লালমনিরহাটে নেছারিয়া মাদ্রাসা অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ১০লাখ টাকা আত্মসাতের প্রমাণ মিলেছে

0
921

লালমনিরহাট প্রতিনিধি:জেলার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেছারিয়া কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মাদ্রাসা ফান্ডের ১০লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। তদন্ত কমিটির নিরীক্ষা প্রতিবেদনে অভিযোগের সত্যতা মিললে অধ্যক্ষকে শাস্তিমূলক ৬লাখ টাকা জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। এদিকে ওই তদন্ত কমিটির কয়েকজন সদস্য আত্মসাতকৃত সমুদয় টাকা ফেরত চেয়ে জেলা প্রশাসক বরাবর অভিযোগপত্রও জমা দিয়েছেন। জানা গেছে, ষাটের দশকে আসগার আলী নামে শহরের পূর্ব সাপটানার এক শিক্ষানুরাগী ধনাঢ্য ব্যক্তি মাদ্রাসা স্থাপনের জন্য তার বাড়ির পাশে জমি দান করেন। ১৯৬৫ সালে দাখিল পর্যায়ের পাঠদানের মাধ্যমে মাদ্রসাটি যাত্রা শুরু করে।

সুনামের সঙ্গে পরিচালিত মাদ্রাসার সবশেষ  ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ছিলেন এবিএম মাহফুজুর রহমান। তিনি অবসরে গেলে ২০১৫ সালের ৩১ মার্চ অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পান মোসলেম উদ্দিন। ২০০৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর মাদ্রাসাটির নামে লালমনিরহাট সোনালী ব্যাংক শাখায় একটি হিসাব (অ্যাকাউন্ট) খোলা হয়। টানা ১০ বছর অ্যাকাউন্টটি মাদ্রাসার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি কর্তৃক পরিচালনার পর এই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হয়ে পদাধিকার বলে কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে তা পরিচালনার দায়িত্ব পান মোসলেম উদ্দিন। আর এই অ্যাকাউন্টের দেখভালের দায়িত্বে আছেন মাদ্রাসাটির সভাপতি সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট সফুরা বেগম রুমী।

কিন্তু সস্প্রতি মাদ্রাসাটির অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে। অভিযোগের তদন্তের জন্য ৬ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটি। তদন্ত কমিটি মাদ্রাসার ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়কালের আয়-ব্যয়ের একটি নিরীক্ষা প্রতিবেদন তৈরী করে গত ২৩ মে মাদ্রাসা পরিচালনা পর্ষদের কাছে দাখিল করে। এতে আর্থিক অনিয়মের মোট ৪৪টি আপত্তি তুলে ধরা হয়।মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটি সূত্রে জানা গেছে, ৫০ পৃষ্ঠার ওই নিরীক্ষা প্রতিবেদনের নথিতে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় মাদ্রাসার আয়ের ৫৮ লাখ ৮২ হাজার ১৩ টাকার মধ্যে ব্যাংক হিসাবে লেনদেন হয়েছে মাত্র ১১ লাখ ৪১ হাজার ৩২ টাকা। আবার উত্তোলন করা হয়েছে ১১ লাখ ৯৬ হাজার ৮৯৯ টাকা।

তদন্ত কমিটি সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ৩ ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত এ অ্যাকাউন্টে ব্যালান্স ছিল ৬০ হাজার ৯৪০ টাকা। অধ্যক্ষ মোসলেম উদ্দিন এরপর থেকেই অ্যাকাউন্টটিতে লেনদেন শুরু করেন। আর অনিয়মের সূত্রপাত সেখান থেকেই। ফলে ওই তিন বছরে  তার স্বাক্ষরে যে পরিমাণ অর্থ উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে, তাতে আগের বছরের কিছু টাকাও চলে গেছে। অ্যাকাউন্ট পরিচালনার নিয়মনীতি অনুযায়ী যৌথ স্বাক্ষর ছাড়া এসব টাকা উত্তোলন না করতে পারার কথা থাকলেও মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও কমিটির সদস্য সচিব বেশিরভাগ টাকা তুলে নিয়েছেন একক স্বাক্ষরে। ফলে এটা গুরুতর অপরাধের শামিল। সবচেয়েও বড় অভিযোগ ব্যাংকে জমা না দেওয়া ৪৭ লাখ ৪০ হাজার ৯৮১ টাকা ঘিরে। ব্যাংকে জমা না করে এসব অর্থ সরাসরি খরচ করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

এতে দেখা যায়, ৩৬ মাসে মাদ্রাসার মোট আয় ৫৮ লাখ ৮২ হাজার ১৩ টাকা। আর কাগজে-কলমে খরচ দেখানো হয়েছে ৫৩ লাখ ৬২৩ টাকা।  বাকি ৫ লাখ ৮১ হাজার ৩৯০ টাকা ‘হস্ত মজুত’ (হাতে থাকা) কথা বলা হয়। তবে ব্যাংক থেকে তোলা ১১ লাখ ৯৬ হাজার ৮৯৯ টাকার কিছু অংশের খরচসহ ব্যাংকে জমা না হওয়া মোট ৪৭ লাখ ৪০ হাজার ৯৮১ টাকার হিসাব নিয়ে তদন্ত কমিটির রয়েছে গুরুতর আপত্তি। ওই টাকার বড় অংশ মাদ্রাসার ভবন নির্মাণের কাজে খরচ হওয়ার বিল ও ভাউচার উপস্থাপন করলেও ৪ লাখ ৮৭ হাজার ৩৯৮ টাকার কোনও হিসাব তিনি দিতে পারেননি অধ্যক্ষ।

তবে অনিয়ম হলেও এই ৪লাখ ৮৭ হাজার ৩৯৮ টাকার হিসাব আমলে না নিয়ে অধ্যক্ষের হাতে থাকা ৫ লাখ ৮১ হাজার ৩৯০ টাকাকে ৬ লাখে মিলিয়ে দিয়ে ব্যাংকে জমা করার নির্দেশ দিয়েছেন কমিটির সভাপতি সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক এমপি সফুরা বেগম রূমী। এ ব্যাপারে তীব্র আপত্তি জানিয়েছেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা। তাই হাতে থাকা ও হিসাব না মেলা ওই ১০ লাখ ৬৮ হাজার ৭৮৮ টাকার পুরেটাই মাদ্রাসা ফান্ডে কেন জমা করা হবে না এবং এসব টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মাদ্রাসা অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না মর্মে মাদ্রাসার সভাপতি সাবেক এমপি সফুরা বেগম রূমীর বিরুদ্ধেও অভিযোগ তুলেছেন।।

 এ ব্যাপারে মাদ্রাসাটির প্রতিষ্ঠাতা মৃত আছগার আলীর ছেলে শফিকুল ইসলাম জেলা প্রশাসক ও দুদকের রংপুর সমন্বিত কার্যালয় বরাবর লিখিত অভিযোগপত্র জমা দিয়েছেন। জেলা প্রশাসক আবু জাফর এই সংক্রান্ত একটি লিখিত অভিযোগ পাওয়ার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।এ ব্যাপারে অধ্যক্ষ মোসলেম উদ্দিন বলেন, মাদ্রাসা কমিটি গত ২৮ আগস্টের মধ্যে ৬ লাখ টাকা ব্যাংকে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়ায় গত ২৫আগস্ট তা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে।এ মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সভাপতি এবং সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট সফুরা বেগম বলেন, ‘এককভাবে কোনও বক্তব্য দিতে পারবো না।

আপনাদের (সাংবাদিকদের) কোন প্রশ্ন থাকলে নির্বাহী  কমিটির সভা ডাকবো। ওই সভায় আপনারা প্রশ্ন করলে উত্তর পাবেন।’লালমনিরহাট জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘মাদ্রাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনও আর্থিক অনিয়ম সংক্রান্ত বিষয়ে আমার দেখার এখতিয়ার নেই। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যদি ওই মাদ্রাসার বিষয়ে কোনও নির্দেশনা দেয় তাহলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। উল্লেখ্য, মাদ্রাসার অর্থ কীভাবে খরচ করা যাবে সে বিষয়ে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড, গভর্নিং বডি ও ম্যানেজিং কমিটি প্রবিধিমালা-২০০৯ তে সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা রয়েছে।

ওই প্রবিধিমালার ৪৫ অনুচ্ছেদের (ব্যাংক হিসাব ও পরিচালনা) ৪ নম্বর কলামে বলা আছে, কোনোক্রমেই নগদ আদায়কৃত অর্থ ব্যাংকে জমা না করে নগদ ‘ক্যাশ টু ক্যাশ’ ব্যয় করা যাবে না। একই অনুচ্ছেদের ৩ নম্বর কলামে বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট মাদ্রাসার তহবিলের সকল আয় ওই হিসাবে জমা করতে হবে এবং উপ-প্রবিধান (৫) এর বিধান সাপেক্ষে, এক হাজার টাকার অধিক দায় ক্রসড চেকের মাধ্যমে পরিশোধ করা যাবে।

এছাড়াও উল্লেখ আছে, সংশ্লিষ্ট মাদ্রাসার দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহের জন্য কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে অনধিক ৫ হাজার টাকা নগদ উত্তোলন করে হাতে রাখা যাবে। ফলে ওই মাদ্রাসার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে একক স্বাক্ষরে টাকা ওঠানোর প্রক্রিয়া এবং হাতে টাকা জমা রেখে খরচ করার দুটি ঘটনাই ওই প্রবিধিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।১৯৬৫ সালে দাখিল বিষয়ে পড়াশোনার মাধ্যমে লালমনিরহাটের নেছারিয়া কামিল মাদ্রাসার কার্যক্রম শুরু হয়। পরবর্তীতে ১৯৭৭ সালে আলিম, ১৯৭৯ সালে ফাজিল ও ২০০২ সালে কামিল মাদ্রাসায় উন্নীত হয় জেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই বিদ্যাপীঠ।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

twelve − nine =