মহামান্য হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কলরেট বৃদ্ধি গ্রাকদের প্রত্যাখ্যান

0
798

অবি ডেস্ক: ১৭ জুন, ২০১৯ সোমবার সকাল ১১ টায় রাজধানীর সেগুন বাগিচাস্থ ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির দ্বিতীয় তলায় সাগর-রুনি মিলনায়তনে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশনের উদ্যোগে “২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে টেলিযোগযোগ সেবায় ব্যয়বৃদ্ধির প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন” অনুষ্ঠিত হয়। সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংগঠনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ। উপস্থিত ছিলেন, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন পবা’র চেয়ারম্যান আবু নাসের খান, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, সিপিবি’র সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য রুহিন হোসেন প্রিন্স, মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এড. আবু বক্কর সিদ্দিক, কার্যকরী সদস্য সাব্বির আহমেদ প্রমুখ।

সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ১৯৭৫ সালে বেতবুনিয়া উপগ্রহ কেন্দ্র চালুর মাধ্যমে বাংলাদেশে টেলিযোগাযোগের যাত্রা শুরু হয়। তখন থেকেই এই সেবা ছিল উচ্চবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তদের যোগাযোগের বিলাসিতার মাধ্যম। এরপর ’৯০ দশকে ১-জি ও ২-জি সেবার মাধ্যমে তারবিহীন মুঠোফোন সেবা চালু হলেও এ ব্যবসাকে মনোপলি ও লুটপাটের অন্যতম মাধ্যমে হিসেবে নেওয়া হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সাল থেকে এ খাতে মনোপলি ভাঙ্গলে অতি সাধারণ ব্যক্তি ও পরিবারের সামর্থের নাগালে চলে আসে এ সেবা।

বর্তমানে দেশে ৫-জি চালুর প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। একদিকে সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে চায়। অন্যদিকে টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে ব্যয়ও বৃদ্ধি করতে চায়। এ ধরণের দ্বিমুখী নীতির কারণ কি আমরা সরকারের কাছে জানতে চাই? গত পাঁচ বছরে প্রতি বাজেটেই টেলিযোগাযোগ সেবার ধারাবাহিকভাবে বেড়েই চলেছে। হয় সেটা কথা বলায়, ইন্টারনেট ব্যবহারে কিংবা ডিভাইস ক্রয়ে হোক।

বর্তমানে দেশের সকল সেবা সংস্থা সমূহের চাইতে রাজস্ব আদায়ে টেলিযোগাযোগ খাত অগ্রগামী। জিডিপি’র প্রায় ৬.৫% টেলিকম খাত থেকে আসে। বিটিআরসি শুধু রাজস্ব ভাগাভাগির মাধ্যমে ১০ হাজার কোটি টাকা আদায় করে থাকে। তাছাড়া লাইসেন্স প্রদান, নবায়ন ও তরঙ্গ বিক্রি বাবদ হাজার হাজার কোটি টাকা আদায় হয়। বর্তমানে এই খাতে গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় ১৫ কোটি ৬৫ লক্ষ।

এই খাত থেকে অদৃশ্য অর্থ আদায় করা যায় বলেই এ খাতে সবচাইতে বেশি চাপ প্রয়োগ করে রাজস্ব আদায় করা হয় বলে আমরা মনে করি। ডিজিটাল মাধ্যমে অর্থ আদায় করার ফলে গ্রাহকরা যেহেতু প্রত্যক্ষভাবে সমস্যায় পতিত হয় না তাই এ খাত রাজস্ব আদায়ে উত্তম বলে সরকারের কাছে বিবেচিত।

গত ১৩ জুন ২০১৯ বৃহস্পতিবার মহান জাতীয় সংসদে মাননীয় অর্থমন্ত্রী ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট উত্থাপন করেছেন। বাজেটে টেলিযোগাযোগ খাতে নতুন করে করারোপ করা হয়েছে। যা গ্রাহকদের মনে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। মাননীয় অর্থমন্ত্রী হয়তো বা অবগত নন যে, গত বছর বাজেটে কলরেট বৃদ্ধির পর পুনরায় নতুন করে ১৫ আগস্ট ২০১৮ইং ২৫ পয়সা সর্বনি¤œ কলরেটের স্থলে ৪৫ পয়সা সর্বনি¤œ কলরেট নির্ধারণ করলে আমরা এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করি। আন্দোলনের অংশ হিসেবে মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনে গত ১৩ ডিসেম্বর ২০১৮ইং কলরেট বৃদ্ধি না করতে একটি রিট পিটিশন দায়ের করা হয়। পরবর্র্তীতে ৪ এপ্রিল ২০১৯ইং পুর্নাঙ্গ রায়ে মহামান্য হাইকোর্ট কলরেট বৃদ্ধির উপর নিষেধাজ্ঞ জারি করেন। মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশন নতুন করে কলরেট বৃদ্ধিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এমতাবস্থায় সরকারের হাইকোর্টের রায়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে নতুন করে করারোপ করা থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন ছিল। যদিও প্রভিশনাল কালেকশন অব ট্যাক্সেস অ্যাক্ট ১৯৩১ এর ধারা ৩ অনুযায়ী আমদানি শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর সংক্রান্ত কিছু পরিবর্তন বাজেট ঘোষনার সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর হয়ে যায়। কিন্তু মহামান্য হাইকোর্টের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে গ্রাহক সমাজ এই করারোপের কর দিতে বাধ্য নই। আমরা মহামান্য হাইকোর্টের পরবর্তী নির্দেশনার অপেক্ষায় থাকবো। যদি গ্রাহকদের কাছ থেকে কোন প্রকার অর্থ আদায় করা হয় তার জন্য অপারেটর ও সরকার দায়ী থাকবে।

যে প্রকারে চক্রবৃদ্ধি হারে করারোপ করা হয় তাতে করে শতকরা প্রায় ৫৬% অর্থ সরকারি কোষাগারে গ্রাহককে দিতে হয়। প্রস্তাবিত বাজেটে মুঠোফোন সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক ৫% থেকে বাড়িয়ে ১০% করা হয়েছে। এতে আদায় হবে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। জুন ২০১৫ পর্যন্তও মোবাইল ফোন ব্যবহারে শুধু ১৫ শতাংশ ভ্যাটই দিতেন গ্রাহক। ২০১৫-১৬ সালের বাজেটে প্রথমবার মোবাইল ফোন ব্যবহারের ওপর সম্পূরক শুল্ক নিয়ে আসা হয়। প্রথমে ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক দিলেও পরে তা ৩ শতাংশে নামিয়ে আনা হয় বিভিন্ন পক্ষের দাবির প্রেক্ষিতে। কিন্তু দুই বছর বাদেই কিন্তু আবার এই শুল্ক ৫ শতাংশ করে দেওয়া হয়, যেটি এবার ১০ শতাংশে নিয়ে যাওয়া হলো। মাঝে যোগ করা হয়েছে ১ শতাংশ সারচার্জ। নতুন সম্পূরক শুল্ক আসার কারণে এখন মোবাইল ফোনের ব্যবহারের ওপর মোট ট্যাক্স গিয়ে দাঁড়াচ্ছে ২৭ দশমিক ৭৭ শতাংশে। ফলে কেউ মোবাইল ফোনের মাধ্যমে কোনো একটি সেবা নিতে যদি ১০০ টাকা রিচার্জ করেন তাহলে তিনি ৭৮ দশমিক ২৭ টাকার সেবা ব্যবহার করতে পারবেন। আর বাকি ২২ দশমিক ৭২ টাকাই চলে যাবে সরকারের কোষাগারে। বাংলাদেশের মানুষ এখন একেকটি সংযোগে মাসে গড়ে ১৫০ টাকা খরচ করে। নতুন ট্যাক্সের করণে তার খরচের হিসেবে আরও ১৫ থেকে ২০ টাকা যোগ হবে। আর গত পাঁচ বছর ক্রমান্বয়ে খরচ বাড়ার হিসাবটা ধরলে টাকার অংক কয়েক হাজারে চলে যায়। সিম কার্ডের উপর নতুন করে ১০০ টাকার স্থলে ২০০ টাকা ভ্যাট নির্ধারণ নতুন গ্রাহকদের ব্যয় বৃদ্ধি করবে। এতে করে অতিরিক্ত আদায় হবে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা। তাছাড়া অপারেটরদের উৎস আয়ের উপর নতুন করে ১.২৫% করের বোঝায় গ্রাহকদের চাপবে বলে আমরা মনে করি। এর মধ্যে ২০১৭-১৮ সালের বাজেটে মোবাইল ফোন আমদানির ওপরে ভ্যাট একধাপে ১৫ শতাংশে নিয়ে আসা হয়, যদিও সে সময়ই স্থানীয় সংযোজনের ওপর দেওয়া হয় কিছু সুবিধা। আর পরের বছর হ্যান্ডসেট আমদানিতে বাড়িয়ে দেওয়া হয় সম্পূরক শুল্কও। ফলে যেটি হলো একেকটি স্মার্টফোনের ওপর গড় খরচ বাড়ল এক হাজার থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত। দেশীয় প্রযুক্তিবিদ ও স্মাটফোন তৈরির দক্ষ জনবল তৈরি না করে দেশীয় উৎপাদনে সুবিধা দিলে শুধু উৎপাদনকারী লাভবান হবে।

ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে গত অর্থবছরের চেয়ে বরাদ্দ বেড়েছে ৬২১ কোটি টাকা। আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরে টেলিকম ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়ন ও সুরক্ষায় ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগকে তিন হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন মাননীয় অর্থমন্ত্রী। যা গত অর্থবছর থেকে ৬২১ কোটি টাকা বেশি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ সংশোধিত বাজেটে দুই হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা পেয়েছিল। আর সে অর্থবছরে বিভাগটিতে বাজেট বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছিল তিন হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বরাদ্দ ২০ শতাংশ বাড়িয়ে ১৫ হাজার ৭৭৩ কোটি টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছর এ খাতে বরাদ্দ ছিল ১৩ হাজার ১১১ কোটি টাকা। ডাক ও টেলিযোগাযোগ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগসহ অন্য মন্ত্রণালয় মিলে সামগ্রিকভাবে এ বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ডাক, টেলিযোগাযোগ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীন ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের বরাদ্দ প্রায় ২২ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। একই মন্ত্রণালয়ের অধীন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে ১১ শতাংশ। প্রস্তাবিত বাজেটে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের বরাদ্দ বাড়ছে ১৯৩ কোটি টাকা। আসন্ন অর্থবছর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে ছিল ১ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকা। ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের পরিচালন ও উন্নয়ন ব্যয় মিলিয়ে মোট ৩ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে এ বিভাগের বরাদ্দ ছিল ২ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের তুলনায় ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের বরাদ্দ বাড়ছে ৬২১ কোটি টাকা। বিভাগটির উন্নয়ন ব্যয় বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে ২ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা। ডাক, টেলিযোগাযোগ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং অন্যান্য মন্ত্রণালয় মিলে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বরাদ্দ ২০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছর এ খাতে বরাদ্দ ছিল ১৩ হাজার ১১১ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা বাড়িয়ে প্রস্তাব করা হয়েছে ১৫ হাজার ৭৭৩ কোটি টাকা। তথ্যপ্রযুক্তি খাত নিয়ে বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়, গত বছর বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উদ্বোধনের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে স্যাটেলাইট রয়েছে এমন দেশের তালিকায় যুক্ত হয়েছে। এ অর্জন বাংলাদেশকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। এছাড়া দেশের সব ইউনিয়ন ও পৌর এলাকায় পাঁচ হাজার ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। সারা দেশে প্রায় ২৩ হাজার ৫০০ কিলোমিটার অপটিক্যাল ফাইবার কেবল স্থাপন করা হয়েছে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা নয় কোটি ছাড়িয়েছে। সারা দেশে ২৮টি হাইটেক পার্ক হচ্ছে। সার্বিক ভাবে বাজেট বৃদ্ধি পেলেও জনসাধরণকে সুকৌশলে করের ফাঁদে আটকানো হয়েছে। কলরেট বৃদ্ধি, ইন্টারনেটের মূল্যবৃদ্ধি ও ডিভাইসের মূল্যবৃদ্ধি ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণকে বাঁধাগ্রস্ত করবে বলে আমরা মনে করি। এমনকি এত বরাদ্দের মাঝে একমাত্র রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান টেলিটকের উন্নয়নে কোন বরাদ্দ বাজেটে রাখা হয় নি।

আমরা জানি সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি করা হয় কোন পণ্য বা সেবাকে নিরুৎসাহিত করার জন্য। অথচ এই প্রযুক্তির মাধ্যমে কল্যাণে আজকে দেশে পাঠাও, উবারসহ ইন্টারনেট ব্যবসায় হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। দুঃখের বিষয় বর্তমান সরকার প্রযুক্তির প্রসার করার কথা বললেও এ খাতে সম্পূরক শুল্ক বসিয়ে টেলিকম নীতিমালা ২০১৮ পরিপন্থি কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সরকারের প্রতি জনগণের উপর এই অন্যায় করের বোঝা প্রত্যাহারের আহ্বান জানাই।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

fifteen − 13 =