ট্রেনের টিকিট বিক্রিতে ছেয়ে গেছে কালোবাজারি

0
744

শ্রীমঙ্গলে বেড়াতে এসেছিলেন নারায়ণগঞ্জের কৃষিবিদ মো. জান্নাতুল জালাল। শ্রীমঙ্গল থেকে ঢাকায় ফিরবেন। ছেলে বায়না ধরেছে ট্রেনে ঢাকায় যাবে। ছেলের কথা রাখতে তিন দিন আগে থেকে স্টেশনের টিকিট কাউন্টারে যোগাযোগ করেন তিনি, কিন্তু পাননি।

 

তার আগেই শেষ! শ্রীমঙ্গল রেলস্টেশনে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, ঢাকায় ফেরার দিন এক আত্মীয়ের মাধ্যমে আন্তঃনগর পারাবত ট্রেনের টিকিট কালোবাজারির কাছ থেকে ২৪০ টাকা করে দুটি টিকিট এক হাজার ৭০০ টাকায় কিনি। জান্নাতুল জালালের হিসাবমতে, পারাবত ট্রেনের শোভন চেয়ারের দাম ২৪০ টাকার স্থলে বাড়তি আরও ৬১০ টাকা প্রতি টিকিটের মূল্য দিতে হয়েছে তাকে। এটি শুধু জান্নাতুল জালালের অভিযোগ নয়—এ ধরনের অভিযোগ শ্রীমঙ্গল রেলস্টেশনে যাত্রীদের এখন নিত্যদিনের। সাধারণ যাত্রীদের অভিযোগ—ঢাকাগামী আন্তঃনগর ট্রেন জয়ন্তিকা, উপবন, কালনী, পারাবত ট্রেন ও  চট্টগ্রামগামী আন্তঃনগর উদয়ন, পাহাড়িকা ট্রেনের টিকিট সংগ্রহ করতে আগের নিয়মে তিন দিন আগে কাউন্টারে যোগাযোগ করে কিছু টিকিট পেতেন যাত্রীরা। অথচ বর্তমানে ১০ দিন আগে টিকিট বিক্রির নিয়ম চালু থাকায় কাউন্টারে এখন আর টিকিটই পাওয়া যাচ্ছে না। যোগাযোগ করলে কাউন্টারে বলা হয় টিকিট শেষ, সব বিক্রি হয়ে গেছে। যাত্রীদের অভিযোগ—এসব টিকিট আগেভাগে কিনে নেন মুখচেনা কালোবাজারি চক্রের সঙ্গে জড়িতরা। পরবর্তীতে তাদের কাছ থেকেই এসব টিকিট বেশি দামে কিনতে বাধ্য হন যাত্রীরা। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে স্টেশনের কাউন্টারের টিকিট বিক্রেতারা যুক্ত থাকায় অগ্রিম টিকিট ছাড়ার দিন থেকে স্টেশনের কতিপয় নিম্ন শ্রেণির কর্মচারী, লেবার আনসারসহ টিকিট কালোবাজারিরা আগাম কিনে নিচ্ছে। আর এসব টিকিট প্রতিদিন কালোবাজারিদের কাছ থেকে যাত্রীরা অতিরিক্ত দাম নিয়ে নামে-বেনামে বিক্রি করছেন। জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরেই স্টেশন মাস্টারসহ কালোবাজারি লেবার সফি উল্লা লেবার হাসান, মতিন, জায়েদ, সুমন, কবিরসহ আরো একাধিক চক্র টিকিট কালোবাজারি করে আসছেন। বুকিং সহকারীদের ছত্রছয়ায় কালোবাজারি চক্রের সদস্যরা প্রায় ৭৫ শতাংশ টিকিট কেটে নেন। এরপর টিকিটের কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে চক্রটি বেশি দামে টিকিট বিক্রি করে। দিনের পর দিন এভাবেই চলে আসছে ট্রেনের টিকিটের কালোবাজারি। এ চক্রের সঙ্গে টিকিট বুকিং মাস্টার থেকে শুরু করে স্টেশনের একজন মাস্টার ও ম্যানেজার জড়িত। বিশেষ কোটার নামেও চক্রটি টিকিট কেটে নেয়। এতে করে দ্বিগুণ দামে যাত্রীদের টিকিট কিনতে হচ্ছে। এভাবে চক্রটি বছরে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। আবার অতিরিক্ত টাকায় টিকিট কিনে অনেক যাত্রী ঝামেলায়ও পড়ছেন। কারণ চক্রটি জাল টিকিটও বিক্রি করছে। জানা গেছে, বর্তমানে এ স্টেশন থেকে ঢাকাগামী আন্তঃনগর ট্রেন জয়ন্তিকায় আসন সংখ্যা রয়েছে, মোট ৬৪টি। এর মধ্যে প্রথম শ্রেণির কেবিন সিট ৯টি, প্রথম শ্রেণির চেয়ার ১০টি, শোভন চেয়ার ২৫টি ও শোভন ১০টি। ঢাকাগামী আন্তঃনগর উপবন ট্রেনে মোট টিকিট সংখ্যা রয়েছে ৬১টি। এর মধ্যে প্রথম শ্রেণির বার্থ ৬টি, প্রথম শ্রেণির চেয়ার ৫টি, শোভন চেয়ার ২০টি ও শোভন ৩০টি। এ ছাড়া আন্তঃনগর কালনী ট্রেনে এ স্টেশনে মোট টিকিট রয়েছে ৫১টি। এর মধ্যে প্রথম শ্রেণির চেয়ার ৬টি, শোভন চেয়ার ২০টি ও শোভন ২৫টি। আন্তঃনগর পারাবত ট্রেনে মোট আসন সংখ্যা রয়েছে ১০৫টি। এর মধ্যে এসি কেবিন ১৫টি, এসি চেয়ার ৩০টি ও শোভন চেয়ার রয়েছে ৬০টি। অন্যদিকে শ্রীমঙ্গল স্টেশন থেকে চট্রগ্রামগামী আন্তঃনগর উদয়ন ট্রেনে শুধু শোভন শ্রেণির মোট আসন সংখ্যাই রয়েছে ৪৫টি। এর মধ্যে কুমিল্লা ৫টি, ফেনী ৫টি, লাকসাম ৫টি ও চট্টগ্রাম ৩০টি। একই রুটে আন্তঃনগর পাহাড়িকা ট্রেনে মোট ৬১টি আসন বরাদ্ধ রয়েছে। এর মধ্যে কুমিল্লা ৫টি, ফেনী ৫টি, লাকসাম ৫টি ও চট্টগ্রাম ৩০টি। অথচ এ স্টেশন থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রাম রুটে প্রতিদিন এই ছয়টি ট্রেনে গড়ে প্রায় ৬০০ থেকে ৯০০ যাত্রী চলাচল করলেও সর্বমোট ৬টি ট্রেনের টিকিট বরাদ্দ রয়েছে মোট ৩৮৭টি বলে স্টেশন সূত্রে জানা গেছে। জানতে চাইলে শ্রীমঙ্গল রেলস্টেশনের মাস্টার মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘কাউন্টারে তিন শিফটে বুকিং সহকারী আফিজুল হক, কবির হোসেন ও মীর আবুতাহের এই তিনজন থাকেন। আর কম্পিউটার সিস্টেম নেটওয়ার্ক প্রতিনিধি রায়হান মাঝে মধ্যে অন্যরা অসুস্থ হলে টিকিট বিক্রি করে থাকে। মতিন সফি উল্যা লেবার ছিল। এখন লেবারই করে না, ঘুরে বেড়ায়। বেশি দামে যখন টিকিট কেনে তখন ওদের ধরে পুলিশে দেয় না কেন?। আমি নিজেও জানি, এরা এগুলা করে। কিন্তু এরা আমার সামনে পড়ে না। আমি যেদিন ওদের ধরতে পারব, ওইদিন ওদের লাথি মারতে মারতে পুলিশে দেব। সবাই খালি বলে এরা টিকিট ব্ল্যাক করে। এখন প্রমাণ ছাড়া কীভাবে ধরি। অনেকেই বলে ব্ল্যাকে টিকিট পাইছি। তখন বলি একটা লিখিত দেন, সে ময় রাজি হয় না উল্টো বলে ভাই তাহলে তো এরপর আর টিকিট পাব না।’ স্টেশন মাস্টার জাহাঙ্গীর আলম যাত্রীদের অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘টিকিট কালোবাজারিদের কাছ থেকে যখন আপনারা বেশি দামে টিকিট নেবেন তখন তার নাম ও টিকিটসহ তাৎক্ষণিকভাবে আমাকে জানালে সাথে সাথে মামলা করে পুলিশে সোপর্দ করব অথবা মোবাইল কোর্টে জেল জরিমানার ব্যবস্থা করাব। এ রকম দুই একটির বিচার হলে টিকিট কালোবাজারি কমে যাবে।’

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

5 + 2 =