অ্যাজমা এমন একটি অবস্থা, যেখানে বায়ুনালি আক্রান্ত হয়

0
1130

গ্রিক শব্দ AZ-MA থেকে Asthma শব্দের উৎপত্তি। যার অর্থ দ্রুত নিঃশ্বাস নেয়া। আমরা মনের অজান্তে প্রতিদিন দশ থেকে এগারো হাজার লিটার বাতাস নিঃশ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসে নিচ্ছি এবং তা প্রশ্বাসের সঙ্গে বের করে দিচ্ছি। অ্যাজমা এমন একটি অবস্থা, যেখানে বায়ুনালি আক্রান্ত হয়। হাঁপানি রোগে আক্রান্ত হলে ফুসফুসের বায়ুবাহি নালি অত্যাধিক সংবেদনশীল হয়, ফলে নালির অভ্যন্তর ফুলে ওঠে এবং প্রদাহিত হয়, ফলে বায়ুনালি পথগুলো ফুলে স্বাভাবিকের তুলনায় সরু হয়ে যায় এবং স্বাভাবিক বাতাস চলাচলে বাধাগ্রস্ত হয়।

বাতাসে রয়েছে অক্সিজেন। এ অক্সিজেন সঠিকভাবে সরবরাহ করতে পারে না বিধায় জটিলতার সৃষ্টি হয়। আমরা জানি অক্সিজেন কোষে শোষিত হয় আর দূষিত পদার্থ হিসেবে কার্বন ডাই অক্সাইড ত্যাগ করে। নাক দিয়ে বাতাস শ্বাসনালি, ট্রাকিয়া, ব্রংকাস ও ব্রংকিওল-ক্ষুদ্রাতি-ক্ষুদ্র বায়ুনালি দিয়ে সবশেষে বায়ুকুঠুরিতে (এলভিওলাই) পৌঁছায়। এই নালি বড় থেকে ছোট, ছোট থেকে আরও ছোট, ক্ষুদ্র থেকে আরও ক্ষুদ্র, সূক্ষ্ম থেকে আরও সূক্ষ্ম ৮৩টি শাখা প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে তার পরই বায়ুকুঠুরিতে পৌঁছায় এবং সেখানে অক্সিজেন ও কার্বন-ডাই অক্সাইডের আদান-প্রদান হয়। যেখানে রক্তনালি-বায়ুনালির সংস্পর্শ হয়। এটাকেই আত্মীক-সম্পর্কের সঙ্গে তুলনা করা যায়।

অ্যাজমাকে অ্যাজমা বললে ভুল হবে, কারণ কার্ডিয়াক (হার্ট) অ্যাজমা আছে, গ্যাস্ট্রিক (খাদ্যনালি বা খাদ্যথলির) অ্যাজমা আছে- কাজেই অ্যাজমা বলতে হলে তার নামের আগে যুক্ত করতে হবে ব্রংকিয়াল অ্যাজমা। এ ব্রংকিয়াল অ্যাজমাই হল হাঁপানি বা শ্বাসকষ্ট রোগ।

শ্বাসকষ্ট বা ব্রংকিয়াল অ্যাজমার কারণ

হাঁপানি রোগের সঠিক কারণ আজও জানা যায়নি। তারপরও পরিণতির জন্য যেগুলো পরিস্থিতি প্রতিনিধিত্ব করে সেগুলোর মধ্যে বংশগত কারণ (দাদা-দাদি, বাবা-মা, ফুপু, ভাই-বোন, ছেলেমেয়ে) অর্থাৎ যাদের মধ্যে রক্তের সম্পর্ক আছে সেসব পরিবারে একজনের হাঁপানি রোগ থাকলে অন্যজনের হয়। তবে এটিও আবার সত্য নাও হতে পারে। হাঁপানি রোগের জন্য একাধিক কারণ থাকতে পারে। শিশুকে বুকের দুধ পান না করালে, মা যদি গর্ভাবস্থায় ধূমপান করে। জেনেটিক বা বংশগত এবং সর্বোপরি ট্রিগার ফ্যাকটর (সামান্য উসকানিতেই সহিংস পন্থা অবলম্বন করে) ইত্যাদি।

এই ট্রিগার ফ্যাক্টর শরীরের মধ্যে থেকেই হতে পারে আবার বাইরের বেশকিছু অ্যালার্জেন আছে যার সংস্পর্শে এলেই বিপত্তি অর্থাৎ শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। এ ট্রিগার ফ্যাক্টরগুলোর মধ্যে যেমন ফুলের রেণু, ত্বক, চুল, পাখির পালক, এমনকি কুকুর, বিড়াল, পাখি, ইঁদুরের বিষ্ঠা, কল-কারখানার ধুলা-বালি, ফাংগাসজনিত কারণ ইত্যাদি। তেলাপোকা, ছারপোকা, লাকড়ির চুলা, গ্যাসের চুলা, স্টোভের ধোঁয়া, বডিস্প্রে, মশার কয়েল, উলেন কাপড়-চোপড়, লেপ, তোশক, কম্বল ইত্যাদি।

কিছু খাদ্যদ্রব্য (যা সবাইকে সমস্যা করে না) গরুর মাংস, হাঁসের মাংস, হাঁসের ডিম, চিংড়ি মাছ, ইলিশ মাছ, গজার মাছ, পুঁটিমাছ, বোয়াল মাছ, চিনাবাদাম, কিছু শাকসবজি, মিষ্টি কুমড়া, বেগুন ইত্যাদি।

যাদের বারবার ঠাণ্ডা-কাশি, হাঁচি হয় তাদের শ্বাসকষ্ট রোগ হতে পারে। যারা বেশি দৌড়াদৌড়ি করে তাদের শ্বাসকষ্ট হতে দেখা যায়। কিছু ওষুধ বিশেষ করে বিটা-ব্লকার (প্রেসারের ওষুধ), বেদনানাশক ওষুধ ইত্যাদি।

ঋতু পরিবর্তন (অমাবস্যা-পূর্ণিমা), আবহাওয়া পরিবর্তন আগের দিনের তাপমাত্রা থেকে পরের দিনের তাপমাত্রা তিন ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম অথবা বেশি হলে অনেকের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়।

কিছু ফাংশনাল কারণ। অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে যেমন- স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া, মানসিক উত্তেজনা, অপারেশনের রোগী, গর্ভবতী মহিলা ইত্যাদি ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্ট হতে পারে।

হাঁপানি রোগকে বিভিন্নভাবে শ্রেণিবিন্যাস করা হয়েছে। যেমন- অ্যাটপিক, নন অ্যাটপিক অ্যাজমা, বিশেষ বিশেষ অ্যাজমা।

ইন্টারমিটেন্ট মাঝে মধ্যে শ্বাসকষ্ট রোগ হয়। চিকিৎসা বা চিকিৎসা ছাড়াই রোগ ভালো হয়ে যায়।

পার্সিস্টেন্ট অ্যাজমা অর্থাৎ প্রতি মাসে অন্তত দু’বার বা আরও বেশিবার শ্বাসকষ্ট হয় এবং আক্রান্ত হওয়ার আগে পরে শ্বাসকষ্ট থাকে না।

এ ধরনের শ্বাসকষ্টকে আবার তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে যথা- মৃদু বা শান্ত প্রকৃতি, মাঝারি বা মধ্যপন্থী এবং তীব্র বা কঠোর প্রকৃতির শ্বাসকষ্ট।

জটিল প্রকৃতির শ্বাসকষ্ট- যা চিকিৎসার আইন-কানুন মানে না। যে কোনো সময় অধিক তীব্র হয়ে মৃত্যু ঘটাতেও সক্ষম। প্রাণঘাতী ও মারাত্মক শ্বাসকষ্ট হয়।

বিশেষ ধরনের শ্বাসকষ্ট : হাঁটা-চলা, দৌঁড়াদৌঁড়িতে হয়রান হওয়া। দীর্ঘ মেয়াদি কাশির জন্য শ্বাসকষ্ট, ওষুধজনিত কারণ (আগেই উল্লেখ করা হয়েছে) পেশাগত কারণজনিত শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি।

পেশাগত কারণের মধ্যে : যেমন- সর্বদা ধুলাবালিযুক্ত পরিবেশ, ইটা-বালির গুঁড়া, রাসায়নিক ধোঁয়া, সিমেন্ট কারখানা, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, আটা ও মসলার মিল, জুটমিল, রাইসমিল, স্পিনিং মিল, রঙের কারখানা, রাসায়নিক সার কারখানা, ফটোকপি মেশিন, পোলট্রি ফার্ম, বেডিং স্টোর ইত্যাদি কারখানায় যারা কাজ করেন তাদের পেশাগত অ্যাজমা হতে পারে।

শ্বাসতন্ত্রের রোগ হওয়ার প্রধান উপসর্গ

কাশি থাকবে, কফ বের হতে পারে, কফের সঙ্গে রক্ত আসতে পারে। বুক ব্যথা করতে পারে, শ্বাসকষ্ট হবে। বুকের মধ্যে শ্বাসে শোঁ শোঁ, বাঁশির মতো চিঁ চিঁ, যে যাই বলুন- শব্দ হতে পারে। তবে হাঁপানির ক্ষেত্রে কার্ডিনাল ফিচার ধরা হয় চারটি। সেগুলো হচ্ছে শ্বাসকষ্ট, শ্বাসে শব্দ, কাশি, বুক ব্যথা বা বুক চেপে আসা।

রোগ নির্ণয়

চিকিৎসার পূর্বশর্ত রোগ নির্ণয় করা আর রোগ নির্ণয়ের পূর্বশর্ত- পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা। রোগী যে সমস্যার কথা বলেন সেটা উপসর্গ, আমরা শারীরিক পরীক্ষা করে যেটা পাই সেটা সাইন, দুটিকে একত্রে বলা হয় ক্লিনিক্যাল-ফিচার।

পরীক্ষা-নিরীক্ষা

* বুকের এক্স-রে

* কফ পরীক্ষা

* রক্তের রুটিন পরীক্ষা-সিবিসি উইথ ফ্লিম, সার্কুলেটিং ইসোনফিল

* লাং ফাংশন টেস্ট : স্পাইরোমেট্রি।

বিশেষ পরীক্ষার মধ্যে আর্টারিয়াল ব্লাডগ্যাস অ্যানালাইসিস, ডিএল সিও, এক্সারসাইজ টলারেন্স টেস্ট, ব্রংকোপ্রভোকেশন টেস্ট, রিভারসিবিলিটি-টেস্ট ইত্যাদি। বয়স যদি ৪০ বছরের ঊর্ধ্বে হয় রক্তের গ্লুকোজ টেস্ট, ইসিজি, ইকো ইত্যাদি করে হার্টের কার্যক্ষমতা বোঝা যায়। বিশেষ পরীক্ষাগুলোর মধ্যে স্কিন প্রিক টেস্ট, রক্তের আইজিই, আরও আছে!

হাঁপানি রোগের চিকিৎসা

হাঁপানি রোগকে ১-৫টি ক্রম অনুসারে সাজানো হয়েছে। এক একটি পর্যায়ের চিকিৎসা এক এক ধরনের। কোন রোগী কোন পর্যায় নিয়ে চিকিৎসকের কাছে গিয়ে উপস্থিত হয়েছে। চিকিৎসক তাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করে এবং পিক ফ্লো-মিটার ব্যবহার করে বুঝতে পারেন এবং সে অনুযায়ী চিকিৎসা দেন। হাঁপানি রোগের চিকিৎসায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে একাধিক ওষুধ ব্যবহারের প্রয়োজন হয়। সে দিক বিবেচনা করে হাঁপানি রোগের ওষুধগুলো প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।

শ্বাসকষ্ট লাঘব বা মোচনকারী ওষুধ (রিলিভার) : সালবিউটামল, লিভসালবিউটামল, অ্যামাইনোফাইলিন, থিওফাইলিন, টারবুটালিন ইত্যাদি। সালবিউটামলে অনেকের বুক ধড়ফড় বা অস্থিরতা দেখা দেয়, হাত-পা কাঁপতে পারে। সে ক্ষেত্রে লিভসালবিউটামল কম করে। এল্টিকলিনার্জিক-ইপ্রাট্রপিয়াম, ট্রায়ো-ট্রপিয়াম, অক্সিট্রপিয়াম ইত্যাদি। রিলিভার ওষুধে অনেকের আহারে অরুচি, বমি ভাব, বমি, পেটের মধ্যে অস্বস্তি, মাথাব্যথা, মাংসের মধ্যে কামড়ানো, হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, অস্থিরতা, ঘুমে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। এমন হলে ব্যবহৃত ওষুধের মাত্রা কমাতে হয়। ছোটখাটো সমস্যা দু-চারদিন পরে আপনাতেই চলে যায়।

নিবারিত, নিবৃত করা, প্রতিরোধ করা (প্রিভেন্টার) : আইসিএস-(ইনহেলকর্টি-কোস্টেরয়েড), ক্রমোন, জেনথিন, লিউকোট্রিন ইত্যাদি তবে আইসিএস-ই বেশি ব্যবহৃত হয়। যেমন- বেকলোমিথাসন, বুডিসোনাইড, ফ্লুটিকাসন, সিকলিসোনাইড, বিটামিথাসন, হাইড্রোকোর্টিসন, প্রেডনিসোলন ইত্যাদি।

রক্ষাকারক (প্রটেকটর) : সালমেটেরল, বাম্বুটেরল, ফর্মটেল এবং লং অ্যাকটিং সালবিউটামল বা লং অ্যাকটিং থিওফাইলিন ইত্যাদি বর্তমানে বলা হচ্ছে উপমশ নিয়ন্ত্রক। আমাদের দেশের প্রায় সবার মধ্যেই বদ্ধমূল ধারণা-ইনহেলার হাঁপানি রোগের শেষ চিকিৎসা কিন্তু বিশেষজ্ঞরা মনে করেন ইনহেলার অ্যাজমা রোগের প্রাথমিক চিকিৎসা।

ইনহেলার দিয়ে হাঁপানি রোগের চিকিৎসা শুরু হওয়া উত্তম।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

three × two =