প্রয়োজনে নয়ন বন্ড হমু, তবু মায়ের সঙ্গে আপস নাই

0
513

৮০ বছরের বৃদ্ধা মাকে নির্যাতন করে ঘর থেকে বের করে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগী মা ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিলে ক্ষিপ্ত হয়ে নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে দেয়।

একজন শিক্ষক নিজ হাতে মাকে ঘরের বাইরে ও প্রকাশ্য দিবালোকে বারবার মারপিট করায় বিষয়টি নিয়ে সর্বমহলে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষকের এমন আচরণে শিক্ষার্থীরা কী শিখছেন? এমন প্রশ্নও জনমনে।

বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার অভিযুক্ত ওই শিক্ষক হলেন মাসুদ আলম। তিনি উপজেলার কাকচিড়া ইউনিয়নের মৃত আলী আকবরের ছেলে। তিনি ৪৬ নম্বর শিংড়াবুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। বারবার নির্যাতন ও অপমান সহ্য করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বরাবর বিচার দাবি করেছেন বৃদ্ধা মা জাহানারা বেগম (৮০)।

বিভিন্ন পর্যায় থেকে সতর্ক হওয়ার কথা বলা হলেও মাসুদ মায়ের ওপর আরও ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, ‘প্রয়োজনে নয়ন বন্ড হমু, তবু মায়ের সঙ্গে আপস নাই।’ সম্প্রতি ইউএনও কার্যালয়ে মা জাহানারা ও অপর ভাইদের মুখ থেকেও তা প্রকাশ পায়।

ইউএনও’র কাছে অভিযোগ করার সময় জাহানারা সাংবাদিকদের জানান, স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে তিনি তার স্বামীর নির্মাণ করা ঘরে ছেলে মাসুদের সঙ্গে থাকেন। কিন্তু প্রায়ই তাকে ঘর থেকে নেমে যেতে বলেন এবং অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করেন মাসুদ ও তার স্ত্রী। সম্প্রতি মাসুদ ও তার স্ত্রী রুমা আক্তার এবং তাদের ছেলে ইফতি তাকে বেদম পিটিয়ে গুরুতর আহত করে ঘর থেকে বেরও করে দেন। বিষয়টি জাহানারা স্থানীয় সংসদ সদস্যকে জানালে তিনি মাসুদকে ডেকে সাবধান করে দেন। এরপর সংসদ সদস্য বাসা থেকে বের হয়ে গেলে পাথরঘাটা কলেজের সামনে আবারও মাকে মারপিট করেন ওই শিক্ষক।

স্থানীয় সূত্র জানায়, ইউএনওকে লিখিতভাবে জানালে মাসুদ ক্ষিপ্ত হয়ে ফের তার মা জাহানারাকে মারপিট করেন। এতে স্বামীর ঘরে ঠাঁই না পেয়ে বাড়ির পাশের দেবরের ঘরে আশ্রয় নেন তিনি। নির্যাতনের কারণ জানতে চাইলে মা জাহানারা বলেন, ‘জোর করে সম্পত্তি লিখে নিতে চাইলে তা না দেওয়ার কারণে আমাকে মারধর করে মাসুদ।’

এদিকে বৃদ্ধা মাকে মাসুদের শারীরিক নির্যাতনের বিষয়টিতে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও ও স্থানীয় শিক্ষক সমিতি। সংসদ সদস্য শওকত হাচানুর রহমান রিমন অভিযুক্ত শিক্ষক মাসুদের ব্যাপারে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে ইতোমধ্যে বিভাগীয় উপ-পরিচালক প্রাথমিক শিক্ষা বরিশালের বরাবর সুপারিশ করেছেন বলে জানান মা জাহানারা।

পাথরঘাটা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কবির বলেন, ‘যে শিক্ষক বৃদ্ধা মাকে পেটাতে পারেন, তার মতো শিক্ষক এ উপজেলায় দরকার নেই। মাসুদের ব্যাপারে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।’

কাকচিড়া ইউনিয়নের পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন পল্টু বলেন, ‘ইউএনও সাহেবের কথায় অভিযুক্ত মাসুদ ও তার মাকে স্থানীয়ভাবে মিলিয়ে দেওয়া চেষ্টা করা হয়। কিন্তু, মাসুদ তাতে রাজি না হয়ে বলেন- ‘প্রয়োজনে নয়ন বন্ড হমু, তবুও মায়ের সঙ্গে আপস নাই।’

পাথরঘাটা উপজেলা শিক্ষক সমিতির সভাপতি ছগির হোসেন বলেন, ‘যে শিক্ষক বৃদ্ধা মাকে পিটিয়ে ঘর থেকে বের করে দিতে পারেন, তিনি কী করে জাতি গড়বেন? মাসুদের কার্যকলাপ গোটা শিক্ষক জাতিকে কলুষিত করেছে।’

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে সব অভিযোগ অস্বীকার করে মাসুদ আলম বলেন, ‘জমি সংক্রান্ত ব্যাপারে মায়ের সঙ্গে আমার কিছুটা বিরোধ রয়েছে।’

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হুমায়ুন কবির বলেন, ‘শিক্ষক মাসুদের বিরুদ্ধে আগেও নানা অনিয়মের অভিযোগ পেয়েছি। আর প্রাথমিকভাবে মাকে নির্যাতনের ঘটনার সত্যতাও পাওয়া গেছে। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার অধীনে তদন্ত চলছে। তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেলে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হবে।’

বরগুনা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মিজানুর রহমান বলেন, ‘স্থানীয় সংসদ সদস্য সাহেবের ডিও লেটার আমি পেয়েছি, তবে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’ মাসুদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তিনি চাকরি হারাতে পারেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শৈশবে মাসুদের অসহ্য কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ হয়ে তার বাবা আলী আকবর ১৯৯০ সালের দিকে তাকে কাকচিড়া পুলিশ ফাঁড়িতে সোপর্দ করেন। মাসুদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ, মাদক ও সুদের ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগও রয়েছে স্থানীয় পর্যায়ে। এসব অপরাধে তাকে কারাবাসসহ জরিমানাও দিতে হয়েছে বলেও অভিযোগ শোনা যায়।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

17 − 2 =