দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও খাদ্যে ভেজালরোধ করতে বিভিন্নস্থানে অভিযান

0
1374

রমজানে যে কোন মূল্যে জনগণকে স্বস্তি দিতে বদ্ধপরিকর সরকার। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও খাদ্যে ভেজালরোধ করতে রমজানের প্রথম দিন থেকেই বিভিন্নস্থানে অভিযান চালিয়েছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। গত কয়েকদিন সতর্কতামূলক বার্তা দেয়ার পর প্রথম দিন থেকেই বিভিন্ন মনিটরিং টিম কাজ করছে।

 

সরকারের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে যারা অতি মুনাফা অর্জনে খাদ্যে ভেজাল ও মূল্য কারসাজির মাধ্যমে বৃদ্ধির পাঁয়তারা করছে তাদের বিরুদ্ধে এ্যাকশনে যেতে শুরু করেছে। খাদ্যে ভেজাল ও রমজানে মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে জিরো টলারেন্সে সরকার। ইতোমধ্যেই বিভিন্ন সংস্থা জরিমানা করছে অসাধু প্রতিষ্ঠানগুলোকে। আগামী দিনগুলোতেও এই ধারাবাহিকতা থাকবে। অসৎ ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে সরকারের এই আগাম সতর্কতা বার্তা ও রমজানের শুরু থেকেই ব্যবস্থা গ্রহণ নিয়ে খুশি সাধারণ মানুষ। রমজান নিয়ে ইতোমধ্যেই নানা ধরনের অভিযানের মধ্যে অনেকটা আতঙ্কের মধ্যেই রয়েছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। হঠাৎ করেই বিভিন্ন সংস্থার অভিযান নিয়ে অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা তটস্থ থাকছেন সবসময়। আর সাধারণ মানুষ সরকারের এই উদ্যোগের প্রশংসা করে বলেছেন পুরো মাসটা এভাবেই অভিযান চলুক আর একটু স্বস্তির কথা। জানা গেছে, আসন্ন রমজানে নিত্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে কয়েকটি সংস্থাকে বাজার তদারকির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে বাজারে খাদ্যপণ্যে বিশেষ করে ইফতারে কেউ যেন ভেজাল দিতে না পারে সে জন্য বিভিন্ন সংস্থা তদারকি কার্যক্রম চালু রাখার সিদ্ধান্ত হয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছেন, বিএসটিআই, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, সিটি কর্পোরেশনের বাজার মনিটরিং সেল, জেলা প্রশাসন বাজার মনিটরিং করবে। খুচরা বাজার থেকে শুরু করে দেশের পাইকারি ও মোকামগুলোয় অভিযান চালাবে, যাতে রমজানকে পুঁজি করে কারসাজির মাধ্যমে কেউ অতি মুনাফা লুটতে না পারে। সেই সঙ্গে এসব বাজার নজরদারি করা হবে বলে জানা গেছে। ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) কমমূল্যে বাজারে পণ্য বিক্রি করে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করবে। এর বাইরেও র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত, কৃষি বিপণন অধিদফতর ও পুলিশ বাহিনী ভ্রাম্যমাণ টিম কাজ করছে বলেও জানা গেছে। উদ্যোগটি প্রশংসা করছে সাধারণ মানুষও। শুরু থেকেই বিভিন্ন সংস্থা তদারকি শুরু করেছে বলে আরও বেশি আশাবাদী হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষ। সরকারের একাধিক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, প্রতি রমজানে নানামুখী কথা হয় তবে সাধারণ মানুষের নাভিশ^াস ওঠে। সরকারের উর্ধতন মহল এবার শুরু থেকেই এ বিষয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। বাজারে পণ্যের ঘাটাতিও নেই। যে কোন মূল্যে জনগণকে স্বস্তি দিতে চায়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, গত মার্চের শেষে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির রমজান মূল্য পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠকের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ রাখার বিষয়টি সামনে চলে আসে। এর পরে এপ্রিল পুরো মাসই বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে এ বিষয়ে একাধিক বৈঠক করে মূল্য না বাড়াতে এবং খাদ্যে ভেজালরোধ করতে নানা বার্তা দেয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে। এ ছাড়াও ধারাবাহিক রুটিন ওয়ার্ক হিসেবে নিয়মিতই বাজার তদারকি করছিল বিভিন্ন সংস্থা। রমাজনের প্রথম দিন থেকে অভিযানের বিষয়টি আরও বেশি দৃশ্যমান। এদিকে, রমজানের প্রথম দিনই বাজারে অভিযান চালিয়েছে কয়েকটি সংস্থা। র‌্যাব, জাতীয় ভোক্তা অধিকার, বিএসটিআই এবং সিটি কর্পোরেশনের বাজার তদারকির বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে। এসব সংস্থার কার্যক্রমে সাধারণ মানুষ এবার রমজানে বাজার নিয়ন্ত্রণে থাকা নিয়ে বেশ আশাবাদী হয়ে উঠেছে। এদিকে রমজানের শুরুতেই অভিযান চালিয়েছে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। কামরাঙ্গিরচর এলকায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালায় সংস্থাটি। এ সময় উৎসুক মানুষের মধ্যে বেশ সাড়া পাওয়া যায় অভিযান নিয়ে। সংস্থাটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মাহফুজুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের এই মুহূর্তে দুটি টিম প্রতিদিনই অভিযানে কাজ করছে। সামনে আরও দুটি ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনে দুটি টিম যুক্ত হবে। আমরা যেকোন মূল্যে জনগণকে স্বস্তি দিতে চাই। সেটা বাজারের দ্রব্যমূল্য হোক বা খাদ্যে ভেজাল। আমাদের টিম সব বিষয়েই কাজ করবে। খাদ্য কর্তৃপক্ষের মতো প্রথম রমজানে পুরান ঢাকায় অভিযান চালায় র‌্যাব। ভেজালবিরোধী সাঁড়াশি অভিযানে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে গঠিত স্পেশাল টাক্সফোর্স। প্রথম রোজায় চালানো র‌্যাবের অভিযানে আড়াই শ’ মণ পচা খেজুর জব্দ হয়েছে। এবার তাৎক্ষণিক তথ্যের ভিত্তিতেও ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালাতে পারবে। শুধু বাজারে নয়, সরাসরি গোডাউনেও অভিযান চলবে। আর ঢাকার খ্যাতিমান ইফতার বাজারে এবার চব্বিশ ঘণ্টা গোয়েন্দা নজরদারির ব্যবস্থা করা হয়েছে। আবার কোন এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তরফ থেকে গোপনে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এবার খাদ্যে ভেজালকারীদের ন্যূনতম ছাড় দেয়া হবে না। জরিমানা দিয়ে পার পাওয়ার পর আবার ভেজাল খাদ্য তৈরি করায় এবার জরিমানার সঙ্গে ভেজালকারীকে জেল দেয়া হবে। পহেলা রমজানে মঙ্গলবার দুপুর একটার দিকে বিএসটিআই ও র‌্যাব-৩ এর সহযোগিতায় ঢাকার বাদামতলীর খেজুরের আড়তে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালায়। অভিযানের নেতৃত্বদানকারী র‌্যাব সদর দফতরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম জানান, অভিযানে বিপুল পরিমাণ মেয়াদোত্তীর্ণ ও মানহীন খেজুর পাওয়া গেছে। স্বাভাবিক কারণেই পবিত্র মাহে রমজান উপলক্ষে সারাদেশে খেজুরের ব্যাপক চাহিদা থাকে। আর সেই চাহিদার সুযোগটিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে অসাধু ব্যবসায়ীরা। কারণ খেজুর হচ্ছে ইফতারের অন্যতম মূল উপাদান। এ সুযোগটাই নিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। তারা বাজারজাত করছে পচা ও মানহীন খেজুর। রমজানের আগেও পচা ও মেয়াদোত্তীর্ণ খেজুর মজুদ ও বিক্রির বিরুদ্ধে বাদামতলীতে অভিযান চালানো হয়েছিল। পুরো রমজানজুড়েই অভিযান চলবে। এবার খাদ্যে ভেজালকারীদের আর ছাড় দেয়া হবে না। জরিমানা দেয়া হলে টাকা পরিশোধ করে আবার ভেজাল ব্যবসায় নেমে পড়ে। এজন্য এবার জরিমানার পাশাপাশি জেল হাজতে পাঠানোর বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। যদিও সবই হবে আইন মোতাবেক। র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের উপ-পরিচালক মেজর রইসুল ইসলাম জনকণ্ঠকে জানান, এবার ভেজাল বিরোধী সাঁড়াশি অভিযান চালাতে আরও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা এসেছেন। এবারের অভিযান হবে অন্য যেকোন সময়ের তুলনায় আরও সাঁড়াশি। ইতোমধ্যেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এ ব্যাপারে যোগাযোগ হয়েছে। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ইফতারের বাজারগুলোতে এবার সর্বক্ষণিক মনিটরিং করার প্রযুুক্তিগত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আর তাৎক্ষণিক তথ্যের ভিত্তিতেও এবার কাছের ব্যাটালিয়ন অভিযান চালাতে পারবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, এবার চকবাজার, ধানম-ি, বেইলী রোড, গুলশান, বনানী, বারিধারা, উত্তরা কিংবা রাজধানীর যেকোন জায়গায় তাৎক্ষণিকভাবে হাজির হবেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা। এবার অভিযান চালানোর সুবিধার্থে অনেক সময় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাকে আবার সাদা পোশাকে হাজির হবেন। ফলে দেখে কারও বোঝার উপায় থাকবে না। আচমকা সব অভিযান চলবে। আশপাশের লোকজন বুঝে ওঠার আগেই জেল জরিমানা শেষ। এবার এদের সঙ্গে থাকছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বিএসটিআই, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের লোকজন। সবমিলিয়ে গঠিত টাক্সফোর্স পুরো রমজান মাসের বাজার মনিটরিং থেকে শুরু করে অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করবে। ভেজাল সন্ধানের পাশাপাশি চলবে বাজার মনিটরিং। খাদ্য সামগ্রী তৈরির পরিবেশ, খাবারের পরিমাণ, দাম, ওজনে কারচুপিসহ নানা বিষয় তদারকি করা হবে। পাশাপাশি মিথ্যা বিজ্ঞাপন প্রচারের বিষয়টি এবার নজরদারিতে আনা হচ্ছে। এবারও রমজানে ভেজালবিরোধী অভিযান চালাবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। ডিএমপির মিডিয়া বিভাগের উপ-কমিশনার মাসুদুর রহমান জানান, রমজানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও ইফতারে খাদ্য ভেজাল নিয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। সিদ্ধান্ত মোতাবেক রাজধানীতে ভেজালমুক্ত খাবার নিশ্চিতে ও খাবারে সব ধরনের ভেজাল প্রতিরোধে কাজ করবে পুলিশের ভ্রাম্যমাণ আদালত। বিএসটিআই জানায়, তারা ঢাকা ছাড়াও কেরানীগঞ্জ, গাজীপুর, সাভার, আশুলিয়া, ধামরাই, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন উপজেলায় অভিযান চালাবে। রমজান মাসে রোজাদাররা বিশেষ করে মুড়ি, খেজুর, কলা, সফট ড্রিংক পাউডার (ট্যাং, রাসনা) ইত্যাদি পানীয় ও খাবার খেয়ে থাকেন। বাজারে এগুলোর মান যাচাই করা হবে। অনেকে বিএসটিআইয়ের ভুয়া সিল দিয়ে নকল পণ্য তৈরি করছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বলেছেন, পবিত্র রমজান মাসে কোন ব্যবসায়ী যদি ইফতার সামগ্রীসহ খাদ্যে ভেজাল দেন কিংবা পচাবাসি খাবার বিক্রি করেন তাহলে তাকে কারাগারে ঈদ কাটাতে হতে পারে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। প্রথম রমজানে মঙ্গলবার পুরান ঢাকার চকবাজারের ঐতিহ্যবাহী ইফতার বাজার পরিদর্শনে এসে মেয়র বলেন, শুধু জরিমানা নয়, নিয়মিত আইনে কারাদ- দেয়া হবে অসাধু ব্যবসায়ীদের। ইফতার ও সেহরির খাবারের মান নিয়ন্ত্রণের পাঁচটি মনিটরিং টিমের কার্যক্রম উদ্বোধন করেন সাঈদ খোকন। ডিএসসিসি সূত্রে জানা গেছে, মেয়রের উদ্বোধন করা পাঁচটি মনিটরিং টিম বাজার নিয়ন্ত্রণে কাজ করবে। নিয়মিত বাজার মনিটরিং করবে। এই টিমে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ছাড়াও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি), নিরাপদ খাদ্য অধিদফতর এবং বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড এ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) প্রতিনিধিরা থাকবেন বলে জানা গেছে। এদিকে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর রাজধানীর চারটি পয়েন্টে অভিযান চালিয়েছে। অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, শুধু রমজানকে কেন্দ্র করে বাড়ানো হয়েছে মনিটরিং টিম। এর আগে প্রতি দিন দুটি করে টিমের কার্যক্রম পরিচালনা করা হলেও রমজানে প্রতিদিন চারটি করে টিম কাজ করবে। ফলে বেশি অভিযানে ব্যবসায়ীরাও যেমন সতর্ক সচেতন হবে সাধারণ মানুষও বেশি সেবা পাবে। এদিন অধিদফতরের কর্মকর্তা মোহাম্মদ জব্বার ম-লের নেতৃত্বে রাজধানীর খিলগাঁও এলাকায় অভিযান পরিচালনা করা হয়। রমজান আসার পূর্বে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ, বিপণন ও মূল্য পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। ওই প্রতিবেদনে ভোক্তাদের জন্য এ সুখবর দিয়ে আরও বলা হয়, রমজানের চাহিদাকে পুঁজি করে কেউ যাতে অস্বাভাবিকভাবে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করতে না পারে সে লক্ষ্যে বাজারের দিকে গোয়েন্দা সংস্থার তীক্ষè নজরদারি থাকবে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

4 × 5 =