বর্ষার বাবার দাঁত ভেঙে দিতে চেয়েছিলো মোহনপুরের ওসি

0
594

আত্মহত্যার আগেই পুলিশের কাছে ধর্ষণের মামলা করতে গিয়েছিলেন বর্ষার বাবা। কিন্তু মোহনপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হোসেন ধর্ষণ মামলা না নিয়ে বর্ষার পিতাকে পিটিয়ে দাঁত ভেঙে দেয়ার হুমকি দিয়েছিলো।

 

বাবার অপমান, অপহরণের মামলার আসামির স্বজনের হুমকি আর ধারাবাহিক অপমানের গ্লানি থেকে মুক্তির জন্য স্কুলছাত্রী সুমাইয়া আকতার বর্ষা গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। ওসি শুধু বর্ষার বাবার সঙ্গে খারাপ আচরণ করেই ক্ষান্ত হয়নি, বর্ষার পরিবারের সদস্যরা যাতে পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে যেতে না পারেন, সেজন্য বর্ষার পিতাকে পরপর চারদিন থানায় ডেকে গভীর রাত পর্যন্ত আটকে রেখে হয়রানি করে বলে অভিযোগ উঠেছে। এক পর্যায়ে সাবেক উপজেলা নির্বাহী অফিসারের (বর্তমানে এডিসি) মাধ্যমে জেলা পুলিশ সুপারের হস্তক্ষেপে ওসি অপহরণ মামলা রেকর্ড এবং দুই আসামিকে গ্রেফতারে বাধ্য হয় বলে জানা যায়। শনিবার বিকেলে স্থানীয় সাংবাদিকরা মোহনপুর উপজেলা সদরে আত্মহননের শিকার সুমাইয়া আক্তার বর্ষার বাড়িতে গেলে পরিবারের সদস্যরা এসব তথ্য জানান। তারা বলেন, ‘সঠিক সময়ে পুলিশ জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিলে বর্ষাকে হয়তো আত্মহনন করতে হতো না।’ বর্ষার বোন বলেন, ‘বাকশিমুল উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী বর্ষা স্কাউট দলের সেকেন্ড ক্যাপ্টেন ছিল। স্কুলে যাতায়াতের পথে প্রায় ৬ মাস ধরে তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে আসছিল পাশের বাড়ির আনিস উদ্দিনের ছেলে মুকুল। তার প্রস্তাবে সাড়া না দিয়ে বিষয়টি বর্ষা বাড়িতে জানিয়েছিল। তারা উপজেলা নারী ভাইস চেয়ারম্যানকেও ঘটনাটি জানিয়েছিলেন। তবে তারা ভাবতেই পারেননি, এভাবে বর্ষাকে পরিকল্পিতভাবে অপহরণের পর ধর্ষণ করা হবে। আর তাকে এভাবে আত্মহননের পথে ঠেলে দেওয়া হবে!’তিনি আরও বলেন, ‘ঘটনার দিন (গত ২৩ এপ্রিল) প্রাইভেট পড়তে যেতে চায়নি বর্ষা। কিন্তু তার সহপাঠী ও প্রতিবেশী সোনিয়া অনেকটা জোর করেই বর্ষাকে পাইভেটে নিয়ে যায়। এরপর সোনিয়া বাড়ি ফিরলেও বর্ষা বাড়ি ফিরে আসেনি। বিকেলে তারা খবর পান, বাড়ি থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে খানপুর বাগবাজার এলাকায় অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে বর্ষা। সেখান থেকে উদ্ধার করে তাকে আনা হয় উপজেলা পরিষদের গেটে। ওই দিন সন্ধ্যায় তার বাবা থানায় বর্ষাকে ধর্ষণের মামলা করতে যান। কিন্তু থানার ওসি আবুল হোসেন নানা অজুহাতে রাত ১২টা পর্যন্ত তাকে থানায় আটকে রাখেন। পরে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে রাত সাড়ে ১২টার দিকে পুলিশের গাড়িতে করেই বর্ষাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়। এছাড়া রাতেই পুলিশ অভিযুক্ত, রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থী মুকুলকে আটক করলেও রহস্যজনক কারণে সকালেই আবার ছেড়ে দেয়। এরপর টানা চার দিন মামলা করতে গেলেও পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের নামে কৌশল করে গভীর রাত পর্যন্ত বর্ষার বাবাকে থানায় আটকে রাখলেও মামলা নেয়নি। বর্ষার বাবা আব্দুল মান্নান চাঁদ বলেন, ‘আমরা এসপির কাছে যাবো বিষয়টি জানতে পেরে ওসি প্রতিদিন তাকে থানায় ডেকে আটকে রাখে। একদিন ওসিকে বলি, ‘যদি মামলা না নেন, তো বলে দেন। হয়রানি কেন করছেন? একথা বলতেই ওসি ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, পিটিয়ে দাঁত-মুখ ভেঙে দেব।’ আব্দুল মান্নান আরও বলেন, ‘এরপর মোহনপুরের সাবেক ইউএনও, বর্তমানে এডিসি আলমগীর কবীরকে বিষয়টি ফোনে জানাই। তিনি জেলা পুলিশ সুপারকে ঘটনাটি অবহিত করেন। পুলিশ সুপার বর্ষাকে নিয়ে যেতে বললে তাকে সব খুলে বলি। এরপর ওসি থানায় অপহরণের মামলা নেন। তবে তিনি ধর্ষণের অভিযোগ এজাহার থেকে বাদ দেন। তখন ওসি বলেন, মেডিকেল রিপোর্ট ছাড়া ধর্ষণের মামলা নেওয়া যাবে না।’উত্থাপিত অভিযোগের বিষয়ে মোহনপুর থানার ওসি আবুল হোসেন দাবি করেন, তিনি ভিকটিমের পরিবারকে কোনো ধরণের হয়রানি করেননি। মারধর করতেও চাননি। তার প্রচেষ্টাতেই মুকুলসহ চার আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে। বর্ষার মা ফরিদা বেগম বলেন, ‘বর্ষা বাড়ি ফিরে তাদের বলেছে, সহপাঠী সোনিয়া তাকে প্রাইভেট পড়ার জন্য ডেকে নিয়ে যায়। পরে সোনিয়া একটি রুমাল দিয়ে তার নাক ধরে। এরপর বর্ষা অচেতন হয়ে পড়ে। জ্ঞান ফিরে সে নিজেকে বাড়ি থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে বাগবাজার এলাকায় দেখতে পায়। নিজের পরনের জামা বদলে অন্য জামা দেখতে পায়। তার পাশে তখন অভিযুক্ত মুকুল ও দেলোয়ার নামের একজন ভ্যানচালক ছিল। তবে পুলিশ অপহরণ মামলায়ও ভ্যানচালক দেলোয়ারকে আসামি করেনি। জামা বদল থাকায় ধারণা করা হচ্ছিল, তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে।’ ফরিদা বেগম আরও বলেন, ‘২৭ এপ্রিল থানায় অপহরণ মামলার পর মুকুলকে আটক করা হলে শুরু হয় চরম গালাগাল ও হুমকি। আসামিরা বাড়ি এসে মেয়েদের এসিড নিক্ষেপের হুমকিও দেয়। অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে। গত বৃহস্পতিবার গোসল করতে গেলে বর্ষাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করা হয়। এতে অভিমানে মেয়েটি আত্মহত্যা করে।’ মোহনপুর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান সানজিদা রহমান রিক্তা বলেন, ‘একটি মেয়ে মারা গেলেও আরও দুই মেয়ে নিয়ে চরম আতঙ্কে আছেন বর্ষার বাবা আব্দুল মান্নান চাঁদ। তাদের নিরাপত্তা ও অভিযুক্তদের কঠোর শাস্তি দাবি করছি।’রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনের সাংসদ আয়েন উদ্দীন বলেন, ‘এ ঘটনায় জড়িত ও দায়িত্বে অবহেলাকারীদের শাস্তির আওতায় আনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।’এদিকে বর্ষার আত্মহত্যার ঘটনায় ১৩ জনকে আসামি করে মামলা করেছেন তার বাবা আব্দুল মান্নান চাঁদ। পুলিশ ওই মামলায় তিনজনকে গ্রেফতার করেছে। আসামি মুকুল কারাগারে থাকলেও অন্য আসামিরা বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে। এছাড়া আরেক আসামি ভিকটিম বর্ষায় বান্ধবী সোনিয়া আদালত থেকে জামিন নিয়ে পরিবারসহ পালিয়েছে। শনিবার থেকে তাদের বাড়ি-ঘরে তালা ঝুলতে দেখা যাচ্ছে। উল্লেখ্য, রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার বাকশিমইল উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী সুমাইয়া আক্তার বর্ষাকে (১৪) গত ২৩ এপ্রিল অপহরণ ও ধর্ষণ করা হয়। ওই ঘটনার পরে রাস্তার পাশে পড়ে থাকা অবস্থায় মেয়েটিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মেয়েটির বাবা থানায় ধর্ষণের মামলা দিলেও পুলিশ চারদিন পর অপহরণের অভিযোগে মামলা নেয়। ওই মামলা তদন্তের নামে মেয়েটির ওপর চলে পুলিশের মানসিক নির্যাতন। পাশাপাশি আসামি প্রতিবেশিদের নানা ধরনের অশালীন মন্তব্য। একপর্যায়ে গত ১৬ মে আত্মহত্যার পথই বেছে নেই কিশোরী মেয়েটি। ওইদিন বিকেলে মেয়েটি নিজ শয়নকক্ষে গলায় ওড়নার ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যার আগে সুমাইয়া আক্তার বর্ষা এক চিঠিতে লিখেছে, ‘প্রিয় বাবা-মা তোমাদের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আমি তোমাদের থেকে অনেক কিছু পেয়েছি, অনেক আদর, অনেক ভালোবাসা। কিন্তু একটা মেয়ের কাছে তার মানসম্মান সবচেয়ে বড়। আমি আমার লজ্জার কথা সবাইকে বলতে বলতে নিজের কাছে অনেক ছোট হয়ে গেছি। প্রতিদিন পর পুরুষের কাছে এসব বলতে বলতে আমি আর পারছি না। অপরাধীকে শাস্তি দিলেই তো আমার মানসম্মান ফেরত পাবো না। তাই আমাকে ক্ষমা করো।’

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

10 + 3 =