মুক্তমঞ্চ: নিউক্লিয়াস, সিরাজ ও রব প্রতিক্রিয়া

0
881

ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী: ‘বঙ্গবন্ধু, সিরাজুল আলম খান ও নিউক্লিয়াস’ শিরোনামে আ স ম আবদুর রবের একটি লেখা সমকালের মুক্তমঞ্চে ৫ জুলাই ২০১৯ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখাটি শুরু করেছেন এবং মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তি সংগ্রামকেন্দ্রিক দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান কার্যাবলির কথা বলে সিরাজুল আলম খানকে ‘স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের অদৃশ্য সব কর্মকাণ্ডের নায়ক বলেছেন, স্বাধীনতার স্বপ্নের সারথি বলেছেন’; তরুণ ছাত্র ও যুব সমাজকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করার প্রেরণাদাতা বলেছেন। বঙ্গবন্ধু উপাধির পরিকল্পনা, পতাকা উত্তোলন, ইশতেহার পাঠ, জয় বাংলা স্লোগান প্রবর্তন, জয় বাংলা বাহিনী গঠন, বিএলএফ গঠনসহ যুব সমাজের মননে স্বাধীনতার স্বপ্ন বুনন করার অসাধ্য কর্মকাণ্ডেরও অদৃশ্য নায়ক সিরাজুল আলম খানকে বলেছেন। মনে হচ্ছে, আ স ম রব তার আগের বক্তব্য বা কথাবার্তা থেকে কিছুটা বিচ্যুত হয়েছেন; দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান বলে দুটি ধারণার অবতারণা অভিনব। তিনি দেড় দশক আগে বলেছিলেন, জয় বাংলা স্লোগানের উদ্ভাবক, পতাকার অনুমোদন দাতা, পতাকা উত্তোলনের নেপথ্য নায়ক, জাতীয় সঙ্গীতের নির্বাচক হলেন সিরাজুল আলম খানের নিউক্লিয়াস। তিনি সিরাজুল আলম খানকে স্বাধীনতার স্থপতি, স্বাধীনতার রূপকার, ৭ মার্চের ভাষণের প্রণেতা, ৬ দফার রূপকার ইত্যাদি ভূমিকায় দেখেছেন। তার প্রকাশের ভাষা ও ভঙ্গিটা এমন ছিল যে, তিনি বঙ্গবন্ধুকে শুধু অবমূল্যায়ন নয়, একান্ত অবহেলার চোখে দেখেছেন। এবার বিবেক-বিবেচনাকে আর একটু শানিত করে একটি আবেগঘন-আবহঘন পরিবেশ সৃষ্টি করে তার আগের কথাগুলোর সঙ্গে নতুন কিছু মিশিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে পরোক্ষ সমরে নেমেছেন। লড়াইয়ের কৌশল বদলে ঈপ্সিত লক্ষ্য প্রায় অপরিবর্তিত রেখেছেন।

আ স ম আবদুর রব সমকালে প্রকাশিত সিরাজুল আলম খান ও নিউক্লিয়াস প্রসঙ্গে যেসব কথা বলেছেন, তা তিনি আগেও বলেছেন। এরশাদ আমলে বিরোধীদলীয় নেতা থাকা অবস্থায় তিনি পতাকা উত্তোলনকারী হিসেবে তার স্বীকৃতিও চেয়েছিলেন। উপলক্ষ আসলেই তিনি তার এ কথার পুনরাবৃত্তির সঙ্গে আরও কথা ছুড়ে দেন। ২০০২ সালে নূরে আলম সিদ্দিকীকে কটাক্ষ করতে গিয়ে তিনি যা বললেন, তাতে একমাত্র স্বাধীনতার ঘোষক ও ৭ মার্চের ভাষণের প্রণেতা ছাড়া বাংলাদেশ প্রসঙ্গে সব মঙ্গলময় বিষয়কে সিরাজুল আলম খান ও নিউক্লিয়াসের কৃতিত্ব বলে জাহির করেন।

আ স ম রব বাংলাদেশ নামকরণ, জাতীয় সঙ্গীত এবং জয় বাংলা স্লোগানের উদ্ভাবক হিসেবে নিউক্লিয়াস ও তার রূপকার সিরাজুল আলম খানকেই সব কৃতিত্ব দিয়ে বসে আছেন। এই নিউক্লিয়াস প্রসঙ্গে রাজ্জাকের কথা প্রণিধানযোগ্য। তিনি এক সাক্ষাৎকারে একবারও নিউক্লিয়াস কথাটা বলেননি এবং সিরাজুল আলম খানকে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের প্রধান নেতা বা রূপকার বলেননি, বলেছেন তাত্ত্বিক। কাজী আরেফও প্রায় একই কথা বলেছেন এবং ঘাতক দালাল নির্মূল আন্দোলন ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকালে তিনি নিজেকে নিউক্লিয়াসের অন্যতম সদস্য ও নির্মূল আন্দোলনের রূপকার বলতে আমাদের বাধ্য করতেন। তিনি আবদুর রাজ্জাককে নিউক্লিয়াসের অন্যতম সদস্য বললেও জনসভার ভাষণে কখনও সিরাজুল আলম খানের কথা বলেননি। সে সময় আমিও নিউক্লিয়াস সম্পর্কে তেমন গ্রহণযোগ্য কোনো কথা শুনিনি।

সিরাজুল আলম খানের মতে, স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ হলো নিউক্লিয়াসের অপর নাম। এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সামনে রেখে ও তার জ্ঞাতসারে এবং কেউ কেউ বলেন, পরামর্শে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ গঠিত হয়। সিরাজুল আলম খানের ভাষ্যে জানা যায়, স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ ও তাদের তিনজনের নিউক্লিয়াস একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ ছিল। কাজী আরেফের ভাষায় তারা তিনজন প্রথমে স্বাধীন বিপ্লবী পরিষদ ও পরে নিউক্লিয়াস গঠন করেন। সিরাজুল আলম খান ও রাজ্জাক উভয়ে আবুল কালাম আজাদকে তাদের চতুর্থ সদস্য হিসেবে বললেও পরে জানা গেছে, চট্টগ্রামের আবদুল মান্নানও নিউক্লিয়াসের সদস্য ছিলেন। তাছাড়া পরবর্তীকালে অনেকেই তাদেরকে মূল সংগঠনের সদস্য দাবি করলেও সিরাজুল আলম খান তাদের সহযোগীর বেশি কিছু বলেননি। মান্নান, শেখ মনিও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অতি বিশ্বস্ত ছিলেন, বিশ্বস্ত ছিলেন কাজী আরেফ ও আবদুর রাজ্জাকও। বিশ্বস্ত ছিলেন বলেই রাজ্জাক আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের দায়িত্ব পেয়েছিলেন।

এক পর্যায়ে সিরাজুল আলম খানের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে মান্নান তাদের সংস্পর্শ ত্যাগ করেন। তিনি নিউক্লিয়াসকে কন্ট্রাক্ট পয়েন্ট জাতীয় কিছু বলেন। তিনি আরও বলেন, ছাত্রলীগে গ্রুপিংয়ের উপাদান ও প্রেসার গ্রুপ সৃষ্টি করে অসাধ্য অর্জনই ছিল তথাকথিত নিউক্লিয়াসের উদ্দেশ্য। মহিউদ্দিনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে সিরাজুল আলম খানও বলেছেন, নিউক্লিয়াস ছিল কন্টাক্ট পারসন। সিরাজুল আলম খানের কন্টাক্ট পারসনদের সঙ্গে তার একধরনের ক্লায়েন্ট প্যাট্রোন সম্পর্ক বা পীর-মুরিদের সম্পর্ক বা যাচক-পৃষ্ঠপোষকের সম্পর্ক ছিল। কৌশলে তাদের সিরাজ শুধু দলে নয়, বিভিন্ন কলেজ সংসদ ও ডাকসু নির্বাচনে প্রোথিত করেন। তাদের দৃশ্যমান ও অপরিহার্য করার প্রয়াসে তিনি তাদের দিয়ে অতি বিপ্লবী স্লোগান ও অতি বাম চরিত্রের সংগঠন গড়ে তুলতে প্রয়াসী হন। তার নিজের কথায় আমরা জানি, আফতাব প্রথম জয় বাংলা স্লোগান দেন এবং সমাজতন্ত্রের ধারণাটা স্বপন চৌধুরী প্রচার করেন। তিনি ছাত্রলীগে মনিপন্থিদের ৬ দফাপন্থি বা স্বায়ত্তশাসনপন্থি বলে তার অনুসারীদের মনিবিমুখ করার প্রয়াস চালাতেন।

মুক্তিযুদ্ধকালে প্রথমে শেখ মনির সন্তুষ্টির জন্য তিনি মুজিববাদ প্রচার করেন এবং পাশাপাশি শিষ্যদের কৌশলগত অবস্থানে বসিয়ে তাদের দিয়ে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ধুয়া তোলেন। কিন্তু বিসমিল্লায় গলদ ছিল। তার সঙ্গে জেনারেল উবানের সখ্য ও ভারতের মার্কিনপন্থি কমিউনিস্টদের সখ্য তার আসল চরিত্র প্রকাশ করে। কথাটা আমার নয়, আবদুর রাজ্জাকের। আবদুর রব ভালোভাবেই জানেন, বিএলএফের প্রারম্ভিক নাম ছিল বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট। যুদ্ধ যখন অত্যাসন্ন হয়ে পড়ে, তখন ‘৭১-এর ১৮ জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু সবাইকে ডাকিয়ে এবং সব সক্রিয় সংগঠনকে আপাতত বিলুপ্ত করে একটি অভিন্ন কমান্ডে আনার নির্দেশ দেন। তখন মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনে বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্টকে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স নামকরণ করা হয়। এই ফোর্সে সিরাজ, রাজ্জাক ও তোফায়েল মনির সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। মজার ব্যাপার হলো, রাজ্জাক আগ থেকে বিএলএফ সম্পর্কে অবগত ছিলেন এবং বিএলএফের কার্যক্রমে জড়িয়ে ছিলেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিএলএফকে একটি সশস্ত্র সংগঠন হিসেবে রূপান্তরের পূর্বরাগ হিসেবে রাজ্জাককে দিয়ে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়েছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধ অত্যাসন্ন হয়ে পড়ায় অস্ত্র ও ট্রেনিংয়ের জন্য ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পূর্ণ যোগাযোগ স্থাপিত হলো। চিত্তসুতার ও ডা. আবু হেনাকে কাজে লাগাতে হলো আর স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীসহ সব সহযোগী ও অনুগত বাহিনী মিলিয়ে এবার ফ্রন্টের বদলে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স গঠন করলেন। সংক্ষেপে কিন্তু তা বিএলএফই রয়ে গেল। ১৯৭১ সালে ভারতের বুকে তার নামকরণ হলো ‘মুজিব বাহিনী’। এই বাহিনী গঠন, কার্যক্রম, সফলতা বা বিফলতা নিয়ে সিরাজ তেমন কিছু লেখেননি; কিন্তু ইতিহাস তো থেমে থাকে না। সত্যি উদ্ঘাটিত হবেই, অপেক্ষায় আছি।

যে বিএলএফ সম্পর্কে আমি ১৯৬২ সালের দিকে জেনেছি; যে বিএলএফ সম্পর্কে রাজ্জাক অন্তত ১৯৬৬ সালে জানতেন, সে বিএলএফের জন্ম ১৯৬৯ সালে কিংবা ভারতের বুকে হতেই পারে না, যদিও এ কথা অনেককে বলতে শুনি।

আর একটি কথা বলা প্রয়োজন। সিরাজুল আলম তার গ্রন্থে আহমদ শরীফকে নিউক্লিয়াসের পরামর্শক বলেছেন। অথচ আহমদ শরীফ কস্মিনকালেও সে কথা বা সিরাজের নাম কোথাও তুলে ধরেননি। বলেছেন আবদুল আজিজ বাগমারের অপূর্ব সংসদের কথা। সিরাজুল আলম খান বাগমারকে ডিবি পুলিশের এজেন্ট বলেছেন এবং তার বন্দিত্বের জন্য তাকেই দায়ী করেছেন। এ থেকেও নিউক্লিয়াস আর তার প্রধান প্রবক্তা সিরাজুল আলম খান সম্পর্কে কথা থেকে যায়।

বলা হচ্ছে, বিএলএফ বা তাদের ভাষায় বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স নাকি নিউক্লিয়াস থেকে জন্ম হয়েছে এবং তাকে জনপ্রিয় করার জন্য দেয়ালে দেয়ালে চিকা মারা হচ্ছিল। তাহলে সন্তানের পরিচয় প্রকাশের আগে পিতার পরিচয়টি কেন তুলে ধরা হলো না? কমপক্ষে ‘৬৯ সালে যখন বিএলএফে যোগদানের আহ্বান জানিয়ে চিকা মারা হচ্ছিল, তখন নিউক্লিয়াস নিয়ে দু’চারটি কথাও বলা যেত কিংবা কিছু লেখাজোখা আসতে পারত। এমন কিছুই যখন হলো না, তখন তাকে নেহাত চমক সৃষ্টির উপাদান হিসেবে অথবা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ১৯৭২ সালের ছাত্রলীগের সম্মেলনে আনা হলো বললে ভুল কতটা হবে? সিরাজ ভক্তরা অতীতে এমন কথাও বলেছেন যে, শেখ মুজিব হচ্ছে সিরাজের সৃষ্টি। এসবই গলাধঃকরণ অযোগ্য প্রসঙ্গ বা দাওয়াই। তাই হয়তো এবার আবদুর রব সেগুলো ক্যাপসুল আকারে হাজির করলেন।

অধ্যাপক, মুক্তিযোদ্ধা; ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের উপাচার্য
সুত্র-সমকাল

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

six − 4 =