বহদ্দারহাটে আব্দুস সবুর নামে এক নৈশপ্রহরীকে ছুরিকাঘাতে হত্যার ঘটনায় চার কিশোরের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে সিআইডির তদন্ত দল। ঘটনায় জড়িত মূল আসামিদের ‘বড় ভাই’ হিসেবে চান্দগাঁও এলাকার এক নেতা রয়েছেন।
সম্প্রতি বন্দরনগরী চট্টগ্রামে রাজনৈতিক নেতার ছায়ায় থেকে ‘গ্যাং লিডার’ ও ‘বড় ভাই’ কালচারের খারাপ ফল হিসেবে প্রতিনিয়ত ঘটছে মারামারি ও খুন-খারাবি। নগরীর পাড়া-মহল্লা ও অলিগলিতে এসব বড় ভাইয়ের দাপট। গত ৯ এপ্রিল বাকলিয়া থানা এলাকায় কথিত ‘বড় ভাই’ মোহাম্মদ সাইফুলের বন্দুকযুদ্ধে মারা যাওয়ার ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে নগরীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শতাধিক ‘বড় ভাই’। সাইফুলের মৃত্যুতে একই গ্রুপের অন্য বড় ভাইদের মধ্যেও আতঙ্ক ভর করেছে। আতঙ্কে অধিকাংশ গা ঢাকা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশের কর্তাব্যক্তিরা। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এলাকার কথিত বড় ভাইয়েরা নিজেদের বেপরোয়া চলাচল অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করেছে। নগরীতে রেপরোয়া ‘বড় ভাই’ কালচারে সাইফুল ‘মেসেজ’ ভয় ধরাতে পেরেছে বলে জানিয়েছেন সিএমপির সহকারী কমিশনার কাজী শাহাবুদ্দিন আহমেদ। এদিকে, এসব বড় ভাইয়ের কর্মকাণ্ডে তাদের দাপটের সীমারেখা টানা কঠিন। শহরময় তাদের দাপট। স্ব স্ব এলাকায় আধিপত্য ধরে রাখাটাই তাদের প্রধান কাজ। এ রকম কমপক্ষে শতাধিক দাপুটে গ্রুপ নগরের অলিগলি, পাড়া-মহল্লা নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের মাথার উপর রয়েছে রাজনৈতিক বড় ভাইদের হাত। যেখানে তারা গড়ে তুলেছেন সন্ত্রাসের সাম্রাজ্য। এ সাম্রাজ্যে কেউ চ্যালেঞ্জ ছুঁড়লেই তাকে মৃত্যুর দুয়ারে ঠেলে দেওয়া হয়। রাজনৈতিক দলকেন্দ্রিক এসব গ্রুপ অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রেমঘটিত ব্যাপার নিয়েও মারামারি ও খুনখারাবিতে জড়ায়। এর সর্বশেষ প্রমাণ সাইফুল। প্রসঙ্গত, নগরীতে ঘটে যাওয়া কয়েকটি হত্যার ঘটনায় বড় ভাইয়েরর নাম সামনে এসেছে। যারা বিভিন্ন সময় নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত থেকে আলোচনায় এসেছে। এসব ঘটনার পর প্রভাবশালী বড় ভাইয়েরা আত্মগোপনে গেলেও কর্মকাণ্ড থামে না। পরিস্থিতি সামলে গেলে আবারও নানা এলাকায় সক্রিয় হয়ে ওঠে তারা। পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, নগরীর সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্কুলে বিভিন্ন নামে কিশোর গ্যাং গড়ে উঠছে। গ্রুপে থাকে ১৫-২০ জন করে। এসব গ্যাং আবার নিয়ন্ত্রণ করে পার্শ্ববর্তী এলাকার বড় ভাইয়েরা। একই অবস্থা নগরীর কলেজগুলোতেও। সিএমপির তথ্য অনুযায়ী, সন্ধ্যার পরে স্টেশন রোড, বিআরটিসি মোড়, কদমতলী, চকবাজার, মেডিকেল হোস্টেল, শিল্পকলা একাডেমি, সিআরবি, খুলশি, ফয়’স লেক, ঢেবারপাড়, চান্দগাঁও শমসের পাড়া, ফরিদের পাড়া, আগ্রাবাদ সিজিএস কলোনি, সিডিএ, ছোটপুল, হালিশহর, বন্দর কলোনি ও পতেঙ্গার বেশ কয়েকটি এলাকা, জামালখান, চকবাজার, জিইসি মোড়, কাজীর দেউড়ি, সিআরবি, বিভিন্ন এলাকায় কথিত বড় ভাইদের দাপট। এ ব্যাপারে সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন বলেন, বড় ভাই কালচার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। সেই সাথে সাংস্কৃতিক ও আদর্শিক চর্চার ওপর জোর বাড়ানোর মধ্য দিয়ে এর প্রতিকার সম্ভব। বাকলিয়া থানার ওসি প্রণব চৌধুরী বলেন, সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় এনে অপরাধ প্রবণতা কমানোর চেষ্টায় আছে পুলিশ। অপরাধীদের কোনো ছাড় নয়। নৈশপ্রহরী হত্যায় জড়িত ৪ কিশোর , অপরাধীরা চিহ্নিত গত ২১ ফেব্রুয়ারি বহদ্দারহাটে আব্দুস সবুর নামে এক নৈশপ্রহরীকে ছুরিকাঘাতে হত্যার চান্দগাঁও থানা পুলিশ ঘুরে গত ২৭ মার্চ মামলাটি সিআইডির হাতে আসে। এ ঘটনায় চার কিশোরের জড়িত থাকার চাঞ্চল্যকর এমন তথ্য প্রমাণ পেয়েছে সিআইডির তদন্ত দল। তাদের পরিচয়ও জানা গেছে। তবে, এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় আসামি হিসেবে তাদের কারোর নাম নেই। এ ব্যাপারে সিআইডির পরিদর্শক ও মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ শরীফ বলেন, এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় চার কিশোর জড়িত রয়েছে। সেই ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে মামলার এজাহারে তাদের নাম নেই। তিনি বলেন, খুনিদের নাম-ঠিকানা পাওয়া গেছে। তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। তদন্তের স্বার্থে এখন নাম বলা যাচ্ছে না। সংগৃহীত সিসিটিভির ফুটেজেও চার কিশোরের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে জানান তিনি। মামলার এজাহারে আসামি হিসেবে যাদের নাম রয়েছে তারা ছুরিকাঘাতের ঘটনায় জড়িত ছিল না বলে তিনি দাবি করেন। এদিকে, সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, ছুরিকাঘাতের ঘটনাটি রাস্তার পাশে হক মার্কেটের মূল গেটের সামনে ঘটেছে। ঘটনার রাতে মার্কেটের গেটের সামনে গিয়ে চার কিশোরকে তাড়িয়ে দেন সবুর। এদের বয়স আনুমানিক ১৫/১৬ বছর। ঘটনার দিন ভোর রাত ৩টা ৫৮ মিনিটে তাদের তাড়িয়ে দিয়ে মার্কেটে প্রবেশকালে চারজনের মধ্যে একজন এগিয়ে এসে পেছন থেকে সবুরকে ছুরি মারে। এ সময় সবুর ঘুরে দাঁড়িয়ে হাতাহাতির সময় পেটে আবার ছুরিকাঘাত করে ওই কিশোর। পরে ছুরিকাঘাতকারী ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। সবুরও বাঁ হাত দিয়ে পেট চেপে ধরে মার্কেটের ভেতর চলে আসেন। এ সময় রাস্তায় গাড়ির চলাচল ছিল। পরে ঘটনার বিষয়টি মার্কেটের ভেতর ঘুমিয়ে থাকা আরেক নিরাপত্তা রক্ষীকে জানান। তাদের মধ্যে এ নিয়ে কয়েক মিনিট কথা হয়। তখনো তাকে স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল। পরে ওই নৈশপ্রহরী পকেট থেকে মোবাইল বের করে ঘটনার বিষয়টি কাউকে জানান। এভাবে ছুরিকাঘাতের পর প্রায় এক ঘণ্টা সবুর মার্কেটের ভেতর পায়চারি করছিলেন বলে জানান সিআইডির কর্মকর্তা মোহাম্মদ শরীফ। তিনি বলেন, ছুরিকাঘাতের ঘটনাটি ছিল মার্ডারের পর্যায়ের। ওই নৈশপ্রহরীকে তাৎক্ষণিক হাসপাতালে নিয়ে গেলে তিনি বেঁচে যেতেন। জড়িতরা শীঘ্রই গ্রেপ্তার হচ্ছে বলে জানান তিনি। উল্লেখ্য, নৈশপ্রহরী সবুর তিনি চান্দগাঁও থানাধীন উত্তর মোহরার আব্দুল মোনাফের ছেলে। এ ঘটনায় নিহতের স্ত্রী ছখিনা বেগম বাদী হয়ে চান্দগাঁও থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় মার্কেটের মালিক, কর্মকর্তাসহ আটজনকে আসামি করা হয়। এদিকে, চান্দগাঁও থানার ওসি আবুল বশর বলেন, ছুরিকাঘাতের ঘটনায় কোনো প্রত্যক্ষদর্শী ছিল না। এ ঘটনায় বাদী যাদের নাম বলেছে তাদের নাম মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি বলেন, এ ঘটনায় একটি সিসিটিভি ফুটেজ উদ্ধার করা হয়েছে। সেখানে কয়েকজন কিশোরকে জড়িত থাকতে দেখা যায়। তাদের পরিচয় জানা যায়নি। ফুটেজটি সিআইডিকে দেওয়া হয়েছে। যেহেতু মামলাটি বর্তমানে সিআইডি তদন্ত করছে, তারাই জড়িতদের চিহ্নিত করে খুঁজে বের করবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ঘটনায় জড়িত মূল আসামিদের ‘বড় ভাই’ হিসেবে চান্দগাঁও এলাকার এক যুবলীগ নেতা রয়েছেন। এতে কৌশলে মামলার মূল আসামিদের বাদ দিয়ে বিভিন্নজনকে আসামি করা হয়েছে। এ ঘটনার পর থানা পুলিশের তদন্তে আস্থা না পেয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতনরা মামলাটির তদন্তভার সিআইডিকে হস্তান্তর করেন। পরে সিআইডি তদন্ত চালিয়ে জড়িত চার কিশোরকে চিহ্নিত করার পাশাপাশি তাদের নাম-ঠিকানা পেয়েছে বলে জানায় তদন্ত সূত্র।