মৃত্যুর পর শেষ রাষ্ট্রীয় মর্যাদাটাও তিনি নেননি

0
507

‘দিনাজপুরের এসিল্যান্ড (সহকারী কমিশনার ভূমি) আমার ছোট ভাইকে দিয়ে নিজ বাড়ির বাজার ও রান্না করাতেন। এমনকি নিজেদের শৌচাগারও পরিষ্কার করিয়ে নিয়েছেন। আমাকে ও বাবাকে প্রশাসনের সবাই অপমান করেছেন। একজন মুক্তিযোদ্ধাকে কেউ সম্মান করেননি। শেষ পর্যন্ত বাবা মৃত্যুর আগে আমাদের কাছে ওছিয়দ লিখে দিয়েছেন।

প্রশাসনের ওপর আমার বাবা এত রেগে ছিলেন যে, মৃত্যুর পর শেষ রাষ্ট্রীয় মর্যাদাটাও তিনি নেননি। আমি ও আমার পরিবার এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিচার ও শাস্তি দাবি করছি।’

শুক্রবার (২৫ অক্টোবর) দুপুরে দিনাজপুর সদর উপজেলার ৬ নম্বর আউলিয়াপুর ইউনিয়নের যোগীবাড়ী গ্রামের মরহুম মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেনের বড় ছেলে নুরুজ্জামান বাংলানিউজকে এই আক্ষেপ ও দাবি জানান।

এর আগে, বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) রাষ্ট্রীয় মর্যাদা (গার্ড অফ অনার) ছাড়াই দাফন সম্পন্ন করা হয় মরহুম মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেনের। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানের শেষ বিদায়ের সময় সেখানে বিগউলে বাজেনি বিদায়ের সুর। জানাযার আগে ম্যাজিস্ট্রেট মহসীন উদ্দিনের নেতৃত্বে পুলিশ প্রশাসনের চৌকস দল গার্ড অব অনার জানাতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন। এমনকি মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেনের মরদেহ জাতীয় পতাকায় আচ্ছাদিত করা হয়নি।

রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়নি মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইলের

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম এমপির বরাররে এমন একটি চিঠি লেখার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেন। তার মুক্তিবার্তা নম্বর ০৩০৮০১১০০২, ভাতা বই নং-৮১৯।

নিহত মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেনের বড় ছেলে বাংলানিউজকে আরও বলেন, দিনাজপুরের এসিল্যান্ড অফিসে (সহকারী কমিশনার ভুমি) অস্থায়ী ভিত্তিতে আমার ছোট ভাই নুর ইসলাম গত ২০১৭ সালের ৪ সেপ্টেম্বর গাড়িচালক পদে চাকরি পান। চাকরি নেওয়ার পর থেকেই দিনাজপুরের এসিল্যান্ড (সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার-(ভূমি) আরিফুল ইসলাম) ও তার স্ত্রী নিজ বাড়ির বাজার করিয়ে নিতেন। বাড়ির যাবতীয় অন্যান্য কাজও করিয়ে নিতেন আমার ভাই নুর ইসলামকে দিয়ে। এমনকি বাড়ির রান্না ও শৌচাগারও পরিষ্কার করিয়ে নিতেন। সম্প্রতি আমার ভাই কোনো অপরাধ না করলেও তাকে গাড়িচালক পদ থেকে চাকরিচ্যুত করেন এসিল্যান্ড আরিফুল ইসলাম।

তিনি বাংলানিউজকে আক্ষেপ আরও বলেন, আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা। ছোট ভাইয়ের চাকরি ফেরত পাইয়ে দেওয়ার জন্য আমার বাবা প্রশাসনের সবস্তরের গেছেন। কিন্তু কেউ তাকে সম্মানটুকুও দেখায়নি। দিনাজপুরের জেলা প্রশাসকের কাছে বাবা ও ছোট ভাই দেখা করতে গিয়েছিলেন। এজন্য জেলা প্রশাসক রাগান্বিত হন বাবার ওপর। সর্বশেষ এসিল্যান্ডের (সহকারী কমিশনার ভূমি) কাছে বাবা ও ছোট ভাই গিয়েছিলেন দেখা করতে। কিন্তু একজন অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া গাড়িচালকের বাবার সঙ্গে দেখা করা উচিত মনে করেননি এসিল্যান্ড। একজন মুক্তিযোদ্ধা বেঁচে থাকাকালীন সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্নভাবে সম্মান পেয়ে থাকেন। কিন্তু মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয়ভাবে দাফন মুক্তিযোদ্ধা ছাড়া কারও ভাগ্যে জোটেনা। আমার বাবা প্রশাসনের ওপর এতই নারাজ হয়েছেন যে, মৃত্যুর পর শেষ রাষ্ট্রীয় সম্মানটুকুও নিতে অপরাগতা প্রকাশ করেছেন। আমাদের কাছে লিখে গেছেন ওছিয়দনামা।

চিঠিতে যা লিখে গেছেন তার মূল কথা হচ্ছে

‘গত ২০১৭ সালের ৪ সেপ্টেম্বর সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিমের সুপারিশে ছেলে নূর ইসলামের নো-ওয়ার্ক নো-পে ভিক্তিতে এসিল্যান্ডের গাড়িচালক হিসেবে চাকরি হয়। সেই সুবাদে নূর ইসলাম সদরে এসিল্যান্ডের গাড়ি চালাতেন। কর্মস্থলে বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে হুইপ ইকবালুর রহিমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এসময় তিনি বিষয়টি দেখবেন বলে সেখানে উপস্থিত এডিসি রাজস্বকে বিষয়টি দেখতে বলেন। হুইপকে বিষয়টি অবগত করায় প্রশাসন থেকে প্রথমে নূর ইসলামকে তার বসবাসরত খাস পরিত্যক্ত বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেওয়া হয়। একই মাসের শেষ দিকে এসিল্যান্ডের স্ত্রী নূর ইসলামকে শৌচাগার পরিষ্কার ও মাংস রান্না করতে বলেন। মাংস রান্না ঠিক না হওয়াসহ বিভিন্ন অজুহাতে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে চাকরিচ্যুত করা হয়। পরে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়াকে নিয়ে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনিও (ডিসি) ক্ষিপ্ত হয়ে যান। এছাড়াও নূর ইসলাম তার স্ত্রী-সন্তান নিয়ে মাফ চাওয়ার জন্য এসিল্যান্ডের স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেলে ৩ ঘণ্টা অপেক্ষা করেও তারা দেখা করতে পারেনি। চাকরি চলে যাওয়ায় উপায় না পেয়ে হুইপ ইকবালুর রহিমের সঙ্গে দেখা করেন। কিন্তু প্রশাসন সেটি চরম নেগেটিভভাবে নেয়। বর্তমানে তার ছেলেটি চাকরিচ্যুত ও বাস্তুচ্যুত হয়ে স্ত্রী-পুত্র ও পরিজন নিয়ে অর্ধাহারে-অনাহারে মানবেতর জীবন-যাপন করছে।

তিনি আরও লিখেছেন, জীবন বাজি রেখে অস্ত্র হাতে নিয়ে করা স্বাধীন দেশে আমার ছেলের রুজি রোজগারটুকুও অন্যায়ভাবে কেড়ে নেওয়া হলো। গত ২১ অক্টোবর থেকে এম আব্দুর রহিম মেডিক্যাল কলেজ হাসাপাতাল দিনাজপুরের কার্ডিওলজি বিভাগে, ওয়ার্ড নম্বর -২, বেড নম্বর-৪৪ এ ভর্তি অবস্থায় আছি, এই পত্রটি তোমার কাছে লিখছি। তোমার কাছে আমার আকুল আবেদন- ‘তুমি ন্যায় বিচার করো। ঠুনকো অজুহাতে আমার ছেলেটিকে চাকরিচ্যুত করায় তাকে চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করো।’

আমার বয়স প্রায় ৮০ এর কাছাকাছি। ছেলেটি হঠাৎ করে চাকরিচ্যুত হওয়ায় আমি শারীরিকভাবে অসুস্থ তারপর মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছি। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে হঠাৎ যদি আমার মৃত্যু হয়, আমাকে যেন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন না করা হয়। কারণ এসিল্যান্ড, ইউএনও, এডিসি, ডিসি যারা আমার ছেলেকে চাকরিচ্যুত, বাস্তুচ্যুত করে পেটে লাথি মেরেছে, তাদের সালাম-স্যালুট আমার শেষ যাত্রার কফিনে আমি চাইনা।’

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

2 + two =