বেড়েছে পেঁয়াজের ঝাঁঝ

0
532

মাজেদুল ইসলাম, চট্টগ্রাম: পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভারত থেকে রপ্তানি বন্ধ হতেই অসহনীয়ভাবে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে চট্টগ্রামের বাজারে। গত রোববার দিনব্যাপী ভারতীয় পেঁয়াজের দাম ৭০ টাকা থাকলেও সন্ধ্যা নাগাদ এক লাফে ৩০ টাকা বেড়ে ১০০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। এ দাম আরও দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে পূর্বাভাস দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা । জানা যায়, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ শুক্রবার (২৭ সেপ্টেম্বর) পেঁয়াজের রপ্তানি মূল্য বাড়িয়ে প্রতি মেট্রিক টন পেঁয়াজ ৮৫০ ডলারের কমে রপ্তানি করা যাবে না বলে ঘোষণা দিয়ে হঠাৎ করে রোববার (২৯ সেপ্টেম্বর) পুরোপুরি রপ্তানি বন্ধের প্রজ্ঞাপন জারি করে। গত বছরের ফেব্রুয়ারির পর ভারতীয় পেঁয়াজের নূন্যতম রপ্তানিমূল্যের ওই বাধ্যবাধকতা ছিল না। গত সপ্তাহেও তারা প্রতি টন ভারতীয় পেঁয়াজ ২৫০ থেকে ৩০০ ডলারে আমদানি করেছেন। এখন ভারত নূন্যতম রপ্তানি মূল্য বেঁধে দেওয়ায় তা বেড়ে প্রায় তিন গুণ হবে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চট্টগ্রামের বাজারে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ পাইকারি ৬০-৬২ টাকায়, মিয়ানমারের পেঁয়াজ ৫৮-৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ভারতীয় পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের ঘোষণার কারণে দামে তারতম্য ঘটেছে। রোববার দিনভর ৭০ টাকা থাকলেও সন্ধ্যার পর থেকে ১০০ ছেড়ে গেছে। আরও দ্বিগুণ বা তিনগুণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলছেন ব্যবসায়ীরা।


পেঁয়াজের দাম বাড়তি শুনে খুচরা বাজারে পেঁয়াজ কিনতে আসা এক ক্রেতা জানান, ‘পেঁয়াজ ছাড়া তো তরকারি খাওয়া মুশকিল হবে। দাম বাড়তি হবে শুনে কিনতে এসে দেখি দাম অনেক। শুনছি আরও বাড়বে। তখন কী হবে?’
খাতুনগঞ্জের পেঁয়াজ আমদানিকারকরা জানান, বর্তমানে দেশে তাহেরপুরী, বারি-১ (তাহেরপুরী), বারি-২ (রবি মৌসুম), বারি-৩ (খরিপ মৌসুম), স্থানীয় জাত ও ফরিদপুরী পেঁয়াজ উৎপাদন করা হয়। ফলে বছরজুড়েই কোনো না কোনো জাতের পেঁয়াজ উৎপাদিত হচ্ছে। দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ২৯ লাখ টন। এর মধ্যে ১৮ লাখ টন স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা হয়। আর ভারত থেকে আমদানি করা হয় চাহিদার বাকি অংশ। আর আমদানিকৃত এসব পেঁয়াজই দর উঠানামায় বড় ভূমিকা রাখে।


খাতুনগঞ্জের হামিদুল্লাহ মিয়া বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইদ্রিস বলেন, ‘কয়েকদিন আগেও স্থলবন্দরগুলো দিয়ে পেঁয়াজ আমদানি কমে গিয়েছিল। এখন ভারত আমদানি বন্ধ করে দিল। আমাদের বিকল্প বাজার খুঁজে বের করতে হবে।’ চাক্তাই খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাবেক সভাপতি মো. সোলায়মান বাদশা বলেন, ‘ভারতের রপ্তানি বন্ধ শুনে রোববার বিকেল ৫টার পর থেকেই প্রভাব পড়তে শুরু করেছে পেঁয়াজের বাজারে। অনির্দিষ্টকালের জন্য ভারত সরকার রপ্তানি বন্ধের প্রজ্ঞাপনও দিয়েছে।

কখন প্রত্যাহার হবে তাও নিশ্চিত নয়। এখন ১০০ টাকা, কাল থেকে আরও বাড়বে। ২০০ টাকা ছাড়ালেও অসম্ভব কিছু না।’ খাতুনগঞ্জ ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো: ছগীর আহমেদ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা বারবার সরকারকে বলে আসছি যে ভারতের উপর নির্ভরশীল হওয়া কোনো অবস্থাতেই আমাদের জন্য শুভ না। এরা যেকোনো সময়ই বন্ধ করে দিতে পারে। আমরা অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে গেছি। সামান্য ৯-১০ লক্ষ টন পেঁয়াজ না এনে আমরা কি উৎপাদন করতে পারি না ? ভারত রপ্তানি বন্ধ করেছে আর মিয়ানমারের অবস্থা জানা নেই।

এর আগে মিয়ানমার ৪৫০ ডলার করেছিল পেঁয়াজের দাম।’ তিনি আরও বলেন, ‘কৃষকরা তাদের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় অনেক কৃষক পেঁয়াজ উৎপাদন করতে চায় না। অন্যান্য ভোগ্যপণ্য নিয়ে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু এই সামান্য পেঁয়াজের ঝাঁঝেই এমন নাজেহাল হতে হয়।’ সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ও যোগানের কোনো সঠিক হিসাব নেই। তবে ব্যবসায়ীদের ধারণা প্রতি বছর চাহিদার ৭০ শতাংশ পেঁয়াজ দেশে উৎপাদন হয়।

বাংলাদেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ২৯ লাখ মেট্রিক টন। আর উৎপাদন হয় ১৭ থেকে ১৯ লাখ মেট্রিক টনের মত। তাতে চাহিদা পূরণ না হওয়ায় আমদানি করতে হয় ৭ থেকে ১১ লাখ মেট্রিক টন। স্বল্প দূরত্ব আর সহজলভ্যতার কারণে আমদানির বেশিরভাগটা ভারত থেকেই হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে ২৩ লাখ ৩০ হাজার টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়েছে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে এই উৎপাদনের হার প্রায় ১০ লাখ ৯২ হাজার টন। ভারত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪৯ কোটি ৬৮ লাখ ডলারের পেঁয়াজ রপ্তানি করেছে।

যার একটি বড় অংশ এসেছে বাংলাদেশে। এর আগে ২০১৭ সালের শেষ দিকেও একবার ভারত নিজেদের বাজার সামাল দিতে নূন্যতম রপ্তানিমূল্য ৪৩০ ডলার থেকে বাড়িয়ে ৮৫০ ডলার করেছিল। তখন খুচরা বাজারে ভারতীয় পেঁয়াজ ৭৫ টাকা কেজিতে পাওয়া গেলেও দেশি পেঁয়াজের দাম ১০০ টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তবে এবার ভারতীয় পেঁয়াজের দাম বাড়লেও সার্বিকভাবে পেঁয়াজের বাজার ততোটা অস্থিতিশীল হবে না বলে মনে করছেন সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) চট্টগ্রামের আঞ্চলিক উপ-উর্ধ্বতন কার্যনির্বাহী কর্মকর্তা জামাল উদ্দিন আহমেদ।

তিনি বলেন, ‘আমাদের আমদানিকারকরা ইতোমধ্যে তুরস্ক, মিশর, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি শুরু করেছেন। ফলে ভারতের সিদ্ধান্তের কারণে বাজার নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ার মত কোনো প্রভাব পড়ার কথা না। এখন অপেক্ষা করে দেখি কী হয়। তবে আতঙ্কিত হওয়ার কিছুই নেই।’ এদিকে ব্যবসায়ীরা জানান, ভারতের রপ্তানি বন্ধে প্রভাব পড়বে দেশের বাজারগুলোতে। ভারত ছাড়া তুরস্ক, মিয়ানমার, মিশর, পাকিস্তান থেকে পেঁয়াজ আমদানির এলসি খোলা হচ্ছে। তবে বাইরে থেকে এসব পেঁয়াজ বন্দর দিয়ে আসতে হলে সময় লাগবে দুই মাসের মতো। তবে পেঁয়াজ পঁচনশীল বলে এতোদিন টিকবে কি না তাতেও সন্দিহান অনেক ব্যবসায়ী।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

eleven − nine =