ব্যাংক থেকে দেড় হাজার কোটি টাকা উধাও

0
727

খুলনা মহানগরীর লোয়ার যশোর রোডে (সার্কিট হাউসের সামনে) বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট ‘হাসান টাওয়ার’। এই ভবনের পাঁচটি ফ্ল্যাটের নামে-বেনামে মালিক ঢাকা ট্রেডিং হাউজিং লিমিটেডের কর্ণধার মো. টিপু সুলতান। আমদানি-রপ্তানির ঋণপত্র (এলসি) খুলে জালিয়াতির মাধ্যমে জনতা ব্যাংকের প্রায় ২৫১ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

অভিযোগ রয়েছে, ব্যাংকের ঋণের টাকায় খুলনার দৌলতপুরে অঢেল সম্পত্তি, ডুপ্লেক্স ভবন (পাশাপাশি দুটি দ্বিতল আবাসন ভবন), নগরীর ডাকবাংলা মোড়ে ইলেকট্রনিক্স পণ্য ব্যবসায় অর্থ বিনিয়োগ করেছেন টিপু সুলতান। একইভাবে খুলনার সোনালী ব্যাংক ও উত্তরা ব্যাংক থেকে প্রায় ১৫২ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ব্যক্তিগত সম্পত্তি গড়েছেন সোনালী জুট মিলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান এমদাদুল হোসেন বুলবুল। ২০১৭ সালে দুদক তার বিরুদ্ধে মামলা করলেও তাকে গ্রেফতার করা যায়নি। এরই মধ্যে তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্য বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। খুলনার মীরেরডাঙ্গা, বাগেরহাট কচুয়া ও ঢাকার বাসাবো এলাকায় তার বহুতল বাড়ি, কারখানা ও অন্যান্য সম্পদ রয়েছে।

ব্যাংকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রভাবশালীদের তদবির ও চাপের কারণে ২০০৮ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত খুলনায় ১১৩ জন পাট ব্যবসায়ীকে ঋণ দেওয়া হয়েছিল। তাদের মধ্যে ১০৮ জন ঋণখেলাপি। খুলনায় সোনালী ব্যাংকের ছয়টি শাখা থেকে ঋণ দেওয়া হয়েছিল প্রায় ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা রয়েছে ঋণখেলাপি। খুলনা সোনালী ব্যাংকের করপোরেট শাখা, দৌলতপুর কলেজ রোড শাখা ও স্যার ইকবাল রোড শাখার বিতরণকৃত ঋণের প্রায় শতভাগ খেলাপি। অভিযোগ রয়েছে, ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে নেওয়া ঋণের টাকা ব্যবসায় বিনিয়োগ না করে ব্যক্তিগত সম্পত্তি গড়ে তুলেছেন খুলনার অধিকাংশ ঋণখেলাপি। ব্যাংক কর্মকর্তা, একাধিক ডেভেলপার কোম্পানি ও দুদক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি খুলনা জেলার সাধারণ সম্পাদক শেখ আশরাফ উজ জামান জানান, খুলনায় অসৎ ব্যবসায়ীরা ঋণ নিয়ে বিলাসিতা করছে। পাশাপাশি অন্য খাতে সেই অর্থ ব্যয় করছে।

দুদক কয়েকটি ঘটনায় মামলা করলেও তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি ক্রোক করা হয়নি। তারা জামিনে বেরিয়ে আবারও ব্যাংক থেকে নতুন ঋণ নেওয়ার চেষ্টা করছেন। আইন অনুযায়ী খেলাপিদের নামে-বেনামের সম্পত্তি নিলাম করে ঋণের টাকা আদায় না করা হলে ব্যাংক খাতে বিপর্যয় নেমে আসবে। দুদক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালে প্রায় ১২৭ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সোনালী জুট মিলের মালিক এমদাদুল হোসেন বুলবুল ও সোনালী ব্যাংকের জেনারেল ম্যানেজার নেপাল চন্দ্র সাহা, ব্যাংকের খুলনা করপোরেট শাখার অ্যাসিস্ট্যান্ট অফিসার কাজী হাবিবুর রহমান, সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার শেখ তৈয়াবুর রহমান ও সাবেক ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার সমীর কুমার দেবনাথের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। একই বছরে প্রায় ৯৩ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দৌলতপুরের পাট ব্যবসায়ী সনজিত কুমার দাস ও সোনালী ব্যাংক দৌলতপুর শাখার দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা হয়।

এর আগে ২০১৬ সালে জনতা ব্যাংকের প্রায় ২৫১ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ঢাকা ট্রেডিং হাউজিং লিমিটেডের মালিক টিপু সুলতানের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। ওই বছরই খুলনার দৌলতপুরে নিজ প্রতিষ্ঠানের সামনে থেকে গ্রেফতার হন টিপু সুলতান। পরে তিনি উচ্চ আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে আসেন। এদিকে ঋণের টাকা পরিশোধ না করেই রুগ্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান হিসেবে আবারও নতুন ঋণ নেওয়ার চেষ্টা করছেন খেলাপিরা। এরই মধ্যে সোনালী জুট মিলস লিমিটেড ঋণের সুদ বাবদ ৪১ কোটি ৮০ লাখ টাকা মওকুফের জন্য সোনালী ব্যাংকে আবেদন করেছে। সোনালী ব্যাংক, খুলনা করপোরেট শাখার ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মুন্সী জাহিদুর রশীদ জানান, মেসার্স সোনালী জুট মিলস লিমিটেডের পক্ষ থেকে ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই ঋণ মওকুফের আবেদন করা হয়েছে। আবেদনটি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে থেকে খুলনায় পাঠানো হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। দুদকের খুলনা জেলা সমন্বিত কার্যালয়ের উপ-পরিচালক নাজমুল হাসান জানান, খুলনায় ব্যাংকের টাকা আত্মসাতের বেশ কয়েকটি ঘটনায় দুদক মামলা করেছে। তদন্তকালে আসামিদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিষয়ে খোঁজ-খবরও নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে কয়েকটি মামলায় আদালতে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দেওয়া হয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

18 − four =