কর্নেল অলির মুক্তমঞ্চের গুপ্তকথা!

0
801

গোলাম মাওলা রনি:
কর্নেল অলি আহমেদ বীর বিক্রমের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে সম্প্রতি। চলতি বছরের মার্চ মাসের দিকে ঢাকায় অনুষ্ঠিত একটি আলোচনা সভায় আমি তার পাশে বসে বক্তব্য দেয়ার সুযোগ পাই। সে দিনের সেই আলোচনা সভা শুরু হওয়ার মুহূর্তে আমরা বেশখানিকটা সময় ধরে জাতীয় রাজনীতি এবং বিভিন্ন ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে মতবিনিময় করি। সে দিন তিনি আমাকে জানালেন, দীর্ঘ দিন ধরে তিনি আমার লেখা নিয়মিত পড়েন এবং টকশোগুলোও দেখেন। তার ভদ্রতার জবাবে আমিও তাকে জানালাম, ব্যক্তিগতভাবে আমি তাকে পছন্দ করি তার সততা, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সাথে ঘনিষ্ঠতা এবং বিএনপির মতো একটি সুপ্রতিষ্ঠিত ও জনপ্রিয় দলের যুগান্তকারী উদ্যোক্তা পরিচালক বা প্রতিষ্ঠাতার প্রধান সাহায্যকারী হওয়ার ইতিহাসের বাইরে কর্নেল অলির রয়েছে বহুমাত্রিক ব্যতিক্রমী সফলতার ইতিহাস। সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী ছাড়াও অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসেবে তার সততা, সফলতা এবং সুনাম আমাকে যতটা বিমোহিত করে; তার চেয়েও বেশি বিমোহিত করে তার পিএইচডি।

কর্নেল অলি আহমেদ যে পিএইচডিধারী, তা আমি জানতাম না। নবম পার্লামেন্টের একটি অধিবেশনে তিনি স্পিকারকে উদ্দেশ করে কৌতুকভরে বলেন যেÑ মাননীয় স্পিকার! আমি প্রবীণ বয়সে অত্যন্ত কষ্ট করে পড়াশোনা করে বিলেতের অত্যন্ত নামকরা একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি অর্জন করেছি। সুতরাং আমাকে সম্বোধন করতে গিয়ে আমার নামের আগে ড. শব্দ যোগ করলে আমি খুশি হবো। ড. অলির সে দিনের কথা শুনে আমি বেশ আশ্চর্য হয়েছিলাম প্রধানত দু’টি কারণে। প্রথমত, সত্তর বছর বয়সে একজন রাজনীতিবিদ নিয়মিত ছাত্রছাত্রীদের মতো অধ্যয়ন করে পিএইচডি অর্জন, এটি কেবল বাংলাদেশে নয়Ñ সমকালীন দুনিয়ায় বিরল ঘটনা। দ্বিতীয়ত, পদ-পদবিধারী এবং উচ্চাকাক্সক্ষী বয়স্ক লোকেরা অনেকসময় টাকার বিনিময়ে প্রক্সি পরীক্ষা এবং প্রক্সি গবেষণাপত্র জমা দিয়ে ডিগ্রি নিয়ে থাকেন। কেউ কেউ আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরাট অঙ্কের অর্থ অনুদান দিয়ে অনারারি পিএইচডি নিয়ে থাকেন। তবে এ ধরনের লোকদের বিরাট অংশই নীলক্ষেত-কেন্দ্রিক ভুয়া সার্টিফিকেটধারী পিএইচডি হাসিল করে হম্বিতম্বি করেন। সুতরাং শত-সহস্র নকলবাজ এবং ভুয়া ডিগ্রিধারীর মুখে চুনকালি মেখে ড. অলি যখন নিজের বিদ্যা-বুদ্ধিজাত শ্রমের মূল্য এবং স্বীকৃতি চাইলেন তা-ও আবার জাতীয় সংসদে, তখন আমি আশ্চর্য না হয়ে পারিনি।

নবম সংসদে ড. অলি আহমেদ আমার সহকর্মী ছিলেন। আমার কয়েকবার ইচ্ছে হয়েছিল, সংসদ লবি কিংবা তার অফিসে গিয়ে তার সাথে পরিচিত হতে। কিন্তু তার ব্যক্তিত্ব, রাশভারী স্বভাব এবং তার সাথে বয়সের বিস্তর ফারাক থাকার কারণে আমি আসলে সাহস পাইনি তার মুখোমুখি হতে। সংসদে তার খোলামেলা বক্তব্য, নির্ভীক অভিব্যক্তি, বুদ্ধিদীপ্ত অথচ সহজ সরল উপস্থাপনা আমাকে মুগ্ধ করত। ক্ষমতাসীন বিএনপির সৌভাগ্য যখন তুঙ্গে তখন তিনজনের অধিক সংসদ সদস্য এবং তিনজন মন্ত্রী নিয়ে কেবল আদর্শিক কারণে দলত্যাগ করে এলডিপি গঠনের মাধ্যমে যেমন নজিরবিহীন চমক দেখিয়ে তিনি আমার মতো তরুণ রাজনৈতিক কর্মীর মনে রেখাপাত করেছিলেন, তেমনি এলডিপি গঠন-পরবর্তী ঝক্কি-ঝামেলা, শাসক দলের জুলুম-নির্যাতন ইত্যাদি মোকাবেলায় তার সাহস-শক্তি ও প্রজ্ঞা অনেককে চমকিত করেছিল। এসব কারণে ২০১৯ সালের মার্চ মাসে তার সাথে যখন আমার প্রথম সাক্ষাৎ হলো তখন আমার ভেতরকার তাবৎ শ্রদ্ধা-ভালোবাসা ও ভালো লাগা একসাথে বের হয়ে এলো। তিনি তার স্বভাবসুলভ প্রজ্ঞা দিয়ে আমার আন্তরিকতার কারণ বুঝতে পারলেন এবং অধিকতর আলোচনার জন্য একদিন তার বাসভবনে চা-নাশতার নিমন্ত্রণ দিলেন।

আমি আমার স্বভাবজাত লজ্জা-সঙ্কোচ এবং অন্তরমুখী ব্যক্তিত্বের কারণে ড. অলি আহমেদের চা-নাশতায় আপ্যায়িত হওয়ার জন্য নিজে উদ্যোগী না হয়ে পুনঃনিমন্ত্রণের অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমার জীবনের অন্যান্য স্বয়ংক্রিয় প্রাপ্তির মতো হঠাৎ করে এপ্রিল মাসের কোনো একদিন তার কাছে থেকে একটি ফোন পেলাম। তিনি আমাকে পরের দিন বাসায় দাওয়াত দিলেন এবং বললেনÑ সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে আমার মতো বয়সী লোকজন কী ভাবছে এবং দেশ-জাতি সম্পর্কে আমার পরিচিত শ্রেণী-পেশার লোকজন কী ভাবছে, তা তিনি আমার মুখ থেকে শুনতে চান। ড. অলির ফোন পাওয়ার পর আমি বেশ উৎফুল্ল বোধ করলাম এবং নিজেকে কিছুটা হলেও গুরুত্বপূর্ণ মনে হতে থাকল। কারণ, আমার রাজনৈতিক জীবনে ড. অলির সমপর্যায়ের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কোনোকালে আমি বা আমাদের মতো কারো কাছ থেকে দেশ-জাতির হালহকিকত জানতে চেয়েছেন, এমন ঘটনা দেখিনি বা শুনিনি।

আমি নির্দিষ্ট দিনে ঢাকার মহাখালীর নিউ ডিওএইচএসের পার্ক রোডে অবস্থিত ড. অলি আহমেদের বাসভবনের গেটে পূর্বনির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হলাম এবং দেখলাম, আমাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য তার পক্ষ থেকে একজন কর্মকর্তা অপেক্ষা করছেন, যিনি আমাকে পথ দেখিয়ে নির্দিষ্ট কামরায় নিয়ে গেলেন। তিনি তার দলীয় নেতাকর্মীদের সাথে আলোচনায় ব্যস্ত ছিলেন এবং আমাকে দেখামাত্র সেই আলোচনায় বিরতি দিয়ে আমাকে বসতে বললেন। তারপর অতি দ্রুত চলমান আলোচনা শেষ করে আমার সাথে একান্ত আলোচনার জন্য পরিস্থিতি সৃষ্টি করলেন। তিনি প্রথমেই জেনে নিলেন আমার বিএনপিতে যোগদান এবং আওয়ামী লীগ ত্যাগের কারণ। আমিও তার এলডিপি গঠন, বিএনপি ত্যাগ এবং পুনরায় বিএনপি জোটে যোগদানের কারণ জেনে নিলাম।

আমার সাথে কিছুক্ষণ আলোচনার পর তিনি বুঝতে পারলেন, আমিও তার মতো ব্যতিক্রমী চিন্তা করতে অভ্যস্ত এবং দেশ-জাতির যেসব বিষয় নিয়ে তিনি চিন্তিত, সেসব বিষয় আমাকেও পীড়া দেয়। তিনি তার সৈনিক জীবন, মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৭৫ পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী অনেক অজানা ও চাঞ্চল্যকর ঐতিহাসিক ঘটনা বলে আমাকে বিস্মিত করে দিলেন। জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা গ্রহণের পূর্ববতী এবং পরবর্তী কয়েক দিনের নাটকীয় ঘটনা নিয়ে তিনি এমন কিছু তথ্য দিলেন, যা না শুনলে আমি হয়তো সারা জীবন ওই সব বিষয়ে অজ্ঞ থেকে যেতাম। কারণ, বইপুস্তক পড়ে অথবা তৃতীয় পক্ষের কাছ থেকে শুনে ওই সব ঘটনা মূল্যায়ন করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। বিএনপি গঠনের প্রেক্ষাপট, জিয়াউর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ড, বেগম জিয়ার রাজনীতিতে আগমন এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার কার্যকালের নানান কৌতুহলোদ্দীপক কাহিনী শুনিয়ে তার সম্পর্কে আমার পূর্বধারণা আরো উচ্চতায় নিয়ে গেলেন। যোগাযোগমন্ত্রী হিসেবে যমুনা সেতুর টেন্ডার, কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভ নির্মাণসহ সড়ক-রেলপথ, বিআরটিএ এবং মহানগরগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থায় তার ব্যতিক্রমী উদ্যোগ, সফলতা ও ব্যর্থতার কথাগুলো বলে তিনি আমাকে মূল বিষয়ের দিকে নিয়ে গেলেন।

ড. অলি আহমেদ আমাকে একাদশ সংসদ নির্বাচন-পূর্ববর্তী সময়ে ঐক্যফ্রন্ট গঠন, ঐক্যফ্রন্ট সম্পর্কে বিএনপির কিছু শীর্ষ নেতার ভিন্নমত এবং নির্বাচনকালীন প্রার্থী হিসেবে নিজের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা বললেন। ড. অলির মতে, ঐক্যফ্রন্ট গঠনের মধ্যে কোনো ভুল ছিল না। তবে বিএনপির কিছু নেতার অতিমাত্রার আবেগ এবং ঐক্যফ্রন্টপ্রীতির কারণে ফ্রন্টের জনবিচ্ছিন্ন, নির্বাচনবিমুখ এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় অনভিজ্ঞ নেতারা বিএনপিকে পেয়ে বসেন। তারা বিএনপির জনপ্রিয়তা, গ্রহণযোগ্যতা, সুবিধা-অসুবিধা, বিএনপির দাবিদাওয়া, চাহিদা ইত্যাদির ব্যাপারে ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধ না দেখিয়ে প্রতিটি সিদ্ধান্তে নিজেদের মাতুব্বরি তথা কর্তৃত্ব প্রদর্শনের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। ঐক্যফ্রন্টের বৈঠকে বিএনপির উপস্থিতি জৌলুশ হারাতে থাকে এবং জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধুর পাশাপাশি মুজিব কোটের জয়জয়কার শুরু হয়ে যায়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ড. কামালকে কেউ কেউ হঠাৎ করে এমন অতি মানব ভাবতে শুরু করেন, যেমনটি লোকজন করেছিল শেরেবাংলার ক্ষেত্রে ১৯৫৪ সালে, বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রে ১৯৭২-৭৩ সালে এবং জিয়াউর রহমানের ক্ষেত্রে ১৯৭৭-৭৮ সালে।

একাদশ সংসদ নির্বাচন-পূর্ববর্তী সময়ে ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে প্রথম সমালোচনা শুরু হলো সে দিন, যেদিন ড. কামাল কারো সাথে আলোচনা না করে নাটকীয়ভাবে প্রধানমন্ত্রীর সাথে সংলাপ করার আগ্রহ দেখিয়ে চিঠি লিখে বসলেন। সমালোচনা আরো বাড়লে যখন দেখা গেল প্রধানমন্ত্রী টর্নেডোর গতিতে তার কামাল কাকুর চিঠির উত্তর দিয়েছেন এবং বৈঠকের ব্যাপারে চরম আগ্রহ দেখিয়ে কামাল কাকুর পছন্দের কেক-মিষ্টি, দইবরা-ভাজি-ভর্তা এবং কোপ্তার আয়োজনের কথা সর্বমহলে চাউর করে দিয়েছেন। ড. কামালের একক ও একরোখা সিদ্ধান্তে গণভবনে গিয়ে ঐক্যফ্রন্ট নেতারা কিছু তো পেলেনই না, বরং বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটকে ক্ষমতাসীনদের কাছে অসহায়, দুর্বল ও করুণাপ্রার্থী বানিয়ে ছাড়লেন। বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের এক নম্বর প্রাণের দাবি ছিল, বেগম জিয়ার মুক্তি এবং সেই মুক্তির আশ্বাস না পাওয়া পর্যন্ত কোনো রকম নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার ব্যাপারে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী শক্তির ধারক-বাহকেরা ছিল সম্পূর্ণ একমত। নির্বাচন-পূর্ববর্তী সময়ের সুবিধাজনক সেই পরিস্থিতিকে কাজে না লাগিয়ে ঐক্যফ্রন্ট নেতারা বিএনপি এবং ২০ দলীয় জোটকে সুকৌশলে সরকারের পাতানো ফাঁদের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়।

একাদশ সংসদ নির্বাচনে ড. কামালের প্রার্থী না হওয়া, নির্বাচনের সময় কোনো মনিটরিং সেল না করা এবং বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় ঝটিকা সফর না করার ঘটনার মধ্যেই বিএনপির পরাজয়ের বীজ লুকায়িত ছিল। সারা দেশের প্রতিটি সংসদীয় আসনে ক্ষমতাসীনদের তাণ্ডব, ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থীদের গৃহবন্দিত্ব, মামলা-হামলা এবং জুলুম-নির্যাতনের প্রতিবাদে একটি মানববন্ধন না করে অদ্ভুত নীরবতার বাহারি কৌশলের মধ্যে বিএনপির অপমানজনক পরাজয়ের রিমোট কন্ট্রোলে ব্যাটারি চার্জ করা হয়। ২৪ ডিসেম্বর তারিখে সেনাবাহিনীকে মাঠে নামানোর পর যখন পুরো পরিস্থিতি আগের তুলনায় কয়েক গুণ খারাপ হয়ে গেল, তখন ঐক্যফ্রন্টের নেতারা বিএনপির পরাজয় নিশ্চিত করার জন্য নিজেদের হাতে থাকা ফুলচার্জ করা রিমোর্ট কন্ট্রোল চাপতে আরম্ভ করলেন। ফলে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার সুরে যেভাবে শহরের ইঁদুরেরা নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল, ঠিক সেইভাবে বিএনপির সব প্রার্থী তাদের ত্যাগী নেতাকর্মীসহ দুনিয়ার সর্বনিকৃষ্ট জাহান্নামের আগুনে নিজেদেরকে জলাঞ্জলি দিতে বাধ্য হলেন।

নির্বাচনের পরে যে ফলাফল দেশবাসীকে দেখানো হলোÑ তা নিয়েও একটি কার্যকর আন্দোলন গড়ে তোলা যেত। কিন্তু ঐক্যফ্রন্ট নেতারা তা না করে ফল প্রত্যাখ্যানের প্রকাশ্য নাটক এবং গোপনে নিজেদের অর্থাৎ গণফোরামের ভাগে জোটা দানের শিরনিকে দেবালয়ে প্রণতিদানের জন্য নৈশভোটের সাথে তাল মিলিয়ে নৈশবিহারে পাঠিয়ে বিএনপির জন্য আরেক দফা অপমান অনিবার্য করে তুললেন। বিএনপির যেসব প্রার্থী দৈবচয়নে নির্বাচিত হয়েছিলেন, তারা গণফোরামের শিরনির সাথে নিজেদেরকে বিসর্জন দেবার জন্য এক শ’ তেত্রিশ পায়ে খাড়া হয়ে মহাবিক্রমে সংসদে ধাবিত হওয়ার জন্য জীবন-মরণ জিদ ধরলেন। এ ক্ষেত্রে নানান ছেলেভোলানো গল্পের ফাঁদে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বকে এক রকম বাধ্য করে যেভাবে বিএনপি নামটি একাদশ সংসদে অনুপ্রবেশ করল, তা বাংলাদেশের প্রহসনের ইতিহাসে এক মহা মাইলফলক হয়ে থাকবে।

উপরোল্লিখিত ঘটনার ডামাডোল, একটির পর একটি সাসপেন্স চক্রান্ত-বেঈমানি-মুনাফেকি এবং সর্বনাশা লোভের সর্প জিহ্বার লালসার কামরসে বিএনপির প্রাণের দাবি কবরচাপা পড়ে গেল। ফলে বেগম জিয়ার মুক্তি, বিএনপির ঘুরে দাঁড়ানো এবং দেশের গণতন্ত্র, নতুন এক মারণফাঁদে আটকা পড়ল। এ অবস্থা থেকে বিএনপিকে রক্ষা করা এবং বেগম জিয়ার মুক্তির আন্দোলনকে সুতীব্র করার জন্য ড. অলি আহমেদ মুক্তমঞ্চ নামে একটি ভিন্ন প্ল্যাটফর্ম গড়ার ব্যাপারে আমার দৃষ্টিভঙ্গি জানতে চাইলেন। আমার স্বল্পবুদ্ধির অনভিজ্ঞতাপ্রসূত প্রস্তাব ছিলÑ ‘আপনি বিষয়টি নিয়ে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সাথে খোলামেলা আলোচনা করুন অথবা যেকোনো মূল্যে তার কাছ থেকে গ্রিন সিগন্যাল আদায় করে নিন। তিনি আমার কথা শুনে অর্থপূর্ণ মুচকি হাসি দিলেন এবং বললেন, বিএনপির এখন যে অবস্থা তাতে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে বিষয়টি বুঝিয়ে বলার পর তিনি যদি সম্মতি দেন অথবা বিষয়টি নিয়ে দলের সিনিয়র নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ করেন, তবে চক্রান্তকারীরা নতুন চক্রান্তের অছিলা পেয়ে যাবে। সুতরাং এসব কাজ ঝুঁকি নিয়ে এককভাবে করতে হবে। বিএনপি যদি দেখে, আমরা নিঃস্বার্থভাবে আন্তরিকতার সাথে বেগম জিয়ার মুক্তির জন্য চেষ্টা করছি এবং আমাদের সব প্রচেষ্টা বিএনপির পক্ষে যাচ্ছে, তখন তারা এমনিতেই সমর্থন জানাবে।

চলতি বছরের এপ্রিল মাসের কোনো একদিন ড. অলি আহমেদের সাথে আমার উল্লিখিত কথোপকথনের কথা আমি প্রায় ভুলতে বসেছিলাম। এরই মধ্যে তিনি একদিন ফোন করে আমাকে জানালেন, ২৭ জুন তারিখে তিনি জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জাতীয় মুক্তমঞ্চের কার্যক্রম শুরু করবেন। তিনি আমাকে সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার ব্যাপারে অনুরোধ জানালেন। অনুষ্ঠানে যাওয়া-না-যাওয়া নিয়ে আমার কোনো ভাবনা ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশের নামকরা সবগুলো পত্রপত্রিকা ২০ জুনের পর থেকেই কর্নেল অলির রাজনৈতিক মঞ্চ নিয়ে একের পর এক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে থাকল। ফলে আমি আমার রাজনৈতিক উৎসাহ এবং সাংবাদিকসুলভ অনুসন্ধিৎসার জন্য কাউকে কিছু না বলেই ২৭ জুন বিকেল ৪টার সময় জাতীয় প্রেস ক্লাব অডিটোরিয়ামে গিয়ে উপস্থিত হই।

আমি যখন অনুষ্ঠানস্থলে হাজির হলাম তখন পুরো অনুষ্ঠানস্থল লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়েছে। পুরো অডিটোরিয়ামে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। সব সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকেরা উপস্থিত ছিলেন এবং তারা অজানা কারণে সবাই খুব যত্ম করে আমার ছবি তুললেন। তার পরদিন দেখলাম, সব পত্রপত্রিকা এবং টেলিভিশন মিডিয়ায় আমার সে দিনের উপস্থিতির খবর বেশ ফলাও করে ছেপেছে। উদ্ভূত অবস্থার প্রেক্ষাপটে আমি প্রমাদ গুনতে থাকলাম। কারণ কেউ কেউ প্রচার করছিলেন, কর্নেল অলি আহমেদের মুক্তমঞ্চ গঠনের সাথে বিএনপির কোনো যোগসূত্র নেই। কিন্তু অনুষ্ঠানের পরের দিন বিএনপি মহাসচিব যখন মুক্তমঞ্চ গঠনকে স্বাগত জানালেন তখন আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। অন্য দিকে, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও প্রচার সম্পাদক যথাক্রমে ওবায়দুল কাদের এবং ড. হাছান মাহমুদ যখন মুক্তমঞ্চের আত্মপ্রকাশকে ইতিবাচক বলে বিবৃতি দিলেন, তখন বেশ পুলক অনুভব করলাম। মুক্তমঞ্চের প্রধান এজেন্ডা ছিল বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির লক্ষ্যে আন্দোলনের কার্যক্রম শুরু করা। অন্য দিকে, সাংবাদিকদের কটাক্ষের জবাবে জামায়াতকে দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক শক্তি বলে স্বীকৃতি দেয়ার মাধ্যমে কর্নেল যে সাহস দেখালেন এবং তার সেই বক্তব্যের ব্যাপারে ওবায়দুল কাদেরের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া হয়তো আগামী দিনের রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

20 − seventeen =