ব্যাংকিং কার্যক্রমের অনুমতি তো দূরের বিষয়, সমবায় নিবন্ধনই ছিলো ভুয়া

0
592

ব্যাংকিং কার্যক্রমের অনুমতি তো দূরের বিষয়, সমবায় নিবন্ধনই ছিলো ভুয়া। অথচ উচ্চ সুদের প্রলোভন দেখিয়ে ৮ বছর ধরে প্রশাসনের নাকের ডগায় দি ঢাকা আরবান কো-অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেড নামের একটি ভুয়া প্রতিষ্ঠান হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা।

লাখ টাকায় ২ হাজার টাকা সুদের প্রলোভনের ফাঁদে পথে বসেছে লাখ লাখ গ্রাহক। ২০১৪ সাল থেকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধান করলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

অবশেষে গত ২৫ আগস্ট সংস্থাটির দায়ের করা প্রথম মামলা স্বপ্ন দেখাচ্ছে অপরাধীর সাজা ও গ্রাহকের টাকা ফেরতের।

অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসছে আত্মসাতের নতুন নতুন তথ্য। যার ভিত্তিতে ১২ থেকে ১৫টি মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে দুদক। শতাধিক আসামির তালিকায় ফাঁসছে সমবায় অধিদপ্তরের বর্তমান ও সাবেক মিলেয়ে বেশ কিছু শীর্ষ ব্যক্তিরা। যেখানে থাকছেন অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাও। আসামির তালিকায় থাকছে ব্যাংক কর্মকর্তাদেরও নাম। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের উর্ধ্বতন একটি সূত্র রাইজিংবিডিকে বিষয়টি নিশ্চিত করছে।

এ বিষয়ে দুদকের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা রাইজিংবিডিকে বলেন, দি ঢাকা আরবান কো-অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেড ১৯৬৯ সালে সমবায় প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখালেও কখনোই নিবন্ধিত হয়নি। অথচ সমবায় অধিদপ্তরের কিছু অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে সারাদেশে ৩৮টির মতো শাখা খুলে অবৈধভাবে ব্যাংকিং করে গেছে। দুদকের অনুসন্ধানে এ পর্যন্ত রাজধানীর মতিঝিল ও মিরপুর, ঢাকার বাইরে নারায়ণগঞ্জ, বাগেরহাট, খুলনা, জামালপুর ও ময়মনসিংহে আত্মসাতের প্রমাণ মিলেছে।

তিনি বলেন, এখন পর্য‌ন্ত প্রতিষ্ঠানটি রাজধানীর মিরপুর শাখা থেকে প্রায় ১৮ কোটি টাকা, ময়মনসিংহের গফরগাঁও শাখা থেকে ২০ কোটি, নারায়নগঞ্জ শাখা থেকে ৭০ কোটি, খুলনা ও বাগেরহাট থেকে প্রায় ১০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার তথ্য-প্রমাণ মিলেছে। সব মিলিয়ে আত্মসাতের পরিমাণ হবে অন্তত হাজার কোটি টাকা। দুদকের মামলার কথা শুনে প্রতিদিনই নতুন নতুন অভিযোগ জমা হচ্ছে।  অন্তত ১২ থেকে ১৮টি মামলার তথ্য-প্রমাণ মিলেছে।  তবে মামলার সংখ্যা আরো বাড়তে পারে।

আরবান কো-অপারেটিভ মিরপুর শাখায় ১৭ লাখ টাকা জমা রেখে পথে পথে ঘুরছেন গ্রাহক শেখ শওকত। রাইজিংবিডিকে তিনি বলেন, ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে আমি ১৭ লাখ টাকা সঞ্চয়ী হিসাবে জমা রেখেছিলাম। আমার আত্মীয়-স্বজন রেখেছে আরো ৪০ লাখ টাকা। প্রথম কয়েক মাস মুনাফা পেলেও তারপর আর কোনো টাকা পাইনি। এখন মুনাফা তো দূরের কথা, আসল ফেরত পেলেই সন্তুষ্ট। মিরপুর শাখায় প্রায় ১৯ হাজার গ্রাহক ছিল। সকলেরই একই অবস্থা। আমরা এর বিচার চাই।

এ বিষয়ে দুদক সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় ১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে আরবান কো-অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেডের বিরুদ্ধে দুদক সম্প্রতি একটি মামলা দায়ের করেছে। এ বিষয়ে অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। ভবিষ্যতে আমাদের আইনি পদক্ষেপ অব্যাহত থাকবে।’

১৯৪০ সালের সমবায় আইনের আওতায় আর্থিক কার্যক্রমে ১টির বেশি শাখা খোলার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও এ প্রতিষ্ঠান অন্তত ৩৮ জেলায় শাখা খুলে কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। একস্থানে বড় সাইনবোর্ড দিয়ে কার্যক্রম শুরু করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার কিছুদিন পরই বন্ধ করে অন্য জেলায় চলেছে অবৈধ ব্যাংকিং।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, দি ঢাকা আরবান কো-অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেড ১৯৬৯ সালের ২৭ অক্টোবর সমবায় প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিবন্ধন (নিবন্ধন নং-৭১০) দেখালেও কখনোই নিবন্ধিত হয়নি। এমনকি এ সংক্রান্ত কোনো নথি সমবায় অধিদপ্তরেও সংরক্ষিত নেই। শুধু কি তাই, ব্যাংকিং নামে কোনো নথি না থাকা সত্ত্বেও দীর্ঘ ৩৬ বছর পূর্বের ওই ভুয়া নিবন্ধন ও একটি ভুয়া লিকুইডেশন (অবসায়ন) নম্বর-৩৩৩৮ দেখিয়ে অসাধু কিছু সমবায় কর্মকর্তার যোগসজশে দি আরবান কো-অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেড সারা দেশে শাখা খুলে অবৈধ ব্যাংকিং শুরু করে। ১৯৬৯ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ৩৬ বছরে অজ্ঞাত প্রভাবে কোনো অডিট করেনি সমবায় অধিদপ্তর। ফলে প্রতারক চক্র থেকে গেছে আড়ালে ও বহাল তবিয়তে। শুধু তাই নয় অবৈধ সুবিধা দিয়ে সমবায় অধিদপ্তরের সাবেক কর্মকর্তারা পরবর্তী সময়ে সরাসরি আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন বলে দুদকের অনুসন্ধানে প্রমাণ মিলেছে।

দুদকের মামলায় দি ঢাকা আরবান কো-অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. রফিকুল আলম ও তার স্ত্রী প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি মিসেস তাহমিনা বেগমসহ সাত জনের বিরুদ্ধে প্রায় ১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। সংস্থাটির উপ-পরিচালক সেলিনা আখতার বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।

এর আগে প্রায় ২০ হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে ৭০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ নিয়ে ২০১৪ সালে মাঠে নেমেছিল দুদক। অনুসন্ধান পর্যায়ে ৪ বার অনুসন্ধান কর্মকর্তা বদল হয়। অধিকাংশ কর্মকর্তা আরবান কো-অপারেটিভকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে সনাক্ত করে অভিযোগ দুদকের তফসিলভুক্ত নয় বলে পরিসমাপ্তির সুপারিশ করেছিল। ২০০৬ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও এমডিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ ওঠে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

4 × one =