ফেয়ারওয়েলের পরেও ইইডি’র প্রধান প্রকৌশলী পদের মায়ায় হানজালা

0
730

বিশেষ প্রতিবেদন
শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী দেওয়ান মোহাম্মদ হানজালা মুক্তিযোদ্ধার বিতর্কিত সনদবলে দিত্বীয় দফা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ শেষে গত ৭ আগস্ট আনুষ্ঠানিক বিদায় নেয়ার পরও চেয়ারের মায়া ছাড়তে পাছেননা। তিনি আরেক দফা চুক্তির মেয়াদ বাড়াতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন । অন্য প্রকৌশলীদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার বঞ্চিত করে শিক্ষামন্ত্রণালয় তাকে বার বার চুক্তিভিত্তি নিয়োগ দেয়ায় অধিদপ্তর জুড়ে চাপা অসন্তোষ বিরাজ করছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চতুর্থবার তাকে প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রদান করতে শিক্ষামন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে প্রস্তাবনা পাঠিয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী তাকে নিয়োগদানে অধিকতর আগ্রহী বলে ফাঁস হয়ে পড়ায় কর্মকর্তা কর্মচারিরা বিস্মিত। প্রস্তাব দ্রুত কার্যকরে মরিয়া হয়ে উঠেছেন সংশ্লিষ্টরা। এ জন্য নিয়োগ করেছেন লবিস্ট। সংশ্লিষ্টরা আশংকা করছেন, তিনি আবারো শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের শীর্ষ পদটিতে বসতে পারলে প্রতিষ্ঠানটির লুটপাটের মচ্ছব আরো বেড়ে যাবে।


এদিকে প্রধান প্রকৌশলীর পদে ধরে রাখতে শিক্ষা মন্ত্রী ডা. দীপুর মনির ঘনিষ্টজন হিসেবে পরিচিত নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল হাশেম সরদারকে কাজে লাগাচ্ছেন। হাশেম হানজালার কাছ থেকে বাড়তি সুবিধাভোগী প্রকৌশলীদের একজন। হাশেমের বাড়ি শিক্ষামন্ত্রীর এলাকায়। এই পরিচয়েই তিনি হানাজালার ঘনিষ্ট হয়ে ওঠেন। তার সঙ্গে ‘খাতির’ জমিয়ে ছোট-বড় অন্তত ৩৫টি প্রকল্পের দায়িত্ব বাগিয়ে নিয়েছেন। জনৈক ‘ডা. টিপু’কে দিয়ে হানজালাকে আরেক দফা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাইয়ে দেয়ার ঠিকাদারিটাও হাশেম করছেন বলে জানা গেছে। প্রধান প্রকৌশলীর আরেক বিশ্বস্ত নির্বাহী প্রকৌশলী মীর মুয়াজ্জেম। তিনিও ২০টির অধিক প্রকল্পের পরিচালক। এ দুই রতœই ক্যাশিয়ার হিসেবে সারা দেশের ৩৮টি জোন ও প্রকল্প থেকে পার্সেন্টেজ আদায় করেন।


দীর্ঘদিন প্রধান প্রকৌশলীর চেয়ারে থাকার সুবাদে গড়ে তুলেছেন শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি হয়ে আছে গোটা শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর (ইইডি)। টেন্ডার, বদলি বাণিজ্য ছাড়াও দাফতরিক অনেক কর্মকান্ড কর্মকর্তা-কর্মচারী আর বহিরাগতের সমন্বয়ে সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে। এতে একদিকে সরকারী অর্থের হরিলুট চলছে, অন্যদিকে প্রতিষ্ঠান অভ্যন্তরে বিরাজ করছে হ-য-ব-র-ল অবস্থা। এ নিয়ে সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। তবে সিন্ডিকেটের নেপথ্যে খোদ শীর্ষ কর্মকর্তার মদদ থাকার কারণে তাদের অপকর্ম নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য নেই। বরং দুই-একটি কেলেংকারীর ঘটনা ফাঁস হলেও নানা কায়দায় সেসব ধামাচাপা দেয়া হচ্ছে।


জানা গেছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভৌত-অবকাঠামো উন্নয়ন, নতুন ভবন নির্মাণ, পুনঃনির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত ও সংস্কারসহ আসবাবপত্র সরবরাহের মতো বিষয়গুলো এই অধিদফতরের দায়িত্বে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই এসব কাজে দুর্নীতির অভিযোগ আছে। দেওয়ান মোহাম্মদ হানজালা ইইডি’র প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই শুরু হয় এ সিন্ডিকেটের রাজত।ভাই-ভাবীসহ পরিবারের কয়েকজন সদস্য আর ক্ষমতাসীন দলের কতিপয় নেতানামধারী সব কাজের নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে। ইইডি পরিণত হয় প্রধান প্রকৌশলীর পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে। অনুসন্ধানে জানাযায়, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণ, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও মেরামতসহ বিভিন্ন কাজ যেসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পেয়েছে, সেগুলোর বেশিরভাগেরই মালিক প্রধান প্রকৌশলী হানজালার বড় ভাই, ছোট ভাই, ছোট ভাইয়ের শ্যালক, ছোট ভাইয়ের বন্ধু, ছোট ভাইয়ের স্ত্রী, খালাতো ভাই এমনকি নিজের বন্ধু।


এব্যাপারে বিস্তর অভিযোগ এমনকি গণমাধ্যমে বহু সংবাদ প্রকাশের পরও অবস্থার হেরফের হয়নি। বরং হাইভোল্টেজ তদ্বির চালিয়ে দেওয়ান হানজালা নিজের ক্ষমতাকে আরো পোক্ত করেন। সে সময় মন্ত্রণালয়ের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক গড়ে তুলে তিনি ফায়দা লুটেছেন। এ সুবাদে ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে নিয়মিত চাকরির মেয়াদ শেষ হলে মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সনদ দিয়ে তিনি চাকরির মেয়াদ প্রথমে এক বছর বাড়িয়ে নেন। পরবর্তীতে একই পদ্ধতিতে প্রথমে একবছর ও পরে দুই বছরের জন্য তিনি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাগিয়ে নেন। অভিযোগ রয়েছে, টাকা দিয়ে ভুয়া সনদ সংগ্রহ করেই শেষ সময়ে এসে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করেন দেওয়ান মোহাম্মদ হানজালা। তার দাবির বৈধতা নিয়ে উচ্চআদালতে একটি মামলা এখনও বিচারাধীন রয়েছে।


ইইডি’র নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, শিক্ষা খাতে মোট বাজেট বরাদ্দের ৮০-৮৫ ভাগ অর্থ ব্যয় হয় অবকাঠামো উন্নয়নে। আর পুরো কাজের দায়িত্ব শিক্ষা প্রকৌশলের। কিন্তু সিন্ডিকেটের টেন্ডারবাজি ও দুর্নীতির কারণেই কাঙ্খিত উন্নয়ন হচ্ছে না। বরং অনেক কাজই হচ্ছে নিম্নমানের। ইইডি সংশ্লিষ্টরা জানান, বিভিন্ন নির্মাণ কাজ উল্লিখিত সিন্ডিকেটের সদস্যদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তির মাধ্যমেই রফা হয়ে থাকে। ওই ব্যক্তি প্রধান প্রকৌশলীর ভাই আবদুল হাই। এই ব্যক্তিকে কখনো নামে আবার কখনো বেনামে কাজ দেয়া হয়েছে।


সূত্র জানায়, শিক্ষা প্রকৌশলের বিভিন্ন টেন্ডার সুষ্ঠু যাচাই করলেও হরিলুটের প্রমাণ মিলবে। সম্প্রতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) একটি ভবন নির্মাণের বরাদ্দ থেকে ৭ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ তুলেছেন খোদ প্রকল্পের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী। অভিযোগ মতে, ৬ তলা অ্যাকাডেমিক ভবন নির্মাণের মূল দরপত্রে প্রতি তলায় ‘শিডিউল আইটেম’ মোজাইক লাগানোর কথা থাকলেও তার বদলে কম দামের টাইলস ব্যবহার করা হয়েছে। প্রথম দরপত্রে মোজাইকসহ ৬ তলা ভবন নির্মাণের জন্য প্রতি তলার ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫ কোটি দুই লাখ টাকা। সে হিসাবে ছয়তলার জন্য ব্যয় হওয়ার কথা ৩০ কোটি ১২ লাখ টাকা। কিন্তু প্রধান প্রকৌশলী হানজালার হস্তক্ষেপে দর নির্ধারিত হয় ৩৭ কোটি ৪০ লাখ টাকায়, যা প্রাক্কলিত ব্যয়ের চেয়ে সাত কোটি টাকা বেশি। ২০১৬ সালের ২৩ নভেম্বর এক চিঠিতে পরে ওই প্রকল্পের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন দ্য বিল্ডার্স নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পরেও হানজালার হস্তক্ষেপে সেখানে টাইলস বসানো হয়েছে।


ইইডির গত ১০ বছরের বিভিন্ন নির্মাণ ও সংস্কার কাজের ব্যাপারে তদন্ত হলে সব অনিয়ম বেরিয়ে আসবে। বিশেষ করে উন্নয়ন কাজে কমিশন বাণিজ্য, সর্বনিম্ন দরদাতাকে জোরপূর্বক টেন্ডার প্রত্যাহার করানো, প্রকল্প পিছিয়ে বাজেট বাড়ানো, নির্মাণকাজে অবহেলা, ভুতুড়ে কাজের নামে বিল ও ভুয়া ভাউচার তৈরি করে সরকারি অর্থ আত্মসাতসহ নানা অনিয়ম বেরিয়ে আসবে।


সম্প্রতি গাড়ি ক্রয় নিয়েও ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ ওটেছে। জানা গেছে, গত জুন মাসে টেন্ডার জালিয়াতির মাধ্যমে ২৩টি জীপ গাড়ি ক্রয় করে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। নির্দিষ্ট একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগসাজস করেই পাতানো টেন্ডার করা হয়। গাড়িগুলো জুন মাসে ডেলিভারী নিলেও টেন্ডার কমিটির সদস্যগণ গাড়ি পরিদর্শনের নামে জুলাই মাসে জাপান সফর করেন। এর আগে প্রগতির কাছ থেকে ৬টি সুজুকি ভিটারা জীপ ক্রয় করা হয় প্রতিটি ৫৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা দরে। অথচ একই গাড়ি উত্তরা মোটরস বিক্রি করছে প্রতিটি ৪২ লাখ দরে। এ গাড়িগুলো নিয়মবহির্ভূতভাবে ডিপিএম এর মাধ্যমে ক্রয় করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এদিকে ‘নির্বাচিত বেসরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহের উন্নয়ন প্রকল্প’ এবং ‘নির্বাচিত বেসরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ প্রকল্প’-এর জন্য দুইটি মাইক্রোবাস ক্রয়েও অনুরূপ কায়দায় দুর্নীতি করে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। তাছাড়া জ্বালানি খরচ ও গাড়ি মেরামত দেখিয়েও চলছে হরিলুট।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

3 + nine =