আইন দিয়ে কখনোই দুর্নীতি বন্ধ করা যায় না : ব্যারিস্টার আমীর

0
476

‘দুর্নীতির মহাপ্লাবন’ চলছে মন্তব্য করে তা রুখতে সামাজিক মূল্যবোধ তৈরিতে মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম।এর থেকে উত্তরণে স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষা কাঠামোর বিভিন্ন স্তরে মূল্যবোধ তৈরির বুদ্ধিবৃত্তিক কাঠামো করার ওপর জোর দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী।

দুর্নীতি দমনে আইনজীবী ও বিচার বিভাগের ভূমিকা নিয়ে তিনি বলেন, “আমি মনে করি, এটা অত্যন্ত সীমিত একটা পরিসর। আইন দিয়ে কখনোই দুর্নীতি বন্ধ করা যায় না। জেল দিয়েও দুর্নীতি বন্ধ করা যায় না। দুর্নীতি হচ্ছে মানুষের ও সমাজের মূল্যবোধের বিষয়।

“আমদের সমাজে বিশেষ করে বর্তমান প্রেক্ষিতে যেখানে আমরা দেখছি যে, প্রতিদিন ছয়টি শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে সেখানে এ মূল্যবোধ আমরা কীভাবে তৈরি করতে পারি সেটা আমাদের ভেবে দেখতে হবে। আমাদের মানবতা-মূল্যবোধ আজ প্রচণ্ডভাবে পর্যদুস্ত।”

শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে দুর্নীতি দমনে আইনজীবী ও বিচার বিভাগের ভূমিকা নিয়ে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) আয়োজিত সেমিনারে আমীর-উল ইসলাম এসব কথা বলেন।

সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য আমীর-উল ইসলাম বলেন, “সংবিধানের ঘোষণাপত্রে যে বিষয়টিকে আমরা প্রাধান্য দিয়েছিলাম সেটা হচ্ছে, সাম্য, মানবিক মূল্যবোধ এবং সামাজিক ন্যায়বিচার। সামাজিক ন্যায়বিচার যদি ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে কোনো বিচারালয় হোক আর প্রিভি কাউন্সিল হোক সেখান থেকে ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে না। ন্যায়বিচার আসে সামাজিক ন্যায়বিচার থেকে। সেই সামাজিক ন্যায়বিচারের জায়গাটা আজ বাংলাদেশে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। এটা যে কত বড় বিপদ সংকেত তা ভাষায় বর্ণনা করতে পারব না।

“পৃথিবীর আর কোনো দেশে এ রকম ঘটনা ঘটেছে তার কোনো নজির নাই আজ বাংলাদেশে যেটা ঘটছে। এটা খুব অশনি সংকেত। তাই দুর্নীতিকেও আমাদের সেই মাপেই চিন্তা করতে হবে।”

ব্যারিস্টার আমীর বলেন, “আগেও আমি দুদকের সভায় বলেছি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে স্কুল থেকে শুরু করতে হবে। স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনকে একটা বুদ্ধিবৃত্তিক কাঠামো তৈরি করতে।

“সমাজে নৈতিকতা যদি ফিরে না আসতে পারে তাহলে আইন দিয়ে, খাঁচা দিয়ে দুর্নীতি বন্ধ করা যাবে না। মৃত্যুদণ্ড দিয়েও বন্ধ করা যাবে না। সেই কারণে আমি মনে করি, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যদি একে দেখতে হয় তাহলে আমাদের একটি আন্দোলন শুরু করতে হবে।”

দুর্নীতিবিরোধী পাঠ্যসূচি প্রণয়নের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “আমার মনে হয়, এসব (দুর্নীতি দমন) নিয়ে যারা গবেষণা করছেন, কাজ করছেন তাদের নিয়ে, পাঠ্যপুস্তক বোর্ডকে নিয়ে বসে একটি পাঠ্যসূচি তৈরি করি বিভিন্ন স্তরে।

“স্কুল-কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাঝে দুর্নীতিবিরোধী ক্যাম্পেইন করতে হবে। না হলে এ জাতিকে বাঁচানো যাবে না।”

দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের সাথে নারী-শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনও যোগ করার আহ্বান জানান ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম।

তিনি বলেন, “যে অবক্ষয়টা ঘটেছে বর্তমান অবস্থাতে, এই যে নারী-শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ যেটা ঘটছে এই আন্দোলনের সাথে যোগ করে এর বিরুদ্ধেও ক্যাম্পেইন করতে হবে। আমাদের দেশে যদি নূহের প্লাবন হত তাহলে যেভাবে করার দরকার ছিল, সে প্লাবন কিন্তু এসেছে, সুতরাং দেশটাকে বাঁচাতে হলে আমাদের তা মোকাবেলা করতে হবে। এই যে দুর্নীতির একটা মাহাপ্লাবন এসেছে সে প্লাবন আমাদের রুখতে হবে।”

বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম বলেন, “দুর্নীতি নিয়ে আমরা সভ্যতার কথা বলছি, দেশকে দুর্নীতির হাত থেকে বাঁচাতে হবে এসব কথা এখন বলা হচ্ছে। দুর্নীতি নিয়ে শুধু কথা বললেই হবে না। এটা নিয়ে আমাদের বাস্তবে কাজ করতে হবে। যে যেখানে আছেন তার স্থান থেকে তিনি যদি ঠিকমতো কাজ করেন আমার বিশ্বাস দুর্নীতির পরিমান কমিয়ে আনা যাবে।”

আপিল বিভাগের সাবেক এই বিচারপতি বলেন, “আমাদের দেশে যারা বড়লোক আমার বিশ্বাস যে কোনো দুর্নীতির গোড়ায় তারা জড়িত। শুধু চুনোপুঁটিদের পেছনে ছুটে লাভ নেই। চুনোপুঁটি বাদ দিয়ে রুই কাতলা ধরতে হবে। এগুলো ধরতে গেলে জনসাধারণের সমর্থন দরকার, বিশিষ্ট লোকদের সমর্থন দরকার, সমস্ত জাতির সমর্থন দরকার। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের জাতি এই সমর্থন দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।

“মামলার ক্ষেত্রে আমরা দেখি আসামি যদি একটু কম ক্ষমতাবান হয়, বিরোধী দলের সমর্থক হয় তাহলে খু্ব কুইক কাজ হয়ে যায়। এই কুইক কাজটা শুধু তাদের জন্য নয়, সমস্ত দুর্নীতিবাজদের জন্য হোক। যাতে মানুষের মনে এ বিশ্বাস জন্মে যে, অন্যায় করে ছাড় পাওয়া যায় না।”

দুর্নীতি দমনে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বিচারকের সংখ্যা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার কথাও বলেন সার্বোচ্চ আদালতের সবেক এই বিচারক।

এছাড়া কারও পক্ষে আইনজীবী না দাঁড়ানো সংবিধানবিরোধী এবং বার কাউন্সিল আইনের বিরোধী উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আইনজীবীরা তো কাগজপত্র পেয়ে মামলা লড়েন। বার কাউন্সিল আইনে আইনজীবীদের করণীয় বলে একটা কথা বলা হয়েছে। আমি মনে করি, এক আইনজীবীর কাছে যে মক্কেল যাবেন, আইনজীবীকে তার প্রতি দায়িত্ব ঠিকভাবেই পালন করতে হবে। সে মক্কেলকে সহায়তা করতে আইনজীবী বাধ্য। বার কাউন্সিল আইনও তাই বলে।

“কারও পক্ষে কোনো আইনজীবী না দাঁড়ানো সংবিধানবিরোধী, বার কাউন্সিল আইন বিরোধীও। যে মক্কেল যতটুকু আইনগত সহায়তা পেতে পারে একজন আইনজীবী তা দিতে বাধ্য।”

দুর্নীতির বিরুদ্ধে সমন্বিত সামাজিক আন্দোলনের আহ্বান জানিয়ে সাবেক আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু বলেন, “ঢাকা শহরে একটি সেতু তৈরি করতে বরাদ্দ যেখানে পনেরশ কোটি টাকা সেখানে বিচার বিভাগের জন্য এবারের বাজেটে বরাদ্দ সতেরশ কোটি টাকা! বিচার বিভাগ মানুষের শেষ আশ্রয় স্থল। এর বাজেট বাড়াতে হবে। বিচারের সেবাকে মানুষের কাছে সহজলভ্য করে তুলতে হবে।

“বিচারকের উপরে যে চাপ সে চাপ কমাতে হবে। আজ ৩৫ লাখ মামলার বিপরীতে মাত্র ১৬০০ বিচারক। মামলা দ্রুত শেষ করতে বিচারকের সংখ্যা বাড়াতে হবে। দুর্নীতি দমন করতে হলে সাংবিধানিক-প্রাতিষ্ঠানিক জায়গাগুলোকে স্বাধীন-সক্রিয় করতে হবে। পাশাপাশি সমন্বিত সামাজিক আন্দোলন করতে হবে।”

মুল প্রবন্ধে ব্যারিস্টার হাসান এম এস আজিম বলেন, “দুর্নীতি আইনের শাসন ও সুশাসনের অন্তরায়। দুর্নীতির বিরূপ প্রভাবে অগ্রগতি থমকে যায়। এর প্রভাবে সাধারণ মানুষের আইনগত ও মৌলিক অধিকার খর্ব হয়।”

প্রবন্ধে বলা হয়, “বাংলাদেশে জবাবদিহির প্রক্রিয়া অত্যন্ত দুর্বল। সে কারণে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন নিয়মে পরিণত হয়েছে। আপাতভাবে আইনের শাসনের অভাব, সুশাসনের অভাব, জবাবদিহির অভাব এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে দুর্নীতি ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছে। তাই জাতি গঠনে নীতিনৈতিকতার শিক্ষা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।”

সভাপতির বক্তব্যে মনজিল মোরসেদ বলেন, “আমাদের প্রত্যাশা দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাধীনভাবে দুর্নীতি দমন করে প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে সচেষ্ট হবে। আর সংসদ সদস্য, মন্ত্রী যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে সরকার তাদের অপসারণ করবে।”

দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সামাজিক আন্দোলনের পাশাপাশি সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টিরও আহ্বান জানান সেমিনার আয়োজনকারী সংগঠনটির সভাপতি মনজিল।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

8 − five =