাভাবিক চিকন, নাড়াতেই কষ্ট হয়। কিছু ধরতে বা কাজ করতে পারেন না ডান হাত দিয়ে। এমনকি ডান হাতে খেতেও পারেন না। এটি তার জন্মগত সমস্যা। বাম হাত তুলনামূলকভাবে লম্বা এবং বাঁকানো। খুব কষ্ট করে বাম হাত দিয়ে খেতে হয়। পঙ্গু এই মানুষটির ডান হাত অচল, বাম হাতও প্রায় অচল। তিনি সুনামগঞ্জের অধিবাসী, নাম তারা মিয়া। তারা মিয়া চাপাতি, হকিস্টিক ও লোহার রড হাতে নিয়ে আক্রমণ করেছেন পুলিশের ওপর। ভিক্ষা করে জীবনযাপন করা তারা মিয়ার বিরুদ্ধে পুলিশ এমন অভিযোগ এনে মামলা করেছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, গত ২৮ ডিসেম্বর অর্থাৎ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দুদিন আগে বিকাল ৪টার পর মল্লিকপুর বাজারে এই আক্রমণের ঘটনা ঘটে। ৫২ জনকে আসামি করে মামলা করেছে পুলিশ। তারা মিয়া সেই ৫২ জনের একজন।’ যার উপলব্ধি বোধ রয়েছে তার এই সংবাদ পাঠ করার পর নিশ্চয় গায়েবি মামলা সম্পর্কে একটি ধারণা জন্মাবে। যারা একতরফা ‘শান্তিপূর্ণ’ নির্বাচনের স্বার্থে গায়েবি মামলার সমর্থক তাদের কথা ভিন্ন। কিন্তু একজন বিবেকমান মানুষ কোনো কারণেই গায়েবি মোকাদ্দমার সমর্থন করতে পারে না। গায়েব থেকে সৃষ্ট এই গায়েবি মোকাদ্দমাই বিরোধী দলের উপর বিষফোঁড়া হিসেবে আবিভর্‚ত হয়েছে, যদিও পদোন্নতির ভাগ্যাকাশ অনেকের জন্যই খুলে গেছে। অথচ বাম জোটের মতবিনিময় সভায় বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ বলেছেন, আওয়ামী লীগের অতি বিজয় অর্জিত হয়েছে ঘৃণ্য ও কলঙ্কজনক পথে। তারা বলেন, দুর্নীতিগ্রস্ত এ নির্বাচন ব্যবস্থা থেকে মুক্তি পেতে জাতীয় নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা চালু করতে হবে। বাম গণতান্ত্রিক জোটের নজিরবিহীন ভোট ডাকাতির নির্বাচন, গণশুনানির অভিজ্ঞতা: নাগরিক সমাজের ভাবনা ও করণীয় শীর্ষক মতবিনিময় সভায় বক্তারা এ কথা বলেন। সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের ফলশ্রুতিতে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। পৃথিবীর দুশোটি দেশের মধ্যে পঞ্চাশটি দেশে গণতন্ত্র আছে। বাকিগুলোতে স্বৈরতন্ত্র চলছে। বাংলাদেশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের মিছিলে ঢুকে গেছে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি অবস্থায় নিহত হন। কেউ বলতে পারবে না কোন নির্বাচনে তিনি রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ ভয় এবং লোভ ব্যবহার করে নির্বাচনের কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গদের দুর্নীতিগ্রস্ত করেছে। তিনি এ ধরনের দুর্নীতিগ্রস্ত নির্বাচন ব্যবস্থা থেকে মুক্তি পেতে জাতীয় নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা চালুর জন্য সংগ্রাম গড়ে তোলার আহ্বান জানান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, আওয়ামী লীগের অতি বিজয় অর্জিত হয়েছে ঘৃণ্য ও কলঙ্কজনক পন্থায়। বাংলাদেশ অন্ধকার পথে প্রবেশ করেছে। এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে আমাদের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটাতে হবে। অধ্যাপক আকাশ বাম জোটকে ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব’ আন্দোলন গড়ে তুলতে আহ্বান জানান। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে পূর্ব পরিকল্পিত পদ্ধতিতে নির্বাচনে অতি বিজয় অর্জন করেছে।’নির্বাচনে মহাবিজয় সম্পর্কে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহাজয়ের কারণ হিসেবে ১৪টি এবং বিএনপি’র জোটের তথা ঐক্যফ্রন্টের পরাজয়ের ৭টি কারণ উল্লেখ করেছেন। যেহেতু প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপি তথা ঐক্যফ্রন্ট সম্পর্কে ৭টি ব্যর্থতার কারণ হিসাবে নির্ধারণ করে মন্তব্য করেছেন, সেহেতু বিএনপি’র পক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য খণ্ডানো দরকার। নতুবা রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য অখণ্ডিতভাবেই থেকে যাবে। পরিস্থিতি মোকাবেলা করাই রাজনৈতিক দলের ধর্ম হওয়া বাঞ্চনীয়। প্রতিবাদ ও জবাবদিহিতা না থাকলে ‘রাজনীতি’ থাকে না। নির্বাচনে হেরে যাওয়া সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী যে ৭টি কারণ উল্লেখ করেছেন তার আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা প্রদান করা জনগণের মধ্যে একদিকে যেমন আশার সঞ্চার করবে, অন্যদিকে কর্মীদের নিকট জবাবদিহিতার বিষয়টি নিশ্চিত হবে। বিএনপির উপরে সরকার যে স্টিম রোলার চালিয়েছে তা জেনেও সাফাই গাওয়ার জন্যই তিনি জনসভায় নির্বাচনের মহাজয় ও প্রতিপক্ষের পরাজয়ের কারণ ব্যাখ্যা করেছেন, যা তার নিজস্ব আঙ্গিকেই তিনি করেছেন, যা সুনির্দিষ্টভাবে খণ্ডানোর দায়িত্ব বিএনপির রয়েছে বলে আমি মনে করি। প্রবাদ রয়েছে যে, ‘চোখ বন্ধ রাখলে প্রলয় বন্ধ থাকবে না।’ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য খণ্ডানোর বিষয়ে বিএনপি পিছিয়ে থাকলে পরিস্থিতি বিএনপি পিছনের দিকে ঠেলে দেবে। ফলে বিষয়টি অনেক গুরুত্ব বহন করে। স্মরণ করা দরকার যে, অনেক কিছুই ফাঁকি দেয়া যায়, আবার অনেক কিছুই ফাঁকি দেয়া যায় না। ১৮ কোটি মানুষের ৩৬ কোটি চোখকে ফাঁকি দেয়া যাবে, বিদেশিদের চোখে ধূলো দেয়া যাবে, কিন্তু তারা কি তাদের নিজের চোখকে ফাঁকি দিতে পারবেন যারা ভ‚মিধস বিজয় অর্জনের কারিগর হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছেন? জনগণের কষ্টার্জিত অর্থে যাদের স্ত্রী-পুত্র পরিবার পরিজন লালিত-পালিত তাদের বিবেকে কি জনগণের অধিকার কেড়ে নিতে একটুও কুণ্ঠা বোধ করে নাই? জাতির বিবেক কি নিরব নিস্তব্ধ হয়ে যাবে? একদিন জাতির কাছে তাদের জবাবদিহি করতেই হবে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

fifteen − ten =