ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনির্বাচিত ভিপি কে এই নুর

0
703

অবি ডেস্কঃ সবাইকে চমকে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে সহসভাপতি (ভিপি) পদে জয়ী হয়েছেন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলনের নেতা নুরুল হক নুর। সোমবার গভীর রাতে নির্বাচন কমিশন যখন ভোটের ফল ঘোষণা করে, তখন হাসপাতালের বেডে শয্যাশায়ী শিক্ষার্থীদের জনপ্রিয় এ মুখ। ২৮ বছর পর অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনে অন্য সব পদে ছাত্রলীগের প্যানেল নিরঙ্কুশ জয় পেলেও সর্বোচ্চ পদে চমক দেখিয়েছেন নুরুল হক নুর। চাকরিতে কোটাব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের প্লাটফর্ম বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের প্যানেল থেকে নির্বাচন করা এ নেতা জয়ী হয়েছেন বিপুল ভোটে।

 

ডাকসু নির্বাচনে নুরের প্রাপ্ত ভোট ছিল ১১ হাজার ৬২টি। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হেভিওয়েট প্রার্থী ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন পেয়েছেন ৯ হাজার ১২৯ ভোট। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর চেয়ে ১৯৩৩ ভোট বেশি পেয়ে জয়ী হন নুর। শিক্ষার্থীরা বলছেন ভিপি পদে নীরব ভোট বিপ্লব হয়েছে।

ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত নুরুল হক নুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক। তার বাড়ি পটুয়াখালীতে। এর আগে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে হামলা, মামলা ও কারাবরণের মুখোমুখি হন।

সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসেছেন নুরুল হক নুর। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনটা শুরু করেন আর দশজন ছেলের মতো। ক্যাম্পাস জীবনের শুরুতে তার তেমন কোনো পরিচিতিই ছিল না। কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হওয়ার পর তিনি তাকে জড়ান। শিক্ষার্থীদের সংগঠিত করেন। হাসান আল মামুন, রাশেদসহ অন্য সহপাঠীদের নিয়ে গড়ে তোলেন সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। এই পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক হন রাশেদ। এই পরিষদে অন্তর্ভুক্তিই তার ব্যাপক পরিচিতি এনে দিয়েছে। এই পরিষদের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা হলেও মূল কার্যক্রম নুরকে ঘিরেই পরিচালিত হয়েছে।

তুমুল কোটা আন্দোলন চলাকালে প্রশাসন ও ছাত্রলীগের অব্যাহত হামলার মুখে দমে যাননি নুর। কর্মসূচি দিয়েছেন, মাঠে থেকেছেন এবং একাধিকবার মারও খেয়েছেন। তবু কোটা আন্দোলন থেকে পিছু হটেননি।

নুর কোটা সংস্কার আন্দোলন করতে গিয়ে হামলা, মামলা ও কারাবরণের মুখোমুখি হন। শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের দাবি কোটাব্যবস্থা সংস্কারের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। জয় হয় নুরসহ কোটা আন্দোলনকারী নেতাদের।

শুধু কোটা সংস্কার আন্দোলন নয়, পরবর্তী সময়ে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনেও সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দেন নুর। শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবিকে তুলে ধরেন দেশবাসীর কাছে। কোটা আন্দোলনে জড়িত শিক্ষার্থীদের সংগঠিত করে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনে যুক্ত করেন।

এই দুটি আন্দোলন নুরকে ব্যাপক পরিচিতি এনে দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতারা যেখানে নিজ দলের লেজুড়বৃত্তি করে, সেখানে নুর শিক্ষার্থীদের প্রকৃত দাবিগুলো নিয়ে আন্দোলন করেন। এটিই অন্যদের চেয়ে তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ।

সবশেষ সোমবার ডাকসু নির্বাচন চলাকালে নির্বাচনে রোকেয়া হলকেন্দ্রে ভোটের অনিয়মের প্রতিবাদ করতে গিয়ে ছাত্রলীগের মারধরের শিকার হয়ে সংজ্ঞা হারান নুর। তার পরও তাকে দমিয়ে রাখা যায়নি। শেষ পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষার্থীরা ভোট দিয়ে তাকেই নেতা নির্বাচিত করেছেন।

হাসপাতালের বেডে শুয়েই ভিপি পদে জয়ের খবর পান নুর। ‘প্রহসনের ভোটে’ প্যানেলের সব প্রার্থীর পরাজয়ের মাঝে ভিপি পদে এ জয় যে তাকে খুব একটা খুশি করতে পারেনি, সেটি বোঝা গেল তার কথায়।

সোমবার রাত ৩টার পর তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় নুর বলেন, এ রকম নির্বাচন আমাদের কারোরই প্রত্যাশা ছিল না। প্রায় তিন যুগ পর এই নির্বাচন হলো। সারা দেশের মানুষ তাকিয়ে ছিল এই ভোটে। কিন্তু প্রত্যাশিত ভোট হয়নি। ডাকসু নির্বাচন কলঙ্কের ইতিহাস সৃষ্টি করল।

‘জাতীয় নির্বাচনের পর নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর মানুষের যে অনাস্থার সৃষ্টি হয়েছিল— আমরা ভেবেছিলাম সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সেখানে আশার আলোর সঞ্চার করা হবে’-যোগ করেন নুর।

কারচুরি অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, প্রশাসনের সহায়তায় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ যে কারচুপি করেছে তা শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, পুরো দেশকে হতাশ করেছে। আমরা মনে করি, ১১ মার্চের নির্বাচন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়।

ডাকসু নির্বাচনে ভোট জালিয়াতি, জালভোট, ব্যালটবাক্স ছিনতাই ও অনিয়মের অভিযোগ তুলে ভোটের দিন দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করে বর্জনের ঘোষণা দেয় নুরুল হক নুরের নেতৃত্বাধীন প্যানেল। বর্জন করা ভোটেই জয় পান নুর।

রাতে ঘোষিত ফলে দেখা গেল প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রলীগ প্রার্থী রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনকে প্রায় দুই হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে ডাকসুর সহসভাপতি হয়েছেন নুর। ভোট বর্জনকারী নুর শেষ পর্যন্ত ভিপি পদে শপথ নেবেন? এই প্রশ্ন এখন শিক্ষার্থীদের মুখে মুখে।

শিক্ষার্থীরা যাকে এত আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে নেতা নির্বাচিত করলেন, তিনি শেষ পর্যন্ত দায়িত্ব নেবেন কিনা সেটি নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কারণ তিনি আগেই ভোট বর্জন করেছেন। বর্জন করা ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধি নুর ডাকসুর ভিপি হিসেবে শপথ নেবেন কিনা সেই প্রশ্নের উত্তর জানতে অপেক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

শপথ নেবেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে নুরুল হক নুর বলেন, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন বাদে বাকি সব সংগঠন এই নির্বাচন বর্জন করেছে। তাই তাদের সঙ্গে কথা বলেই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

নতুন ভিপিকে বহিষ্কার দাবি

এদিকে ভিপি পদে জয়ী কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের নেতা নুরুল হক নুরকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের দাবি জানিয়েছে ছাত্রলীগ। এমনকি তার নামে মামলাও করা হয়েছে। নতুন ভিপির বহিষ্কার দাবিতে মঙ্গলবার সকাল থেকে ভিসির বাসভবনের সামনে বিক্ষোভ করছেন শিক্ষার্থীরা।

সোমবার দিবাগত রাতে নুরকে ভিপি ঘোষণার পর উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামানের কাছে এ দাবি জানান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী।

ডাকসুর ভিপি হিসেবে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা নুরুল হক নুরের নাম ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই বিক্ষোভ শুরু করেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। ‘ভুয়া’, ‘ভুয়া’ বলে চিৎকার করতে থাকেন তারা।

ছাত্রলীগকর্মীদের বিক্ষোভ, হইচই-এ ফল ঘোষণায় বিরতি দিতে বাধ্য হন উপাচার্য।

একপর্যায়ে সেখানে উপস্থিত ছাত্রলীগ সভাপতি ও সংগঠনটির প্যানেল থেকে ভিপি প্রার্থী রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনের ইশারায় বিক্ষোভে বিরতি দেন সংগঠনটির বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা।

এর পর সাধারণ সম্পাদকসহ বাকি পদগুলোতে ভোটের ফল ঘোষণা করেন উপাচার্য। সাধারণ সম্পাদকসহ বাকি ২৪টি পদের একটি বাদে অন্যগুলোতে ছাত্রলীগের প্যানেলের (সম্মিলিত শিক্ষার্থী পরিষদ) প্রার্থীরাই জয়ী হয়েছেন।

ফল ঘোষণা শেষ হলে আবারও বিক্ষোভ শুরু করেন ছাত্রলীগকর্মীরা। এ সময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ‘এ ফলাফল মানি না, মানব না’ ‘নুরের চামড়া, তুলে নেব আমরা’, ‘ভুয়া ভুয়া’ বলে স্লোগান দেন। এতে অডিটরিয়ামে হট্টগোলের সৃষ্টি হয়।

প্রায় আধা ঘণ্টা বিক্ষোভের পর ছাত্রলীগ সভাপতি শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী উপাচার্যের পাশে যান। এ সময় উপাচার্যের কাছে নুরকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের দাবি করেন রাব্বানী। তিনি বলেন, একটি প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ও কোটা আন্দোলনের সময় সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করা হয়েছে।

দিনে ডাকসুর ভোটগ্রহণ চলার সময় রোকেয়া হলে ‘ব্যালট উদ্ধার’র নামে নাটক সংঘটিত করে প্রাধ্যক্ষকে আক্রমণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন রাব্বানী। ওই ঘটনায় একজন সাধারণ শিক্ষার্থী নুরসহ কয়েকজনকে আসামি করে থানায় মামলা করেছে জানিয়ে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের দাবি করেন। গোলাম রাব্বানী বলেন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের ইমোশনকে ব্যবহার করে রোকেয়া হলের প্রভোস্টের ওপর হামলা চালিয়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা মামলা করেছে। আমরা ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানাই।

উপাচার্যকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী নিষিদ্ধ। আমরা এই ভোট পুনর্বিবেচনার দাবি জানাচ্ছি। এ সময় উপস্থিত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা ‘বহিষ্কার চাই’, ‘বহিষ্কার চাই’ স্লোগান দেন। এ বিষয়ে কিছু না বলে কিছু সময় পর সিনেট ভবন থেকে বেরিয়ে যান উপাচার্য। তার পেছন পেছন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরাও স্লোগান দিতে দিতে বেরিয়ে যান।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

14 − 14 =