দেশের প্রথম রাজনীতিমুক্ত খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

0
618

১৯৯১ সালের ২৫ নভেম্বর ৪টি ডিসিপ্লিনের ৮০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করে দক্ষিণবঙ্গের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. গোলাম রহমানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম প্রকল্প পরিচালক এবং পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর দোতলা একটি ভবনে একই সঙ্গে চলতে থাকে প্রশাসনিক এবং শিক্ষা কার্যক্রম।

কোনো এক শীতের সকালে শিক্ষার্থীদের হৈ-হুল্লোড় শুনতে পেয়ে এগিয়ে আসেন তৎকালীন উপাচার্য ড. গোলাম রহমান। আসার পর শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে জোর দাবি জানানো হয় রাজনীতির নামে লাশের মিছিল আর অস্ত্রের ঝনঝনানি শুনতে চান না তারা। নিষিদ্ধ করা হোক ছাত্র রাজনীতি। শিক্ষার্থীদের এ দাবিকে মেনে নিয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় পরিণত হলো বাংলাদেশের প্রথম রাজনীতি মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে।

এরপর হাঁটি হাঁটি পা পা করে কেটে গেছে ২৭টি বছর। দুই যুগের বেশি সময়ের এ পথচলায় কখনো অভ্যন্তরীণ ছাত্র কোন্দলের মুখে অচলাবস্থায় পড়তে হয়নি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়কে। কিংবা নোংরা রাজনীতির ছোবলে ক্যাম্পাসে কখনো রক্তের দাগ লাগেনি। নেই সেশনজট। অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডার অনুযায়ী যথাসময়ে ক্লাস, পরীক্ষা এবং ফল প্রকাশিত হয়ে থাকে।

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে যেখানে মিছিলে না গেলে সিট হয় না, সেখানে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধা ক্রম এবং পারিবারিক আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় সিট বরাদ্দ দেয়া হয়। অধিকাংশ শিক্ষার্থী মনে করেন রাজনীতি থাকলে এসবের কিছুই সম্ভব হতো না। শিক্ষার্থীরা বলছেন, তারা প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে সক্রিয় না হলেও রাজনীতি সচেতন। দাবি আদায় কিংবা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সবক্ষেত্রেই কথা বলেন বজ্রকণ্ঠে।

কোটা সংস্কার এবং নিরাপদ সড়ক আন্দোলন থেকে শুরু করে জিনিয়ার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের আন্দোলনে জোরালো ভূমিকা তার সাক্ষ্য বহন করে। আবার পড়াশুনার মান, পর্যাপ্ত সহশিক্ষা কার্যক্রম এবং নিরাপদ পরিবেশের কারণে অভিভাবকদেরও পছন্দের শীর্ষে উঠে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। প্রতিবছর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শিক্ষা সমাপনী অনুষ্ঠান (র‍্যাগ ডে), পিঠা উৎসব, দক্ষিণবঙ্গে পহেলা বৈশাখের সবচেয়ে বড় উৎসব আয়োজন করে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়টি। এসব অনুষ্ঠান আয়োজনের দায়িত্ব দেয়া হয় শিক্ষার্থীদের হাতে। আস্থার প্রতিদানরূপ কখনো কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। যা শিক্ষার্থীদের সততা, দায়িত্ববান এবং পরস্পর শ্রদ্ধাশীল মনোভাবের পরিচয় বহন করে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি এবং পরিবেশ ডিসিপ্লিনের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী নিপ্পন হালদার বলেন, ‘চট্টগ্রাম এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার পর আমার পরিবার খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়কে বেছে  নিতে বলেন।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে হলে সিট পেতে হলে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার প্রয়োজন হলেও এখানে কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছাড়াই আমি দ্বিতীয় বর্ষে সিট পেয়েছি। কখনো গেস্টরুম নির্যাতন সহ্য করতে হয়নি।’

খুবির সিংহভাগ শিক্ষার্থীই মনে করেন রাজনীতি ছাড়া তুলনামূলক ভালো আছেন তারা। জানতে চাইলে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা ডিসিপ্লিনের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী মুনমুন আহমেদ দৈনিক অধিকারকে বলেন, ‘সুখকর ব্যাপার এই যে আমি রাতে কিংবা দিনে ক্যাম্পাসে একা চলাচল করি। কখনো হয়রানির শিকার হতে হয়নি। বরং সিনিয়রদের সৌহার্দ্যপূর্ণ মনোভাব আমায় মুগ্ধ করেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘মিছিল, মিটিং না থাকায় আমরা নৈয়ায়িক, রোটার‍্যাক্ট, বাঁধন এবং কৃষ্টিসহ ৩০টিরও বেশি সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনে সময় দিতে পারছি। যা আমাদের ব্যক্তিগত মানোন্নয়নে সাহায্য করে।’

খুবির প্রাক্তন শিক্ষার্থী, বর্তমান শিক্ষক এবং ছাত্র বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক মো. শরীফ হাসান লিমন বলেন, ‘খুবি প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছর পর থেকে আমি এ ক্যাম্পাসে রয়েছি। রাজনীতির কারণে কখনো কোনো মায়ের কোল খালি হতে দেখিনি। কখনো অস্ত্রের মহড়া কিংবা ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়নি। তবে ছাত্রদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কিছু ঘটনা ঘটলেও তা দৃষ্টান্ত নয়।’

শান্তিপূর্ণ এ বৈশিষ্ট্যের কারণে বিগত কয়েক বছরে বেড়েছে মেয়ে শিক্ষার্থীদের পরিমাণ। কখনো তা ছাড়িয়ে গেছে ছেলে শিক্ষার্থীদের পরিমাণকেও। নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে ক্যাম্পাসে সুশৃঙ্খল এবং সুষ্ঠু পরিবেশ।

শুধু শিক্ষার্থীরাই যে পড়াশুনার সুষ্ঠু পরিবেশ পেয়েছে তা নয়। বিশ্ববিদ্যালয় লাগোয়া দোকানিরাও ব্যবসার সুষ্ঠু পরিবেশ পেয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন ইসলাম নগর রোডের ভাই ভাই রেস্তোরাঁর মালিক মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘দীর্ঘদিনের ব্যবসা জীবনে কখনো চাঁদা দেয়া কিংবা ক্ষমতার দাপটে বিল না দেয়ার মতো ঘটনা ঘটেনি। বরং দোকানি এবং শিক্ষার্থীদের মাঝে চমৎকার সম্পর্ক বিদ্যমান।’

তবে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রাজনীতি থাকায় শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের একটি অংশের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে। প্রশ্ন উঠেছে বাক স্বাধীনতা নিয়ে। তাদের দাবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন অনিয়ম আর দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছে। যার প্রতিকার হিসেবে শিক্ষক রাজনীতিও নিষিদ্ধ চান তারা। একই সঙ্গে ছাত্র রাজনীতি না থাকলেও অনিয়ম আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের আরও সোচ্চার হওয়ার আহ্বান তাদের। তবে সব তর্ক-বিতর্ক ছাপিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মত শিক্ষক রাজনীতির তুলনায় ছাত্র রাজনীতি যে শিক্ষার্থীদের জন্য ভয়ানক তা স্পষ্ট। তাই অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তুলনায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় যে ঢের ভালো তা বলাই যায়।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

3 × one =