তেল চুরির প্রতিযোগীতা

0
852

স্টাফ রিপোর্টার: রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) তেলবাহী জাহাজ থেকে চুরি হচ্ছে হাজার হাজার লিটার জ্বালানি তেল। আর ব্যক্তি একাউন্ট ভারী হচ্ছে এক শ্রেণীর প্রভাবশালী তেল চোরের। প্রতিদিন সন্ধ্যা হলেই নারায়ণগঞ্জে পদ্মা ও মেঘনা অয়েল কোম্পানির ডিপোতে শীতলক্ষ্যা নদীর বুকে নোঙ্গর করা তেলের জাহাজের দিকে ধেয়ে আসে চোরা কারবারিরা। গভীর রাত পর্যন্ত চলে তাদের তেল চুরি। এই তেল চুরিতে ডিপো কর্মকর্তা ও জাহাজের লোকজনের জড়িত থাকার প্রমাণও পাওয়া গেছে বলে জানা যায়। নদীর দুই পাড়ে চোরাকারবারি চক্রগুলোর গড়ে তোলা অনেকগুলো অবৈধ দোকান হয়ে এ চোরাই তেল পৌঁছে যায় পাইকারি ও খুচরা গ্রাহকদের কাছে। ছোট দোকান, অয়েল ফিলিং স্টেশন, গাড়ির গ্যারেজ, বড় শিল্পকারখানা সব জায়গাতেই যায় এ চোরাই তেল। এ তেলের লাভ পায় সবাই শুধু লোকসান গুনে সরকারি প্রতিষ্ঠান বিপিসি।

বিপিসি সূত্র জানায়, বিদেশ থেকে আমদানি করা পরিশোধিত এবং অপরিশোধিত তেল চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঢাকা ও খুলনায় ছোট জাহাজযোগে বিতরণ কোম্পানির ডিপোতে সরবরাহ করে থাকে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন। চট্টগ্রাম থেকে যে পরিমাণ তেল জাহাজে ভরা (লোড) হয়, একই পরিমাণ তেল গন্তব্য ডিপোতে খালাস (আনলোড) করতে হয় জাহাজগুলোকে। কিন্তু ডিপোর এক শ্রেণির কর্মকর্তা এবং জাহাজের লোকজনের যোগসাজশে নিয়মিত তেল চুরি হচ্ছে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের গোদনাইলে পদ্মা ও মেঘনা অয়েল কোম্পানির ডিপোতে।

চুরি করা তেলে ওই এলাকায় গড়ে উঠেছে তেলের কালোবাজারি ব্যবসা। সম্প্রতি এই তেল চুরির প্রমাণ পেয়েছে বিপিসির নিজস্ব তদন্ত দলও। সূত্র জানায়, গত ফেব্রুয়ারিতে চট্টগ্রাম থেকে তেল নিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জে মেঘনা পেট্রোলিয়ামের (এমপিএল) ডিপোতে পৌঁছে এমিউস মেরিন সার্ভিসের মালিকানাধীন জাহাজ এমটি আবু সাদিক। লোডিং পয়েন্টের তেলের পরিমাণ এবং আনলোডিং পয়েন্টের তেলের পরিমাণে ১৫ হাজার লিটারের গড়মিল পান এমপিএলের এক কর্মকর্তা। চুরির কারণে এই গরমিল হয়েছে জানিয়ে তা খতিয়ে দেখার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) চিঠি দেন ওই কর্মকর্তা।

দুদক বিষয়টির সত্যতা প্রমাণের জন্য বিপিসির কাছে পাল্টা চিঠি দেয়। দুদকের চিঠির ভিত্তিতে ঘটনা যাচাইয়ে বিপিসি একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। গত ১৪ মার্চ তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। সেই প্রতিবেদনে চুরির সত্যতা পাওয়া গেছে। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে তেল চুরি প্রতিরোধে ১১টি সুপারিশ বাস্তবায়নের আহবান জানিয়েছে কমিটি। প্রতিবেদনে বলা হয়, এম টি আবু সাদিক জাহাজের সুপারভাইজার সৈয়দ আবুল আজাদ সিল ভেঙে ওই তেল ডিপোর বাইরে বিক্রি করেন। এর সঙ্গে মেঘনা পেট্রোলিয়ামের ডিপো ইনচার্জ খান নিজামুলও জড়িত ছিলেন।

কমিটি ডিপো ইনচার্জকে সাসপেন্ড করার সুপারিশ করেছে। একই সঙ্গে ওই জাহাজের সুপারভাইজারকে আগামী ছয় মাসের জন্য মেঘনা পেট্রোলিয়ামসহ অন্যান্য তেল বিপণন কোম্পানির পরিবহন বহরে যে কোনো ধরনের কাজ করা থেকে বিরত রাখার জন্য জাহাজ মালিককে ব্যবস্থা নিতে বলেছে। এ প্রসঙ্গে বিপিসির চেয়ারম্যান মো: সামছুর রহমান বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী ডিপো ইনচার্জকে তাৎক্ষণিক বরখাস্ত করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাও করা হয়েছে। বাকি সব ডিপোকেও সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, সিদ্ধিরগঞ্জে শীতলক্ষ্যার পাড়ে নামে-বেনামে জ্বালানি তেল সরবরাহ ও ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান খুঁজে পেয়েছে তদন্ত দল। কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী অবৈধ ট্রেডার্সগুলোকে উচ্ছেদের জন্য জেলা প্রশাসককে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তবে গত সপ্তাহে এ প্রতিবেদক ওই এলাকায় সরেজমিনে দেখতে পান, অবৈধ দোকানপাটগুলো উচ্ছেদ হয়নি। বহাল-তবিয়তেই কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এমনকি তদন্তে যেসব চোরাকারবারির নাম এসেছে তারা এবং তাদের অনুসারীরা ডিপো এলাকায় প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, উপজেলা নির্বাচনসহ নানা কাজে তারা ব্যস্ত ছিলেন তাই এদিকে নজর দেওয়া হয়নি। তেল চুরিতে জড়িত প্রভাবশালীরা! গোদনাইলে বছরের পর বছর ধরে তেলের চোরাকারবার চলছে। কিন্তু কোনো প্রতিকারমূলক বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। সরেজমিনে চিটাগং রোড থেকে ডেমরা-নারায়ণগঞ্জ সড়কের বার্মাস্ট্যান্ডে গোদনাইলে রাস্তার দুপাশে নামে-বেনামে অসংখ্য ট্রেডিং সাইনবোর্ড সাটানো তেলের দোকান চোখে পড়েছে।

এসব ট্রেডাসের অধিকাংশেরই পদ্মা কিংবা মেঘনা তেল কোম্পানির সঙ্গে কোনো চুক্তি নেই। এই এলাকা দুই নম্বর গেট নামে পরিচিত। এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, এই তেল কালোবাজারির সঙ্গে স্থানীয় নির্বাচিত-অনির্বাচিত অনেক নেতা ও তাদের কর্মী-অনুসারীরা জড়িত। চাইলেও সবসময় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। আবার বিপিসি বা পেট্রোলিয়াম ডিপোগুলোও এ ব্যাপারে তেমন অভিযোগ করে না। স্থানীয় সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম থেকে তেল নিয়ে গোদনাইল বন্দরে এসে তেল খালাস হওয়ার আগ পর্যন্ত যে কয়দিন জাহাজগুলো নদীতে অপেক্ষমাণ থাকে, প্রতিরাতেই এসব জাহাজ থেকে তেল চুরি হয়।

গোদনাইল দুই নম্বর গেটে জাহাজ থেকে সবচেয়ে বেশি তেল চুরি করে থাকেন সেখানকার প্রভাবশালী উকিল ভুঁইয়া এবং লক্ষণের লোকজন। জাহাজ থেকে তেল চুরির পর রাখা হয় নদীর তীরে ডিপোর পাশে টিনের শেডে তৈরি বিভিন্ন ঘরে। এসব ঘরের জানালাগুলো বন্ধ করে রাখা। পরে ওই তেল খোলাবাজারে বিক্রি করা হয়। স্থানীয়রা জানান, পদ্মা ও মেঘনার তেলের ডিপোর বিপরীতে শীতলক্ষ্যা নদীর ওপাশে বন্দর থানার উত্তরলক্ষণ খোলা গ্রামেও বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী দীর্ঘদিন ধরে তেল চুরির সঙ্গে জড়িত।

এদের কয়েকজন হলেন আক্তার হোসেন, আলী আহমদ এবং সিরাজ ভান্ডারী এবং আর ও আছেন বিখ্যাত তেল চোরা কারবারী রাজধানীর ধোলাই পাড়ে অবস্থিত মনির এন্ড সন্স নামক প্রতিষ্ঠানের মালিক হাজী আবদুল মনির হোসেন একজন চোরা তেল কারবারী। বিষটি অবগত আছেন আইন শৃংখলা বাহিনী। অন্য দিকে ডেমরা থানা অধীন বড় ভাংগা এলাকার বাসিন্দা আলহাজ্জ্ব নান্নু মন্সি। উক্ত ব্যক্তিও নারায়ন গঞ্জ ও সিন্ধিরগঞ্জ এলাকা চিহ্নিত তেল চোরের গড ফাদার হিসাবে আইন শৃংখলা বাহিনী সহ সাধারণ জনগণের কাছে পরিচিত বটে।

সূত্র মতে জানা গেছে-লেবাসধারী হাজী নান্নু মন্সি, মনির হোসেন দীর্ঘ বছর যাবৎ আইন শৃংখলা বাহিনীর সহযোগীতা নিয়ে তেল চোরাই ব্যবসা করে আসছেন। সরজমিনে দেখা গেছে এই দুই সিন্ডিকেটের হোতার অগনিত সহযোগী রয়েছে। উক্ত সহযোগীরা জাহাজ কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে প্রতিনিয়তই বড় জাহাজ থেকে ছোট ট্রলারে করে তেল নামানো হয়। উক্ত তেল গুলো প্রতিদিন এনে রাখা হয় নান্নু মন্সির নিজ ভবনের পাশে একটি গোডাউনে। অন্যদিকে ধোলাই পাড়ে হাজী মুনিরের গোডাউনে ও মৌজুদ করা হয় চোরাই তেল।

এখান থেকেই তাদের পরিচিত পাইকারী ও খুচরা বিক্রি করেন। সরজমিনে আর ও দেখা গেছে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইনশৃংখলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের টাকা দিচ্ছেন তেল চোর মনির ও নান্নু মন্সি। হাজী নান্নু মন্সি চোরাই তেলের ব্যবসা করে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। সিলেট এবং চট্টগ্রাম মহাসড়কে রয়েছে কয়েকটি তেলের পাম্প। উক্ত পাম্প গুলোতে প্রতি রাতেই তেল নিয়ে যাওয়া হয়। নান্নু মুন্সির বড় বাঙ্গার চোরাই তেলের গোডাউন থেকে। চোরাই তেলের অর্থ দ্বারা ডেমরা এলাকায় সমাজ সেবা মূলক অনেক কাজ করেছেন।

তার মধ্যে কয়েকটি মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিম খানাসহ নানাবিধ সামাজিক কাজে এবং বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষে সবজধা অর্জন করেছেন নান্নু মন্সি সমাজের কাছে একজন দানবীর ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। তবে বাংলাদেশের তেল চোর সিন্ডিকেটের একজন সুনাম ধন্য ব্যক্তি নান্নু মন্সি। এটা শুধু আইন শৃংখলাবাহিনীই একটু বেশি অবগত। ডেমরার বড় বাঙ্গার বাসিন্দা তোফাজ্জল হোসেন, লিয়াকত বক্স শফিক উল্লা, চানমিয়া জোমাদ্দার সহ অনেক ব্যক্তিরা জানায় নান্নু মন্সি তেল চোরের হোতা। এটা আমরা অনেকেই জানি।

সে চোরাই তেল ট্রলার দ্বারা তেল এনে তার বাসার পাশে একটি গোডাউনে একটি গোডাউনে রাখে তাসত্য ঐ খান থেকে প্রতি রাতেই তার নিজ তেলের পাম্পে নিয়ে যায়। সব চেয়ে বড় কথা নান্নু মন্সি র্যাব। পুলিশ সহ আইন শৃংখলা বাহিনী সকলকেই মালিক মাসহারা দিয়েই ব্যবসা করেন। অন্যদিকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়- যাত্রাবাড়ীর ধোলাইপাড় তেল চোরের হোতা হাজী মনির হোসেন। তিনি ও প্রতি রাত্রে ৪ ঘটিকার পরে তার নিজ গোডাউনে চোরাই তেল মৌজুদ করা হয়। এই চোরাই তেলের ব্যবসা করে মনির হোসেন কোটি কোটি টাকার মালিক তিনি লেবাজ ধারী চোরের হোতা সব সময় সমাজ সেবামূলক কাজে লিপ্ত থাকেন।

পূর্বে একবার মনিরকে ডিবি পুলিশ, সিআইডি র্যাব সহ আইন শৃংখলা বাহিনী হাতে-নাতে ধরে এনে সবার কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ দ্বারা ছাড় পায় তেল ছোর মনির। তবে তার ব্যবহার এবং অর্থ দ্বারা সকল আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা তার ভক্ত মুরিদ হয়ে গেছে।সব সময় তেল চোর মালিকের প্রতিষ্ঠানে ৫/১০ জন আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের দেখা যায়। ব্যাপারে জানতে তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কাউকেই পাওয়া যায়নি।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের চেয়ারম্যান মো: সামছুর রহমান বলেন, তেল চোরাকারবারের সঙ্গে জড়িত বলে যে নামগুলো এসেছে তাদের ব্যাপারে আরো তদন্ত করতে এবং তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য খতিয়ে দেখতে দুদককে অনুরোধ করা হয়েছে। পাশাপাশি মন্ত্রিপরিষদ সচিবের মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জের ডিসিকে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা ও নিয়মিত মনিটরিংয়ের জন্য অনুরোধ করা হয়েছ।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

ten + 17 =