গণহত্যা দিবসের স্মরণসভায় বক্তারা-‌‌পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালীরা এখনো বৈষম্য এবং অবহেলার শিকার

0
646

স্টাফ রিপোর্টার: পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিরা এখনো চরম বৈষম্য এবং অবহেলার শিকার। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যে সবকিছুতেই বাঙালিদের কে পার্বত্য শান্তিচুক্তির মাধ্যমে পিছিয়ে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। বক্তারা অবিলম্বে পার্বত্য জেলা পরিষদে নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন। গতকাল সোমবার রাজধানীর শিশুকল্যাণ পরিষদের মিলনায়তনে পার্বত্য নাগরিক পরিষদের উদ্যোগে “১৯৮৬ সালের ২৯ এপ্রিল তাইন্দং এবং পানছড়ির গণহত্যা দিবস” উপলক্ষে আয়োজিত এক স্মরণসভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। সংগঠনের চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার আলকাছ আল মামুন ভুঁইয়ার সভাপতিত্বে বাঘাইছড়ি পৌরসভার সাবেক মেয়র মো: আলমগীর কবিরের সঞ্চালনায় আয়োজিত স্মরণসভায় প্রধান অতিথি অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন, সাবেক বিচারপতি ও পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান খাদিমুল ইসলাম চৌধুরী। অনুষ্ঠানে আরও স্মৃতিচারণ করেন, বান্দরবান জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সাবেক পার্বত্য বান্দরবান জেলা পরিষদের সদস্য কাজী মুজিবুর রহমান, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমাধিকার আন্দোলনের মহাসচিব মনিরুজ্জামান মনির, পার্বত্য নাগরিক পরিষদের কেন্দ্রীয় মহাসচিব এড.এয়াকুব আলী চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক মো: আবদুল হামিদ রানা, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির নেতা শহিদুল আলম তামান্না, পিবিসিপির সাবেক সিনিয়র সহ সভাপতি মো: তৌহিদুল ইসলাম,ছাদেক, ফয়েজ উদ্দিন আহমেদ, পার্বত্য বাঙালি ছাত্র পরিষদের সাবেক কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার সাহাদাত ফরাজি সাকিব,জালাল আহমেদ, মিনহাজ তকি প্রমুখ।

 

সাবেক বিচারপতি, পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান খাদিমুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের ডাকে আমি যে কোন সময় সাড়া দিবো। আপনারা আমাকে ডাকলেই পাবেন। পার্বত্যচট্টগ্রাম চুক্তি করা হয়েছে মূলত ভারতে নির্বাসিত উপজাতিদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য। তখন ভারতকে কূটনীতিকভাবে বিভিন্ন চাপ প্রয়োগ করা হয়েছিল।

বান্দরবান জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সাবেক পার্বত্য বান্দরবান জেলা পরিষদের সদস্য কাজী মুজিবুর রহমান বলেন, পার্বত্য জেলাপরিষদে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি না থাকায় সেখানে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নেই। যখন যে দল ক্ষমতায় আসে, তখন সে দলের নেতারা জেলা পরিষদকে লুটেপুটে খায়। জনগণের অধিকার সংরক্ষণের জন্য এসব মনোনীত নেতারা কিছুই করে না। তিনি আরো বলেন, দীর্ঘ ১৮বছর ধরে বান্দরবান জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করলেও এমপি পদে মনোনয়ন পায়নি। কারণ আমি বাঙালি। বাঙালি হওয়ার কারণে আমি বৈষম্যের শিকার। পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও তারা আজ পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির কারণে চরম বৈষম্য এবং অবহেলার শিকার। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসনিক গুরুত্বপূর্ণ পদ গুলো উপজাতিদের দখলে। সরকারি চাকরি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা-বাণিজ্যে বাঙালিরা চরম বৈষম্য এবং অবহেলার শিকার।

পার্বত্য চট্টগ্রাম সমাধিকার আন্দোলনের মহাসচিব মনিরুজ্জামান মনির বলেন, দীর্ঘদিন ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিরা হত্যা, নির্যাতন,জেল-জুলুম, মামলা হামলার শিকার। ১৯৮৬ সালের ভয়াল ২৯ এপ্রিল তার অনন্য দৃষ্টান্ত। পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের খুনি সন্তু লারমা সহ সমস্ত খুনিদেরকে পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি খুনের বিচার আজ পর্যন্ত হয় নি। কিছু অকেজো অস্ত্র জমা দেওয়া হলেও ভারী অস্ত্রশস্ত্র এখনো উপজাতিদের কাছে রয়ে গেছে।অবিলম্বে পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্ত্র উদ্ধার অভিযান চালাতে হবে।

সভাপতির বক্তব্যে পার্বত্য নাগরিক পরিষদের চেয়ারম্যান আলকাছ আল মামুন ভূঁইয়া বলেন, আজ এদিনে আমাদের দাবি হল: ২৯শে এপ্রিলে নিহত শহীদদের স্বরণে তাইন্দং এ একটি শহীদ মিনার র্নিমান করে সেখানে শহীদদের নামের লিষ্ট টানিয়ে তা সংরক্ষন করা, শহীদদের প্রতি পরিবার কে ১০ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেয়া এবং ২৯শে এপ্রিলে হত্যাকান্ডের জন্য সরকার বাদী হয়ে একটি মামলা করা এবং এর সুষ্ঠু তদন্তের জন্য একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি দ্বারা তদন্ত করে তথাকথিত শান্তিবাহিণীর সদস্যদের দৃষ্টান্ত মূলক বিচার এবং নির্দেশ দাতা হিসেবে সন্তু লার্মা, প্রশিত খীষা ও রাজাকার পুত্র ব্যারিষ্টার দেবাশীষকে গ্রেফতার পূর্বক ফাঁসী দেয়া।এসব সন্ত্রাসীদের উস্কানীদাতা হিসেবে বাসন্তি চাকমাকে সংসদথেকে প্রত্যাহার করা ,পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যাহার কৃত সকল সেনাক্যাম্প পুনঃস্থাপন করা,যৌথ বাহিনীর মাধ্যমে অস্র উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করা সহ পার্বত্য নাগরিক পরিষদের নিন্মোক্ত ৮ দফা দাবী মেনে নেয়ার আহবান জানান। পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল বাঙালিদেরকে অধিকার আদায়ের জন্য সংগঠিত হওয়ার আহবান জানান।

পার্বত্য নাগরিক পরিষদের সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার আলকাছ আল মামুন ভূঁইয়া আলোকিত পাহাড়কে বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশের ভূখন্ডে পার্বত্য বাঙ্গালীরা আজও অসহায় দিন যাপন করছে। শান্তিচুক্তির মাধ্যমে জেএসএস অস্ত্র জমা দিলেও পাহাড়ে তাদের শাখা- প্রশাখা গুলোর সশস্ত্র কার্যক্রম চলছে। তাদের হাতে প্রতিনিয়ত গুম, খুন অপহরণ, ধর্ষণ, চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছে বাঙ্গালীরা। দেশের স্বাধীনতা ও মানবতা বিরুধীদের মতো বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে, তাইন্দং, পানছড়ি গণহত্যাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩০ হাজার বাঙ্গালীর খুনি শান্তিবাহিনী তথা সন্তু লারমার বিচার করতে সরকারের প্রতি আহবান জানান তিনি।

সভায় বক্তারা বলেন, ২৯শে এপ্রিল পানছড়ি গণহত্য দিবস পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে একটি কলঙ্কিত দিন। ১৯৮৬ সালের এই দিনে পানছড়িতে বসবাসরত বাঙালির জীবনে নেমে আসে নৃশংস, বীভৎস, ভয়ঙ্কর ও বিভীষিকাময় এক কালরাত্রি। রাত আনুমানিক ৯টায় বর্বর শান্তি বাহিনী নিরস্ত্র নিরিহ শান্তিপ্রিয় বাঙালির ওপর হিংস্র দানবের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সেদিন পার্বত্যবাসী প্রত্যক্ষ করেছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসের এক নৃশংস বর্বরতা। ঘটনার ৩৩ বছর অতিবাহিত হলেও কোন বিচার পায়নি স্বজনহারানো পরিবার গুলো।

বক্তারা আরও বলেন, ৬হাজার ২শত ৪০টি বাড়ি সম্পূর্ন ভাবে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এতে গৃহহীন হয়ে পড়ে হাজার হাজার পরিবার। সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন শান্তি বাহিনী‘র গেরিলা যোদ্ধারা সেই হামলায় এত গুলো মানুষকে হত্যা করতে একটি বুলেটও ব্যবহার করেনি। হাত-পা বেঁধে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে, দা দিয়ে নির্মমভাবে কুপিয়ে, জবাই করে, আগুনে পুড়িয়ে, শিশুদেরকে পায়ে ধরে গাছের সাথে বাড়ি দিয়ে, বেনেট ও অন্যান্য দেশি অস্ত্র দিয়ে খোঁচিয়ে খোঁচিয়ে হত্যা করেছিল। প্রতিটি লাশকেই বিকৃত করে সে দিন চরম অমানবিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল শান্তি বাহিনীর সন্ত্রাসীরা। ঘটনাটি যারা স্ব-চোখে খে দেখেছে বা বেচে যাওয়া কিছু কিছু সাক্ষী আজো আছে, কিন্তু ঘটনার কথা মনে পড়লে আজও তারা শিউরে উঠে।

উল্লেখ্য যে, ১৯৮৬ সালের ২৯শে এপ্রিল দিবাগত রাঁত আনুমানি ৯টা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত মোট ৪ঘন্টা ব্যাপী খাগড়াছড়ি জেলার সীমান্তবর্তী পানছড়ি উপজেলা‘র ১নং লোগাং ইউনিয়ন, ৩নং পানছড়ি সদর ইউনিয়ন ও ৪নং লতিবান ইউনিয়ন (বর্তমানে ৫নং উল্টাছড়ি ইউপি)‘র বাঙ্গালি গ্রামে অগ্নি সংযোগসহ নির্বাচারে গণহত্যা চালায়। শিশু, কিশোর, নারী, পুরুষ, আবাল, বৃদ্ধ, বনিতা যাকে যেখানে পেয়েছে তাকে সেখানেই হত্যা করেছে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্রগ্রাম জন সংহতি সমিতি (জেএসএস)‘র অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা। তৎ সময়ে বে-সরকারী হিসাবে মাত্র ৪ঘন্টা সময়ে নিরস্ত্র ও নিরীহ ৮শত ৫৩ জন বাঙ্গালীকে হত্যা করা হয়েছে, আহত করা হয়েছে প্রায় ৫শত জনকে, অপহরণ ও গুম করা হয়েছে আরো কয়েক হাজার বাঙ্গালীকে।

পানছড়ি গণহত্যা ছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে উপজাতি এসব সন্ত্রাসীদের দ্বারা বিভিন্ন গণহত্যা সংঘটিত হয়। এসব গণহত্যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য লংগদু গণহত্যা, ১৯৭৯ কাউখালি গণহত্যা, বেতছড়ি গণহত্যা, বানরাইবারী, বেলতলী, বেলছড়ি গণহত্যা, তাইন্দং, আচালং, গৌরাঙ্গ পাড়া, দেওয়ান বাজার, তবলছড়ি, বর্ণাল, রামছিরা, গোমতি গণহত্যা,গোলকপতিমা ছড়া, মাইচ্যেছড়া, তারাবনছড়ি গণহত্যা, ভূষণছড়া গণহত্যা, দিঘীনালা গণহত্যা, ২৯ এপ্রিল ১৯৮৬, মাটিরাংগা গণহত্যা, কুমিলাটিলা, শুকনাছড়ি, দেওয়ান বাজার, সিংহপাড়া, তাইন্দং গণহত্যা, দিঘীনালা গণহত্যা, ২ জুলাই ১৯৮৬, ভাইবোন ছাড়া গণহত্যা, হিরাচর, বটতলী, খাগড়াছড়ি, পাবলাখালী গনহত্যা, লংগদু গনহত্যা ১৯৮৯, নাইক্ষ্যাছড়ি গণহত্যা, মাল্যে গনহত্যা, লোগাং গনহত্যা, নানিয়ারচর গনহত্যা, পাকুয়াখালী গণহত্যা, জুরাইছড়ি গণহত্যা। জেএসএস’র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের রাংগামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান নিয়ে পৃথক রাষ্ট্র গঠন করা। সে ষড়যন্ত্র থেকে তারা হত্যা করে এদেশের খ্যাতিমান সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সিপাহী পর্যন্ত প্রায় ২৫৬ জন বীর সেনাকে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

ten + ten =