নিউজিল্যান্ডসহ পুরো বিশ্ব দেখল সহমর্মিতা, সৌহার্দ্য, ভালোবাসা আর ঐক্যের জয়গান

0
674

এক সপ্তাহ আগে বর্ণবাদী এক খুনির চোখে হিংসা-জিঘাংসা দেখেছে নিউজিল্যান্ড। মসজিদে প্রার্থনারত মানুষের সারি সারি লাশ আর প্রিয়জনের রক্তাক্ত শরীর দেখে চমকে গিয়েছিল দেশটির নিরীহ জনপদ।

 

শান্তির নীড়ে ঘৃণার হুঙ্কার! শান্ত পাখি ‘কিউই’র চারণভূমিতে এই বর্বর ধর্মবিদ্বেষী রক্ত কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না।ঠিক সাত দিন পরের শুক্রবারে পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখাল নিউজিল্যান্ড। দেখাল শান্তির পথ। শোনাল ঐক্যের বাণী। এবার নিউজিল্যান্ডসহ পুরো বিশ্ব দেখল সহমর্মিতা, সৌহার্দ্য, ভালোবাসা আর ঐক্যের জয়গান। বুলেটে জর্জরিত আল নূর মসজিদের বাইরে হ্যাগলি পার্কে ধর্ম-বর্ণ, গোত্র, জাত-পাত ভুলে জড়ো হন হাজার হাজার মানুষ। অন্য ধর্মের নারীরা মুসলিমদের প্রতি সমবেদনা জানাতে হাজির হন হিজাব পরেই। ছিলেন স্বয়ং নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্দা আরদার্নও। খোলা মাঠে মধুর কণ্ঠে ভেসে আসে আজানের সমধুর ধ্বনি। এরপরই নিহত অর্ধশত মানুষের স্মরণে দুই মিনিটের জন্য নীরব থাকে পুরো নিউজিল্যান্ড। জাতবিদ্বেষ ভুলে শান্তির বার্তা ছড়ানো এ দৃশ্য সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছে নিউজিল্যান্ডের রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেল (টিভিএনজেড) ও রেডিওতে। এ দিনকে জাতীয় দিবসের মতো পালন করেছে নিউজিল্যান্ডবাসী। জুমার নামাজ শেষে ২৬ মরদেহের গণজানাজার পর ক্রাইস্টচার্চে দাফন করা হয়। তাদের মধ্যে দুই বাংলাদেশিও রয়েছে। বাকি তিনজনের লাশ দেশে আনা হচ্ছে। গত ১৫ মার্চ বেলা দেড়টার দিকে ক্রাইস্টচার্চের আল নূর মসজিদে জুমার নামাজের সময় মুসলিমদের ওপর আধা-স্বয়ংক্রিয় বন্দুক নিয়ে হামলা চালায় অস্ট্রেলীয় যুবক ব্রেনটন টেরেন্ট (২৮)। এর কিছু পর কাছাকাছি লিনউড মসজিদে হামলা চালায় সে। দুটি হামলায় ৫০ জন নিহত ও ৪৮ জন আহত হন। হত্যার অভিযোগ এনে ব্রেনটনকে কারাবন্দি রাখা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী জাসিন্দা বৃহস্পতিবার দেশটিতে সব ধরনের আধা-স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। জুমার নামাজ শুরুর আগে মুসল্লিদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী জাসিন্দা বলেন, ‘তোমাদের সঙ্গে আজ পুরো নিউজিল্যান্ড কাঁদছে। আমরা সবাই আজ এক।’ এর আগে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বাণীর উদ্ধৃতি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পারস্পরিক উদারতা, সমবেদনা এবং সহানুভূতিতে বিশ্বাসীরা একটি শরীরের মতো। যখন শরীরের কোনো একটি অংশ ব্যথা পায় তখন পুরো শরীরই সেই ব্যথা অনুভব করতে পারে।’ মাত্র ৩০ সেকেন্ডের এ বক্তব্যে শান্তির পথ দেখালেন তিনি। নিউজিল্যান্ড হেরাল্ডের খবরে বলা হয়, জুমার নামাজের সময় হ্যাগলি পার্কের এই সমাবেশে জড়ো হয়েছিল প্রায় দশ হাজার মানুষ। মুসলমান রীতিতে কালো কাপড়ে মাথা ঢেকে উপস্থিত ছিলেন জাসিন্দা। এরপরই প্রচারিত হয় জুমার আজান। আজানের পরপরই দুই মিনিটের নীরবতায় স্তব্ধ হয় পুরো নিউজিল্যান্ড। খুতবার শুরুতে সন্ত্রাসী হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া ইমাম জামাল ফৌদা বলেন, ‘গত শুক্রবার আমি এ মসজিদে দাঁড়িয়েছিলাম। উগ্র এক সন্ত্রাসীর চোখে-মুখে ঘৃণা ও ক্ষোভ দেখেছি। এতে ৫০ জন মানুষ নিহত হয়েছেন। বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মানুষের মন ভেঙে গেছে। আজ সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে যখন চারপাশে তাকিয়েছি, তখন নিউজিল্যান্ড ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা হাজার হাজার মানুষের চোখে ভালোবাসা ও সহানুভূতি দেখেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘সন্ত্রাসী আমাদের দেশকে তার অশুভ মতাদর্শ দিয়ে বিভক্ত করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তার বদলে আমরা তাকে দেখিয়ে দিতে পেরেছি যে, নিউজিল্যান্ড ভেঙে টুকরো হয়ে যায়নি। বরং বিশ্ব আমাদের ভালোবাসা আর ঐক্যের উদাহরণ হিসেবে দেখছে। আমাদের মন ভেঙে গেছে, কিন্তু আমরা ভেঙে পড়িনি। আমরা ঐক্যবদ্ধ ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যে, কেউ আমাদের বিভক্ত করতে পারবে না। আমাদের শহীদদের কারণে আমরা নিউজিল্যান্ডে নতুন জীবন পেয়েছি।’ এরপর প্রধানমন্ত্রী জাসিন্দাকে মুসলমানদের পাশে থাকায় ধন্যবাদ জানান ইমাম। তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। তার নেতৃত্বকে সাধুবাদ জানাই। এটা বিশ্ব নেতাদের জন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে। ধন্যবাদ আমাদের প্রতি সংহতি জানাতে তার হিজাব পরার জন্য।’ এ সময় ক্যামেরা গিয়ে পড়ে জাসিন্দার দিকে। তিনি বুকে হাত দিয়ে ধন্যবাদ গ্রহণ করেন। তার চোখ ছিল ছলছল। গত সপ্তাহের হামলার পর থেকে প্রতিদিনই সব ধর্মের নানা বয়সী মানুষ ফুল হাতে ওই মসজিদের বাইরে আসছিল সংহতি জানাতে। মাওরি আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী রণনৃত্য হাকা পরিবেশন করে শ্রদ্ধা আর সংহতি জানাচ্ছিল শিক্ষার্থীরা। ইমাম ফৌদা তাদের প্রতিও ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘ধন্যবাদ তোমাদের হাকার জন্য, ধন্যবাদ ফুলের জন্য, তোমাদের চোখের পানি ও ভালোবাসার জন্য।’ শ্রদ্ধা জানানোর এই আনুষ্ঠানিকতায় অকল্যান্ডের চারটি মসজিদ শুক্রবার বিকাল ৫টা থেকে ৮টা পর্যন্ত সব ধর্মের মানুষের জন্য খোলা রাখা হয়। সন্ধ্যায় অকল্যান্ডের সবচেয়ে পুরনো পার্ক অকল্যান্ড ডোমেইনে প্রদীপ প্রজ্বালন করা হয়। হিজাব পরে মুসলমানদের প্রতি সংহতি নারীদের : আতঙ্কগ্রস্ত মুসলমানদের প্রতি সংহতি ও সমর্থন জানাতে শুক্রবার নিউজিল্যান্ডজুড়ে হাজারও নারী হিজাব পরে বের হন। রয়টার্স জানায়, তারপর থেকে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হতে পারেন এমন আতঙ্কে দেশটির মুসলমান নারীরা হিজাব পরে ঘর থেকে বাইরে বের হতে ভয় পাচ্ছেন। বিষয়টি জানতে পেরে অকল্যান্ডের চিকিৎসক থায়া অ্যাশম্যান ‘হেডস্কার্ফ ফর হারমনি’ নামে একটি আন্দোলনের ডাক দেন। নিউজিল্যান্ডের জনগণকে মুসলমানদের প্রতি সমর্থন জানাতে শুক্রবার মাথা ঢেকে বাইরে বের হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। অ্যাশম্যান বলেন, ‘আমি বলতে চেয়েছি, আমরা আপনার সঙ্গেই আছি। আমরা চাই আপনার নিজের রাস্তায় আপনি বাড়ির মতো নিরাপদবোধ করুন। আমরা আপনাকে ভালোবাসি, সমর্থন করি ও সম্মান করি।’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারীরা স্কার্ফ দিয়ে মাথা ঢাকা ছবি পোস্ট করেন। ক্রাইস্টচার্চের বাসিন্দা বেলি সিবলি বলেন, ‘কেন আমি আজ মাথা ঢেকেছি? প্রথম কারণ হচ্ছে, যদি আজ কেউ বন্দুক তুলে কাউকে নিশানা করে তবে আমি তাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে যাব। আমি চাই সে যেন পার্থক্য করতে না পারে। কারণ আমাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।’ ক্রাইস্টচার্চে দুই বাংলাদেশির দাফন : শুক্রবার জুমার নামাজের পর একসঙ্গে ২৬ মরদেহের জানাজা সম্পন্ন হয়। বাংলাদেশি পাঁচজনের মধ্যে দু’জনের দাফন ক্রাইস্টচার্চেই সম্পন্ন হয়েছে। তারা হলেন- সিলেটের ফরিদ আহমেদের স্ত্রী গোলাপগঞ্জের হুসনে আরা আহমেদ (৪২) ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ড. আবদুস সামাদ (৬৬)। নিউজিল্যান্ডের অনারারি কনসাল শফিকুর রহমান ভুঁইয়া এ তথ্য জানিয়েছেন। নিহত বাকি তিনজনের মরদেহ দেশে আনা হবে। তারা হলেন- চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলার মোজাম্মেল হক (৩০) ও নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার ওমর ফারুক (৩৫) এবং নরসিংদীর জাকারিয়া ভুঁইয়া (৩৬)। ইসলামবিদ্বেষের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ডাক এরদোগানের : ক্রমবর্ধমান ইসলামবিদ্বেষের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক লড়াইয়ের আহ্বান জানিয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোগান। শুক্রবার ইস্তানবুলে ইসলামী সহযোগী সংস্থাভুক্ত (ওআইসি) দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের এক বৈঠকে এ আহ্বান জানান তিনি। এরদোগান বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গণহত্যার (হলোকাস্ট) পর ইহুদি বিদ্বেষের বিরুদ্ধে যেভাবে লড়াই হয়েছে, ঠিক সেভাবেই মুসলিম বিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। ক্রাইস্টচার্চে হামলার পর জরুরি এ বৈঠক ডাকেন এরদোগান। বৈঠকে নিউজিল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইনস্টন পেটারস বলেন, বিশেষভাবে মুসলিম সম্প্রদায়কে নিরাপত্তা ও সুরক্ষার নিশ্চয়তা দিয়েছি। মুসলমানদের প্রতি সংহতি প্রকাশের জন্য নিউজিল্যান্ডের প্রশংসা করেছেন তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুট কাভুসগলু। তিনি বলেন, বিশ্বজুড়ে ইসলামবিদ্বেষী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান। আমরা এখানে সেটিই দেখাতে চাই।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

19 − nine =