সুনামগঞ্জ সিভিল সার্জন অফিস যেনো দু’র্নীতির আখড়া

0
1005

সুনামগঞ্জ সিভিল সার্জন অফিস যেনো দু’র্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। অ’ভিযোগের তীর খোদ সিভিল সার্জনের বি’রুদ্ধে। শীর্ষ স্বাস্থ্য কর্মক’র্তার দু’র্নীতির কারণে জে’লার চিকিৎসাব্যবস্থা অনেকটাই ভেঙে পড়েছে বলে স্থানীয়দের অ’ভিযোগ।

তাকে অ’পসারণের দাবিতে আ’ন্দোলনেও নেমেছেন সুনামগঞ্জের বিভিন্ন স্তরের মানুষ। তবে কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। দিব্যি বহাল তবিয়তেই আছেন সিভিল সার্জন ডা. আশুতোষ দাস।

সুনামগঞ্জ বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে পদোন্নতি হলেও ঢাকায় গিয়ে তদবির করে সিভিল সার্জনের অ’তিরিক্ত দায়িত্ব নিয়ে এসে সামলাচ্ছেন নিজের দরবার। অ’ভিযোগ রয়েছে, সিভিল সার্জনের অ’তিরিক্ত দায়িত্ব নিতে তাকে ১৭ লাখ টাকা খরচ করতে হয়েছে। ডা. আশুতোষ দাসের বি’রুদ্ধে দু’র্নীতির অ’ভিযোগে মা’মলাও করেছে দুদক। সে মা’মলায় সোমবার তাকে ঢাকার বিশেষ জজ আ’দালত-৯ এ হাজির হতে বলা হয়েছে। মা’মলা’টি হয়েছিলো ২০১৪ সালে যখন আশুতোষ দাস সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে কর্ম’রত ছিলেন। সুনামগঞ্জের জে’লা প্রশাসকের কাছেও তার নামে অ’ভিযোগ গেছে।

সিভিল সার্জন ডা. আশুতোষ দাসের বি’রুদ্ধে অ’ভিযোগের অন্ত নেই। অ’ভিযোগ, বাইরের ক্লিনিকগুলোর সাথে যোগসাজশ করে তিনি সদর হাসপাতালের ডিজিটাল টেকনোলজি বন্ধ রেখেছেন। যাতে বাধ্য হয়ে রোগীরা বাইরে চিকিৎসা নেন। হাসপাতালের নতুন ভবনের জন্য যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্র কেনার জন্য ২৫ কোটি টাকার যে টেন্ডার আহবান করা হয়েছে তা কৌশলে তার সিন্ডিকে’টের লোকজনকেই পাইয়ে দিয়েছেন বলেও অ’ভিযোগ রয়েছে সিভিল সার্জনের বি’রুদ্ধে। গোলচত্বরের জন্য ফুল গাছ কেনার পুরো টাকাই নয়ছয় হয়েছে বলেও অ’ভিযোগ। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দুই অর্থবছর ধরে হাসপাতালের বিভিন্ন সেবা খাতে টেন্ডার হচ্ছে না। আউটসোর্সিংয়ের ক্ষেত্রে নবায়নের সুযোগ না থাকলেও বারবার একই প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

সুনামগঞ্জে সিভিল সার্জনদের বি’রুদ্ধে দু’র্নীতির অ’ভিযোগ নতুন কিছু নয়। এর আগে দু’র্নীতির অ’ভিযোগে কারাগারেও যেতে হয়েছে এক সিভিল সার্জনকে। শুধু শীর্ষ কর্মক’র্তাই নন সুনামগঞ্জে স্বাস্থ্যখাতের নিচের পর্যায়েও দু’র্নীতির অ’ভিযোগ রয়েছে। তাদের দু’র্নীতির কারণে সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতাল যেনো হয়ে উঠেছে ‘হরিলুটের ভান্ডার’। সেবা না মিললেও যে যার মতো করে পকেট ভরছেন। এমনই অ’ভিযোগ সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালের অফিস সহকারী ইকবাল হোসেন, তার স্ত্রী’ একই হাসপাতালের হিসাবরক্ষক রেহেনা আক্তার, হাসপাতালের কী’টতত্ত্ববিদ আনসারুল হক বাবু, স্টোরকিপার সোলেমান আহম’দ, সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালের অবসরপ্রাপ্ত ক্লার্ক মানবেন্দ্র দাস, মধুসূদন তালুকদারের বি’রুদ্ধেও। সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্বে থাকা ডা. আশুতোষ দাস এসব দু’র্নীতি যেনো দেখেও দেখছেন না।

পৌর শহরের হাছননগর এলাকার মৃ’ত ইসকন্দর আলীর ছে’লে ইকবাল হোসেন ও তার স্ত্রী’ রেহেনা আক্তার দুজনেই কর্ম’রত আছেন সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে। স্বামী আছেন অফিস সহকারী পদে, স্ত্রী’ হিসাবরক্ষকের পদে। সদর হাসপাতালের চাকরিই তাদের জন্য আলাদিনের চেরাগ হয়ে ধ’রা দিয়েছে।

নামে বেনামে এখন তাদের প্রচুর সম্পত্তি। সুলতানপুর এলাকায় তাদের আলিশান বাড়ি। সদর হাসপাতালের সামনেই রয়েছে বাণিজ্যিক ভবন, হাছননগর মাদ্রাসা সংলগ্ন এলাকায় উদ্বোধনের অ’পেক্ষায় রয়েছে অ’ত্যাধুনিক কমিউনিটি সেন্টার। হাছননগরে রয়েছে কোটি টাকা মুল্যের ১৫ শতক জমি, পৌর শহরের বাইরে হাছনবাহার এলাকায় দুটি বিশাল মৎস্য খামা’রেরও মালিক তারা। কপাল খুলেছে রেহানা আক্তারের বাবার বাড়ির লোকজনেরও। তার ভাই দীনা এন্টারপ্রাইজের নামে দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালে স্টেশনারি সরবরাহের মাধ্যমে নিজের ভাগ্য পাল্টে ফেলেছেন।

সদর হাসপাতালের কী’টতত্ত্ববিদ আনসারুল হক বাবুর বি’রুদ্ধেও অ’ভিযোগের অন্ত নেই। হাছননগরস্থ মৃ’ত আনোয়ার মিয়ার ছে’লে আনসারুল হক এক সময় তার ভগ্নিপতির সাথে ফার্মেসি ব্যবসা করতেন। ভগ্নিপতির মৃ’ত্যুর পর টানাপোড়েনের কারণে টিউশনি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। সেই আনসারুল হক বাবু এখন সুনামগঞ্জ শহরের অন্যতম ধনী ব্যক্তিত্ব। সরকারি চাকরির পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যবসায় তিনি জ’ড়িত।

নিজের ফার্মেসি ‘শামীম মেডিকেল হলে’র নামে তিনিই এখন সদর হাসপাতালে ঔষধ সরবরাহ করেন। হাসপাতালের গেটে রয়েছে তার প্রেসক্রিপশন ফার্মেসি নামে একটি প্রতিষ্ঠান। হেলথ কেয়ার পলি ক্লিনিক, আলফা ডায়গনস্টিক সেন্টার, কাজীর পয়েন্টের কুটুমবাড়ি রেষ্টুরেন্ট, স্টেডিয়াম এলাকার আনিসা হেলথ কেয়ার নামের ক্লিনিক, পুরাতন বাসস্ট্যান্ডের হিলিং ল্যাব নামের ডায়গনস্টিক সেন্টারসহ বিভিন্ন ব্যবসায় নামে বেনামে জ’ড়িত রয়েছেন। সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতাল নিয়ন্ত্রণে সিন্ডিকে’টের হোতা বলা হয় তাকে।

সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালের অবসরপ্রাপ্ত ক্লার্ক মানবেন্দ্র দাসের বি’রুদ্ধে অ’ভিযোগ, দু’র্নীতির ক্ষেত্রে তিনি আনসারুল হক বাবুর বিশ্বস্ত সহযোগী। আনসারুল হকের সাথে প্রায় সব ব্যবসারই অংশীদার তিনি। এছাড়া ২৫০ শয্যা হাসপাতালের নতুন বিল্ডিং এর সম্মুখ গেটে উদ্বোধনের অ’পেক্ষায় থাকা মৌসুমী মেডিকেল হলের মালিকানা রয়েছে মানবেন্দ্র দাসের মে’য়ের নামে। সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের পিছনে আলীপাড়া রোডে নির্মাণাধীন নার্সিং ইন্সটিউটে আনসারুল হক সিন্ডিকে’টের ১.৮০ একর জায়গা সিভিল সার্জনের যোগসাজশে অধিকমুল্যে অধিগ্রহণ করা হয়।

পৌরশহরের মল্লিকপুর এলাকার মৃ’ত ইয়াদ আলীর ছে’লে সোলেমান আহম’দের বি’রুদ্ধেও দু’র্নীতির অ’ভিযোগ রয়েছে। ছাতক উপজে’লায় স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে নিয়োগ পেলেও তাকে প্রেষণে সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালের স্টোরকিপার হিসেবে টেনে এনেছেন সিভিল সার্জন আশুতোষ দাস-এমনটাই অ’ভিযোগ। সোলেমান আহম’দ হাসপাতালের পথ্য সরবরাহকারীদের ব্যবসায়িক অংশীদার বলে অ’ভিযোগ পাওয়া গেছে। রাজনৈতিক প্রভাব থাকায় তিনি হাসপাতালে এর প্রয়োগ ঘটাতে কখনোই পিছ পা হন না।

বিস্তর অ’ভিযোগ। মোবাইল ফোনে ১১ মিনিট ৩২ সেকেন্ড কথা হয় সুনামগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. আশুতোষ দাসের সাথে। তার বি’রুদ্ধে উঠে আসা অ’ভিযোগগুলো একটি একটি করে খন্ডন করলেন তিনি। বললেন, অ’ভিযোগ করার অধিকার সকলেরই আছে- যে কেউই অ’ভিযোগ করতে পারে। যদি দোষী হই শা’স্তি মা’থা পেতে নেব। সুনামগঞ্জের শীর্ষ স্বাস্থ্য কর্মক’র্তা বললেন- দু’র্নীতিকে প্রশ্রয় দেই না বলেই আমা’র বি’রুদ্ধে এত অ’ভিযোগ। আগে অনেকেই বাড়ি গাড়ি করেছেন অথচ আমা’র এখনও টিনশেড বাড়িই রয়েছে। ডা. আশুতোষ দাস দাবি করেন, তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর সুনামগঞ্জে রোগীরা আরো বেশি সেবা পাচ্ছেন। তিনি জানান, আগে যেখানে প্রতিদিন ১৫০ থেকে ১৮০ জন রোগী ভর্তি হতেন সেখানে এখন প্রায় ৩শ রোগী ভর্তি হন প্রতিদিন।

কমিউনিটি ক্লিনিকে যেখানে আগে সর্বোচ্চ ১১৬টি ডেলিভারি হয়েছে। সেখানে তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর এ হার কয়েকগুণ বেড়েছে জানিয়ে সিভিল সার্জন তথ্য দেন, তিনি দায়িত্ব নেওয়ার বছর ২০১৭ সালে ডেলিভারি হয়েছে ২৪২টি, ২০১৮ সালে ডেলিভারি হয়েছে ৫৫২টি, এ বছর এ পর্যন্ত ৫৬৩টি ডেলিভারি হয়েছে। তিনি তথ্য দেন নরমাল ডেলিভারির ক্ষেত্রে সুনামগঞ্জ সারা দেশের মধ্যে প্রথম হয়েছে। তিনি দাবি করেন সাধ্যের মধ্যে হাসপাতালকে সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা করেছেন। ফুলের বাগান হয়েছে। তিনি জানান নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও হাসপাতাল রোগীদের সর্বোচ্চ সেবা দিতে সর্বাত্মক চেষ্টা করছে।

তিনি জানান, ৬২ জন চিকিৎসকের জায়গায় হাসপাতালে ১৪ জন চিকিৎসক রয়েছেন, ই’মা’র্জেন্সি চিকিৎসকের ৪টি পদের একটিতেও নিয়োগ নেই। রেডিওলজিস্ট নেই, প্যাথলজিস্ট নেই। তারপর তারপরও তার টিম আন্তরিকভাবে কাজ করে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছে।তার বি’রুদ্ধে উঠে আসা অ’ভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন যারা টেন্ডার পায়নি তারা চাপ দিয়ে টেন্ডার পাওয়ার জন্যই এমন অ’ভিযোগ করছে। ঘুষ দিয়ে সিভিল সার্জনের পদে থাকার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা সম্পূর্ণ মি’থ্যে। তিনি তথ্য দেন- শুধু তিনি নন আরো অনেককেই স্বপদে রেখে প্রমোশন দেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, প্রশাসনের কর্মক’র্তাদের ক্ষেত্রে আগে এমনটি হলেও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে এবারই প্রথম এরকম হয়েছে। তাই ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে।

নিজের সম্পদ স’ম্পর্কে আশুতোষ দাসের ভাষ্য হচ্ছে- তার সম্পদের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা রয়েছে। পোস্টঅফিসে সঞ্চয় ছিলো, নিজের ও স্ত্রী’র নামে থাকা লাইফ ইন্সুরেন্স ম্যাচিউরড হয়েছে, কিছু জমিজমা বিক্রি করেছেন আর প্রবাসী রেমিটেন্সও কিছু রয়েছে। এগুলো মিলেই তার সম্পত্তি। দুদকের নোটিশ প্রসঙ্গে ডা. আশুতোষ বলেন, তিনি নিজেও জানেন না তার বি’রুদ্ধে কী’ অ’ভিযোগ আনা হয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

11 − 4 =