‘অসদাচরণের’কারনে তিন বিচারপতির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান

0
702

‘অসদাচরণের’ অভিযোগের অনুসন্ধান শুরুর পর হাইকোর্ট বিভাগের তিন বিচারপতিকে বিচার কাজ থেকে সাময়িকভাবে বিরত থাকতে বলেছেন সুপ্রিমকোর্ট। এ সিদ্ধান্ত ওই তিন বিচারপতিকে অবহিত করার পর তারা ছুটি চেয়েছেন।

এ তিন বিচারপতি হলেন- বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী, বিচারপতি একেএম জহিরুল হক এবং বিচারপতি কাজী রেজাউল হক।

বৃহস্পতিবার সুপ্রিমকোর্টের নিয়মিত কার্যতালিকায় নির্ধারিত বেঞ্চে তাদের নাম ছিল না। আদালতের বিচারিক কার্যক্রমেও তারা অংশ নেননি।

তিন বিচারপতির বিরুদ্ধে তদন্তের বিষয়টি নিয়ে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে নানা গুঞ্জন চললেও সুপ্রিমকোর্ট বা আইন মন্ত্রণালয়ের কেউ মুখ খুলছিলেন না। এদিন সুপ্রিমকোর্টের এ পদক্ষেপ নিয়ে বিভিন্ন মিডিয়ায় খবর আসছিল। শেষ পর্যন্ত বিকালে সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিশেষ কর্মকর্তা সাইফুর রহমান সাংবাদিকদের সামনে এসে আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

তিনি বলেন, ‘মাননীয় তিনজন বিচারপতির বিরুদ্ধে প্রাথমিক অনুসন্ধানের প্রেক্ষাপটে মহামান্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে পরামর্শক্রমে তাদের বিচারকার্য থেকে বিরত রাখার সিদ্ধান্তের কথা অবহিত করা হয় এবং পরবর্তীতে তারা ছুটির প্রার্থনা করেন।’

এ সময় সাংবাদিকরা তিন বিচারপতির নাম জানতে চাইলে সাইফুর রহমান প্রথমে নিরুত্তর থাকেন। তখন তিন বিচারকের নাম (বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী, বিচারপতি একেএম জহিরুল হক এবং বিচারপতি কাজী রেজাউল হক) উল্লেখ করে জানতে চাওয়া হয়- তারা কিনা। ওই সময় সুপ্রিমকোর্টের মুখপাত্র সাইফুর রহমান বলেন, ‘আপনারা তো লিখেছেনই।’ তবে তিন বিচারকের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলতে রাজি হননি সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসনের এ কর্মকর্তা।

প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এ কার্যতালিকা করে বিচারপতিদের এখতিয়ার ও অধিক্ষেত্র ভাগ করে দেন। আগের দিন বুধবার ওই তিন বিচারপতির বেঞ্চ ও এখতিয়ার ছিল। তারা দেওয়ানি মামলার রুল ও আবেদন শুনতেন। মূল ভবনের ১০ নম্বর এজলাসে বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দ দ্বৈত বেঞ্চে বসতেন। বিচারপতি কাজী রেজাউল হক মূল ভবনের ৬ নম্বর এজলাসে এবং বিচারপতি একেএম জহিরুল হক একই ভবনের ৩০ নম্বর এজলাসে বসতেন।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘তিন বিচারপতির বিচার কাজ থেকে বিরত থাকার বিষয়ে আমি অবগত নই। আর এ কারণে অবগত নই যে, বাংলাদেশের বিচার বিভাগ স্বাধীন এবং এটা রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতির বিষয়। আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে আমাকে আগে অবগত হতে হবে।

তবে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম তিন বিচারপতির বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগের অনুসন্ধান বিচার বিভাগের অন্যদের জন্য একটি বার্তা বলে মন্তব্য করেন। এছাড়া সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার এম আমীরুল ইসলাম বলেন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত এবং ব্যবস্থা নিতে পারে।

অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, বর্তমানে আমাদের বিচারকদের ভেতরে যদি কোনো অসদাচরণের অভিযোগ আসে সেটা কোন প্রতিষ্ঠান নিষ্পত্তি করবে সে ব্যাপারে আমরা এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নই। সুপ্রিমকোর্ট বারের সভাপতি এম আমিন উদ্দিন বলেন, প্রধান বিচারপতি এবং মহামান্য রাষ্ট্রপতি এ দু’জনের মধ্যে যে অতি গোপনীয় বিষয় নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সে বিষয়ে আমার কোনো ব্যক্তিগত ধারণা নেই।

সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘হাইকোর্টের তিনজন বিচারপতির বিরুদ্ধে প্রধান বিচারপতি পদক্ষেপ নিয়েছেন। এ পদক্ষেপকে আমি স্বাগত জানাই।’

বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ২০০২ সালের ২৯ জুলাই হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারপতি নিযুক্ত হন। ২ বছর পর স্থায়ী বিচারপতির শপথ নেন তিনি। বিচারপতি কাজী রেজাউল হক ও বিচারপতি একেএম জহিরুল হক ২০১০ সালের ১৮ এপ্রিল অতিরিক্ত বিচারপতি নিযুক্ত হন এবং ২০১২ সালের ১৫ এপ্রিল স্থায়ী বিচারপতি হন তারা।

এর আগে ১৬ মে নিম্ন আদালতের মামলায় ডিক্রি বাতিলের অভিযোগ উঠে হাইকোর্টের বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি একেএম জহুরুল হকের বেঞ্চের বিরুদ্ধে। সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের শুনানিতে রায় বাতিলের এ অভিযোগ করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

জানা যায়, ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে ৩৬ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছিল এমআর ট্রেডিং। সেই ঋণ খেলাপি হওয়ায় ন্যাশনাল ব্যাংক অর্থঋণ আদালতে এমআর ট্রেডিংয়ের বিরুদ্ধে মামলা করে। সে মামলার কার্যক্রম চালু থাকাকালীন দু’পক্ষের মধ্যে আপসনামা হয় এবং সে অনুসারে টাকা মিলমিশ করে নিয়ে যাবে। এরপর তারা ওই আপসনামা অর্থঋণ আদালতে দাখিল করে সে অনুযায়ী ডিক্রি চান। কিন্তু অর্থঋণ আদালত সে আপসনামার ভিত্তিতে ডিক্রি জারি করেনি। এরপর ওই ডিক্রির বিরুদ্ধে এমআর ট্রেডিং হাইকোর্টে আবেদন জানায়।

সে আবেদনের শুনানি নিয়ে বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরীর বেঞ্চ রুল জারি করেন এবং আপসনামার ভিত্তিতে অর্থঋণ আদালতকে ডিক্রি জারির নির্দেশ দেন। এরপর পুনরায় অর্থঋণ আদালত ডিক্রি দেন এবং এমআর ট্রেডিং হাইকোর্ট থেকে জারি করা রুল উইথড্র করে নেন। পরে ন্যাশনাল ব্যাংক আপিল বিভাগে আসে।

গণমাধ্যমে তখন বিষয়টি প্রকাশ হলে হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার মো. গোলাম রব্বানী বিচারাধীন বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ না করতে বিজ্ঞপ্তি জারি করেন। পরে গণমাধ্যমের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিজ্ঞপ্তিটি প্রত্যাহার করেন সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল ড. মো. জাকির হোসেন।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

eighteen − twelve =