নারী নির্যাতন জাতীয় উন্নয়নের পথে সবচেয়ে বড় বাঁধা: আইনমন্ত্রী

0
795

অবি ডেস্ক: আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, নারীর মর্যাদা ও অধিকার রক্ষায় বাংলাদেশের সংবিধান পুরুষের সাথে নারীর সমঅধিকার প্রদান করলেও জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া নারীরা প্রায় প্রতিনিয়ত পারিবারিক ও সামাজিকভাবে বঞ্চনা ও নির্যাতনের শিকার হন। আর এই নারী নির্যাতন হচ্ছে আমাদের কাঙ্খিত জাতীয় উন্নয়নের পথে সবচেয়ে বড় বাঁধা। তাই প্রথমবার সরকার গঠন করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার এই বাঁধা দূর করার জন্য বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। যার মধ্যে অন্যতম পদক্ষেপ ছিল নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের আধুনিকায়ন।


রোববার ঢাকায় বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের স্পেশাল পাবলিক প্রোসিকিউটদের বিশেষ প্রশিক্ষণ কোর্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় এসব কথা বলেন তিনি। প্রশিক্ষণে ৪৪ জন প্রোসিকিউটর অংশ নেন।
মন্ত্রী বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালগুলোতে বিচারাধীন মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে পূর্বের ৫৪টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের পাশাপাশি ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে ২৯টি জেলায় আরো ৪১টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করে সেগুলোতে বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নতুন ৪১টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল স্থাপনের মাধ্যমে বিচারপ্রার্থী জনগণের মনে নতুন করে আশা জেগেছে যে, তারা স্বল্প সময়ে, স্বল্প ব্যয়ে ও সহজে ন্যায় বিচার পাবেন। আমার বিশ্বাস, সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতায় আমরা তাঁদের এই নতুন আশা পূরণ করতে সক্ষম হবো। আমাদের খুশির খবর হলো, বিগত এক বছরে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালগুলোতে নতুন করে মামলা জট তৈরি হয়নি বরং বিচারাধীন ১,৮৩১টি মামলা কমেছে। গত দুই বছরের মামলার পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮ সালের মার্চ মাসে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালগুলোতে বিচারাধীন মামলা ছিল ১ লাখ ৬৬ হাজার ৩৮২টি। ২০১৯ সালের একই সময়ে এসে সেখানে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬৪ হাজার ৫৫১টি।


আনিসুল হক বলেন, আমাদের মামলাজট কমিয়ে অবশ্যই গ্রহণযোগ্য মাত্রায় আনতে হবে এবং এটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে হবে। আমরা কোন বিচারপ্রার্থীকে বছরের পর বছর ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য আদালতের বারান্দায় ঘুরতে দেখতে চাইনা। কারণ বিলম্বিত বিচারে বিচারপ্রার্থী জনগণ যেমন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন তেমনী তার ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ সংকুচিত হয়। অপরাধীর পাড় পেয়ে যাওয়ার পথ সুগম হয় এবং তারা নতুন করে অপরাধ করতে উৎসাহিত হয়। এতে সমাজের অন্যরাও অপরাধ করতে দ্বিধাবোধ করে না। অপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া থেকে পাড় পেয়ে যাওয়ার পরিণাম যে কত ভয়াবহ তা সমাজে ক্রমবর্ধমানহারে ঘটে যাওয়া ধর্ষণের পরিসংখ্যান থেকে বুঝা যায়। দেখা গেছে ধর্ষণ মামলায় শেষ পর্যন্ত নগণ্য সংখ্যক আসামীর সাজা হয়। বাকীরা প্রভাব-প্রতিপত্তি, তদন্তে দীর্ঘসূত্রতা, সাক্ষ্য গ্রহণের সময় ভিকটিমকে হয়রাণি, সাক্ষ্য প্রমাণের অভাব, বাদী পক্ষের সঙ্গে আসামী পক্ষের সমঝোতা ইত্যাদি কারণে পাড় পেয়ে যাচ্ছে। ফলে সমাজে ধর্ষণের মতো ঘৃণিত কাজ বেড়েই চলেছে এবং সম্প্রতি সমাজের শিক্ষিত লোকের মাধ্যমেই এই ঘৃণিত কাজ বেশি চলছে।


তিনি বলেন, আধুনিক কালে উন্নত বিশ্বে অপরাধ বিজ্ঞান ও উন্নয়ন তত্ত্বের মধ্যে বিপরীতমুখী সম্পর্ক অর্থাৎ উন্নয়ন বাড়লে অপরাধ বা অপরাধ প্রবণতা কমবে এবং উন্নয়ন কম হলে অপরাধ বা অপরাধ প্রবণতা বাড়বে- এই সম্পর্ক সুপ্রতিষ্ঠিত হলেও বাংলাদেশে উন্নয়ন ও অপরাধ সমানতালে চলছে। তাই যে কোন উপায়ে আমাদের অপরাধ বা অপরাধ প্রবণতা কমাতে হবে। নইলে আমাদের উন্নয়নের মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হবে। তাই বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আমার বিশেষ অনুরোধ, আপনারা দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে দ্রুততম সময়ে ন্যায়বিচার প্রদানে সহায়তা করে অপরাধ দমনে এগিয়ে আসুন। একজন অপরাধীও যাতে আইনের ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে বিচার এড়াতে না পারে সে ব্যাপারে সজাগ থাকবেন। ‘‘অপরাধ করলে শাস্তি ভোগ করতে হবে’’ এই নীতি নিয়ে এগিয়ে চলবেন। দেখবেন তাহলেই সামাজিক অপরাধ কমতে থাকবে, সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে আসবে, জনগণ উন্নয়নের পুরো সুফল ভোগ করতে পারবে।
বিচার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে প্রোসিকিউটরদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আপনাদেরকে অবশ্যই আদালতের সময় ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সকল নির্দেশনা মেনে চলতে হবে। আদালতে সঠিক সময়ে সাক্ষী হাজিরসহ নির্ধারিত তারিখে সাক্ষী পরীক্ষা করার ক্ষেত্রে সচেষ্ট হতে হবে। সর্ব অবস্থায় আদালতের নির্দেশনা পালন করে আদালতের মামলা ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়াকে সহায়তা করতে হবে। তাছাড়া মামলা জট কমানোর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে।


একবিংশ শতাব্দীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য বিচার বিভাগকে আধুনিকীকরণের লক্ষ্যে সরকার ইতোমধ্যেই অনেক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় এসডিজি এবং ভিশন ২০২১ এর লক্ষ্যসমূহ অর্জনের জন্য আইন মন্ত্রণালয় বিচার বিভাগকে সব ধরণের সহযোগিতা প্রদান করে আসছে। আমরা উচ্চ আদালতের মতো অধস্তন আদালতেও একটি প্রোসিকিউশন সার্ভিস গঠন করার কথা ভাবছি। খুব সহসাই আমরা এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনার আলোকে পদক্ষেপ গ্রহণ করব। আপনাদের ভাতা বৃদ্ধিসহ সার্বিক সুযোগসুবিধা অপ্রতুল এবং এ বিষয়ে সরকার অবগত। তাই আপনাদের ভাতা ও সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে।


প্রশিক্ষণ শেষে নিজ নিজ কর্মস্থলে ফিরে গিয়ে উন্নত নৈতিকমান ও পেশাদারিত্ব বজায় রেখে আন্তরিকতার সাথে মামলা পরিচালনা করার আহবান জানিয়ে প্রশিক্ষণার্থীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, বিচারপ্রার্থী জনগণ আপনাদের নিকট যেন সবরকম সহোযোগিতা পায় সে বিষয়ে সজাগ থাকবেন। আপনারা জানেন যে, সরকার দুর্নীতির ক্ষেত্রে জেরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। সেজন্য আদালত অঙ্গনে দুর্নীতি সংক্রান্ত সকল প্রথাগত কর্মকা- পরিহার করে সততা, স্বচ্ছতা এবং সাহসিকতার সমন্বয়ে দায়িত্ব পালন করবেন। তাহলেই জনগণের প্রত্যাশিত স্বল্প সময়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে এবং বিচার বিভাগের প্রতি সাধারণ জনগণের আস্থা বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে।

বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক বিচারপতি খোন্দকার মূসা খালেদ এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আইন ও বিচার বিভাগের সচিব আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হকও বক্তৃতা করেন।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

ten − 5 =