প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য কর্মকাণ্ডের সম্মিলিত ফসল হচ্ছে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ

0
532

বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন স্বাধীনতার সমার্থক। স্বাধীনতার প্রশ্নে সদা-সর্বদা-সর্বাগ্রে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারিত হয়। বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ হাজার বছরের শৃঙ্খল ভেঙে দৈন্য, গ্লানি অতিক্রম করে স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে আনতে সব বিরোধ ছাপিয়ে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অথচ বঙ্গবন্ধুর নামে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে- এটা ইতিহাসে বিরল ঘটনা।

প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য কর্মকাণ্ডের সম্মিলিত ফসল হচ্ছে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ। অপ্রকাশ্য কর্মকাণ্ডের নায়ক হচ্ছেন সিরাজুল আলম খান। কেউ কেউ এ সত্যকে বলি দিয়ে ইতিহাস রচনা করতে চাচ্ছেন। সিরাজুল আলম খান ষাট-সত্তর দশকে লাখ লাখ তরুণ ছাত্রসমাজের কাছে ছিলেন স্বাধীনতার স্বপ্নের সারথি। তিনি ছিলেন তরুণ ছাত্র ও যুবসমাজকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করার প্রেরণাদাতা। বঙ্গবন্ধু উপাধির পরিকল্পনা, পতাকা উত্তোলন, ইশতেহার পাঠ, জয়বাংলা বাহিনী, বিএলএফ গঠনসহ ছাত্র ও যুবসমাজের মননে স্বাধীনতার স্বপ্ন বপন করার অসাধ্য কর্মকাণ্ডের অদৃশ্য নায়ক সিরাজুল আলম খান। স্বাধীনতার অন্তঃপ্রাণ সিরাজুল আলম খান ছিলেন বঙ্গবন্ধুর একান্ত ও খুবই আস্থাভাজন। যারা অপ্রকাশ্য কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না বা আংশিক জড়িত থাকলেও পূর্ণাঙ্গ বিষয় জানেন না, তারা নিউক্লিয়াস, জয় বাংলা বাহিনী, বিএলএফের কর্মযজ্ঞ নিয়ে কীভাবে অভিমত প্রদান করেন?

সিরাজুল আলম খানের একটি রাজনৈতিক জীবনালেখ্য শামসুদ্দিন পেয়ারা দীর্ঘ ৩৬ বছর তাগিদ দিয়ে ক্ষুদ্র আকারে প্রকাশ করতে পেরেছেন। এটা সিরাজুল আলম খানের জীবনীগ্রন্থ নয়, স্মৃতিকথাও নয়; স্বাধীন বাংলার জন্য যা করেছেন তার অংশবিশেষ। এ বই নিয়ে ক্রোধের যে মাত্রা দেখলাম, কৃতজ্ঞতার যে প্রকাশ দেখলাম, শ্রদ্ধাবোধের যে নমুনা দেখলাম, দ্বিমতের যে বর্ণনা দেখলাম; এতে আমার এক নবতর উপলব্ধির জন্ম হয়েছে। সে উপলব্ধি হচ্ছে, জাতি হিসেবে আমরা চিরকাল অকৃতজ্ঞ। যে দেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করতে পারে, তাজউদ্দীন আহমদসহ জাতীয় চার নেতা ও শেখ ফজলুল হক মনিকে হত্যা করতে পারে, ১৫ আগস্টকে নাজাত দিবস পালন করতে পারে; যে দেশের মানুষ ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতার হওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে, ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শেষে জয় পাকিস্তান বলেছিলেন বলে যারা সাক্ষ্য দিতে পারে, সেখানে পদ-পদবিবিহীন সিরাজুল আলম খানকে অস্বীকার বা তুচ্ছ করা কোনো বিষয়ই নয়। ৩০ লাখ শহীদের রক্ত, বঙ্গবন্ধুর আত্মদান আমাদের হীনমন্যতা ধুয়ে-মুছে দিতে পারেনি। আমরা আত্মরক্ষার্থে বা কারও ক্ষতি করতে মিথ্যা অস্ত্র ব্যবহারে অতুলনীয়।

কেউ যদি মানসিক প্রস্তুতি বা পরিকল্পনা গ্রহণ করেন, তাহলে যে কোনো বিষয়কে টেনেহিঁচড়ে বিষোদ্গারের উপযোগী করা যায়। তার একটি উদাহরণ, বঙ্গবন্ধু ৭ জুন ১৯৬৬ মঙ্গলবার ‘কারাগারের রোজনামচা’য় লিখেছেন, ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকা সংবাদ পরিবেশন ভালই করেছে, আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আজ প্রদেশে হরতাল এবং পাকিস্তান অবজারভার হেড লাইন করেছে ‘হরতাল’ বলে। এখানে বঙ্গবন্ধু কেন ইত্তেফাকের কথা উল্লেখ করেন নাই; কোন মতলবে ইত্তেফাক ও মানিক মিয়ার অবদান অস্বীকার করেছেন; বিষোদ্গারকারীরা বিবেকের তাড়নায় এ প্রশ্ন উত্থাপন করে শেষে বলতে পারেন কেন বঙ্গবন্ধু ইত্তেফাক ও মানিক মিয়ার অবদান অস্বীকার করে ইতিহাস বিকৃত করেছেন, জানি না। সিরাজুল আলম খানকেও তেমনি টেনেহিঁচড়ে বিষোদ্গারের উপকরণে পরিণত করছেন। তার সব অবদানকে অস্বীকারে আত্মিক সন্তুষ্টি লাভ করেছেন। এসব বিষয়ে সিরাজুল আলম খান প্রতিবাদ করার বিন্দুমাত্র তাগিদ অনুভব করেন না। রাষ্ট্র নির্মাণে ভূমিকা বা অবদানের স্বীকৃতি কারও প্রত্যয়নপত্র দিয়ে নির্ধারিত হয় না। স্বাধীনতা বা রাষ্ট্রীয় রাজনীতির প্রয়োজনে বঙ্গবন্ধু ও সিরাজুল আলম খানের মধ্যে কথা হয়েছে কতবার, তা কেবল তারাই জানেন। আর সিরাজুল আলম খান নিজেই বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা হয়েছে- সেটাও বিতর্ককারীরা অস্বীকার করেছেন। তারা বলতে চেয়েছেন, তাদের জানার বাইরে বঙ্গবন্ধু কারও সঙ্গে কথা বলতে পারেন না। তাদের জানার বাইরে বঙ্গবন্ধুর বাসায় কেউ যেতে পারেন না- এসব বক্তব্য বঙ্গবন্ধুর জন্য খুবই অপমানজনক।

আমাদের রাষ্ট্রক্ষমতার সংস্কৃতি ভয়াবহ। পক্ষে থাকলে গৌরব ও সম্মান, আর বিপক্ষে থাকলে অপমান-অসম্মান। আমাদের সত্য পরিবর্তন হয়ে যায় ক্ষমতার আলোকে। ক্ষমতার দম্ভে সত্যকে হত্যা করা যায়- এটাও অনেকে বিশ্বাস করতে শুরু করেন। তারা মনে করেছেন, মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস কেবল তাদের জন্য বরাদ্দ। স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ এক বিরাট কর্মযজ্ঞ। এতে রয়েছে অসংখ্য মানুষের অবদান। অন্যের কৃতিত্ব-অবদান-আত্মত্যাগকে অস্বীকার করে নিজের ভাবমূর্তি এবং খ্যাতি বাড়ানো যে ভয়ঙ্কর অন্যায়- সেটা আমরা অনেকেই জানি না। আমরা অনেকেই কাজ করেছি ইতিহাসে স্থান নেওয়ার জন্য আর অনেকেই কাজ করেছেন ইতিহাস নির্মাণের জন্য। বঙ্গবন্ধু ও সিরাজুল আলম খানের সম্পর্ক, সম্পর্কের গভীরতা-নৈকট্য-উচ্চতা নিয়ে অনেকেরই ধারণা নেই, জানাও নেই।

আমরা বর্তমানের স্বার্থ-সংঘাতের ভিত্তিতে অতীতের মূল্যায়ন করতে গিয়ে ‘৭১-এর অনেক বীর সিপাহসালার, সেক্টর কমান্ডার এবং বীরউত্তম খেতাবপ্রাপ্তদের পাকিস্তানি চর বা রাজাকার বলতেও দ্বিধাবোধ করিনি। এসব বলার মাধ্যমে যে মুক্তিযুদ্ধকে অপমান করা হয়- এটুকু উপলব্ধি আমাদের হয় না। দলীয় রাজনীতি ও সংস্কৃতি যে কী ভয়ঙ্কর তার প্রমাণ হচ্ছে ১৫ আগস্ট। বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে খুন করার পর সিঁড়িতে লাশ রেখেই দলীয় নেতারা মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন। সেই মন্ত্রিপরিষদের প্রথম বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর নামে শোক প্রস্তাব উত্থাপনের কেউ প্রয়োজন মনে করেননি। সেই সরকারই বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বন্ধে ইনডেমনিটি আইন প্রণয়ন করে।

স্বাধীন রাষ্ট্র নির্মাণে যুক্ত থাকার অপরাধে বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, শেখ ফজলুল হক মনিসহ তাদেরকে খুন করে আমরা জাতি হিসেবে অকৃতজ্ঞ- তার প্রমাণ দিয়েছি। সিরাজুল আলম খানকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় বিচারের সম্মুখীন করা বা অপঘাতে মৃত্যু যে এখনও হয়নি, তাতেই তাকে ভাগ্যবান মনে করছি। সিরাজুল আলম খান কৃতিত্ব নিতে চাইলে নিজেই বঙ্গবন্ধু উপাধি প্রদান করতে পারতেন, পতাকা উত্তোলন করতে পারতেন, ইশতেহার পাঠ করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে যার দ্বারা যে কাজ তার দ্বারা সেই কাজ সম্পন্ন করাকেই কর্তব্য মনে করেছেন; নিজের কৃতিত্বকে তুচ্ছ করে দেখেছেন। তিনি স্বাধীনতার জন্য নিবেদিতপ্রাণ।

আমরা যারা কতিপয় স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে একটু অবদানের সৌভাগ্য অর্জন করেছিলাম, তারা গত ৪৮ বছর ধরে প্রতিদিন রেডিও-টিভি, সংবাদপত্র, জনসভা ও স্মৃতিচারণে আমাদের ভূমিকা-অবদান নিয়ে কথা বলে যাচ্ছি। কিন্তু সেই অবদানের কথা আর শেষ হচ্ছে না। আর সিরাজুল আলম খান গত ৪৮ বছরে একদিনও কোনো রেডিও-টিভি বা পত্রপত্রিকায় সাক্ষাৎকার দেননি। পত্রিকায় কোনো লেখা পাঠাননি; জনসভা বা কোনো আলোচনা সভায় স্মৃতিচারণ করেননি।

গত ৪৮ বছরে কখনও দলীয় পদ বা সরকারি পদ-পদবি গ্রহণ করেননি। আমরা অনেকেই মন্ত্রী-এমপি হয়েছি, গাড়ি-বাড়ির মালিক হয়েছি, সংসার-পরিবারের অধিকারী হয়েছি। শুধু একজন সিরাজুল আলম খান রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে নিজেকে উৎসর্গ করে সংসার জীবন ত্যাগ করেছেন; ব্যক্তিগত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বলতে কিছুই নেই। এসবের প্রতি তার কোনো মোহও নেই। এই প্রজন্মে এমন অসাধারণ মানুষ খুব দুর্লভ।

গত ৪৮ বছরে আমরা বাগাড়ম্বর করে যাচ্ছি। সেখানে সিরাজুল আলম খান জাতির উত্থান-পতনের কারণ, সভ্যতার ক্রমবিকাশের পেছনে মূল চালিকাশক্তি কী, সমাজের অভ্যন্তরে নতুন সমাজ-শক্তির উদ্ভব; এসব সমাজ-শক্তির রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের আন্তঃসম্পর্ক, সমাজ-শক্তিগুলোর রাজনৈতিক ভূমিকা ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছেন। একুশ শতকের বাঙালি অর্থাৎ বাঙালি এখন তৃতীয় জাগরণের পর্যায়ে রয়েছে। এই জাগরণ বাঙালি জীবনে নবতর সামাজিক উপাদানে সমৃদ্ধ জাতিসত্তার উচ্চতর বিকাশ নিয়ে নতুন তত্ত্ব নির্মাণ করেছেন। স্বাধীন দেশের রাজনীতিতে তত্ত্বগত দিকনির্দেশনার প্রয়োজনে শাসনতন্ত্র ও শাসনতান্ত্রিক রূপরেখা প্রণয়ন করেন ড. জিল্লুর রহমান খানসহ যৌথভাবে। সিরাজুল আলম খান বাংলাদেশের সমাজ অভ্যন্তরে শ্রেণিশক্তি-রাজনৈতিক ঐতিহাসিক পটভূমি বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকশিত রূপ, রাজনৈতিক প্রযুক্তি নিয়ে অবিরাম গবেষণা করে যাচ্ছেন।

বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বজাতির স্বভাব সম্বন্ধে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছেন, যদিও জাতি হিসেবে বাঙালি পরশ্রীকাতরতার জাতি। ‘পরশ্রীকাতরতা’ দুনিয়ার কোন ভাষায় খুঁজে পাওয়া যাবে না, একমাত্র বাংলা ভাষা ছাড়া। বঙ্গবন্ধুর এই গভীর উপলব্ধির নির্মম শিকার হয়েছেন নিজেই; নিজের দল আওয়ামী লীগ দ্বারা। বাংলাদেশের মতো রাজনৈতিক বিপ্লবের ফসল যেসব রাষ্ট্র নির্মাণ হয়েছে, সেসব দেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় জাতির পিতা বা স্থপতিদের অবদানের কথা লিপিবদ্ধ রয়েছে। ভিয়েতনাম, চীন, কোরিয়া, তুরস্কের সংবিধানের প্রস্তাবনায় তাদের মহান নেতাদের অবদান উল্লেখ করে (হো চি মিন-সান ইয়াৎ সেন-মাও সে তুং-কিম ইল সুং-কামাল আতাতুর্ক) সর্বোচ্চ সাংবিধানিক মর্যাদা প্রদান করেছে, কেবল বাংলাদেশ ছাড়া। বাংলাদেশের ‘৭২-এর সংবিধানে বঙ্গবন্ধুর নাম একবারও উচ্চারিত হয়নি। কোনো অবদানের কথাই বলা হয়নি। এমনকি ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণার কথা ‘৭২-এর সংবিধানে উল্লেখ নেই। সে পরশ্রীকাতরতায় সিরাজুল আলম খান জাতির কাছে অপমানিত-লাঞ্ছিত হবেন না- তা কী করে সম্ভব? দলীয় রাজনীতি ও সংস্কৃতির সীমাবদ্ধতা-রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকে সরকারি ইতিহাস নির্মাণের প্রবণতার বাইরে

যখন মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস নির্মিত হবে,

তখন সিরাজুল আলম খানসহ যার যা অবদান, তা লিপিবদ্ধ হবে।

দলীয় স্তাবকরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দিকে ঠেলে দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার চেয়ে সরকারি পদ-পদবি নিয়ে ব্যস্ত ছিল- এসব নিয়ে আমাদের কোনো আত্মোপলব্ধি নেই। ষাট-সত্তরের দশক ছিল অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের বিশ্ব। সরকার উৎখাত ও রক্তপাতের বিশ্ব। বাংলাদেশের স্বাধীনতার অন্যতম বিরোধিতাকারী পরাশক্তি ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সিআইএ বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত- এটা সবারই জানা। এর মধ্যেই চিলির জাতীয়তাবাদী নেতা সালভেদর আলেন্দেকে হত্যা করা হয়েছে। এত কিছুর পরও বঙ্গবন্ধুকে নিরাপত্তা দেওয়ার বিশেষ কোনো উদ্যোগ কেন নেওয়া হয়নি? কেন রক্ষীবাহিনী বা সেনাবাহিনীর প্রবল নিরাপত্তার চাদরে ৩২নং ধানমণ্ডি ঢেকে দেওয়া হয়নি? এগুলোর মূল্যয়ন করা অতীব জরুরি। বঙ্গবন্ধুর সরকারের বিরুদ্ধে কিছু ঘটছে- এটা বাতাসে গুঞ্জন চলছিল। কিন্তু দলীয় স্তাবকরা এসবকে গুরুত্ব না দিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতি অবহেলাকেই নিশ্চিত করেছে। অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের বিশ্বে বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে- এটা বোঝার জন্য মহামতি লেনিন হওয়ার দরকার ছিল না। উপমহাদেশের অহিংসার নেতা মহাত্মা গান্ধী সহিংসতার শিকার- এটার জানার পরও বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা যারা নিশ্চিত করল না, তারা জাতির কত বড় সর্বনাশের ভাগীদার- তা নির্ধারণ করা উচিত।

সিরাজুল আলম খান বুঝতে পেরেছিলেন, ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে যেমন রক্ষা করা সম্ভব হবে না, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। তাই তিনি ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই বঙ্গবন্ধুর কাছে লিখিত ১৫ দফা উপস্থাপন করেছিলেন। তার প্রথম দফাই ছিল অসম্পূর্ণ সশস্ত্র যুদ্ধ সম্পন্ন করার লক্ষ্যে স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনায় বাংলাদেশকে পুনর্গঠনের বিশেষ পর্যায় পর্যন্ত একটি ‘বিপ্লবী জাতীয় সরকার’ দ্বারা পরিচালিত হবে। সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেওয়া সব দল ও গ্রুপের সমন্বয়ে গঠিত এই সরকারের প্রধান থাকবেন বঙ্গবন্ধু। ৩নং দফায় ছিল বঙ্গবন্ধুর মর্যাদার বিষয়ে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বঙ্গবন্ধু থাকবেন সব দলের ঊর্ধ্বে। প্রয়োজনে তিনি রাজধানীর বাইরে অবস্থান করবেন। তাঁকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতির চেতনা বিকাশের ধারা প্রবাহিত হবে। ৫নং দফায় ছিল চিরাচরিত প্রথার সেনাবাহিনী গঠন না করে স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনায় জাতীয় পর্যায়ে ‘রেভল্যুশনারি গার্ড বাহিনী’ গঠন করা হবে। সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈনিক ‘এফএফ’ এবং ‘বিএলএফ’সহ সশস্ত্র যোদ্ধাদের নিয়ে এই বাহিনী তৈরি হবে। এর সমান্তরাল অন্য কোনো বাহিনী থাকবে না। ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার বিপরীতে যদি ‘বিপ্লবী জাতীয় সরকার’ গঠন হতো এবং চিরাচরিত সেনাবাহিনীর বিপরীতে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বীর যোদ্ধাদের নিয়ে সেনাবাহিনী গঠিত হতো, তাহলে বঙ্গবন্ধু হত্যা কোনোক্রমেই সম্ভব হতো না- এসব মৌলিক সত্য আমাদের অনুধাবন করতে হবে।

বাঙালির বৈশিষ্ট্য অনুধাবনে সমকালীন সবচেয়ে বড় ঘটনা বঙ্গবন্ধু হত্যা। বঙ্গবন্ধু হত্যা কী পরিমাণ অকৃতজ্ঞ জাতিতে পরিণত করেছে, তা আমাদের যেমন উপলব্ধিতে নেই; তেমনি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডকে দোষারোপের বৃত্তেই আবদ্ধ করে রেখেছি; কোনো আত্মসমালোচনা নেই।

মহাত্মা গান্ধীকে হত্যার আশঙ্কা প্রকাশিত হওয়ার পরও তৎকালীন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার প্যাটেল যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করেননি, যা মওলানা আবুল কালাম আজাদ তার ‘ভারত স্বাধীন হলো’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন। মওলানা আবুল কালাম আজাদ বলেছেন, এ আমাদের চিরকালের লজ্জা আর দুঃখ যে আমাকে আজ কবুল করতে হচ্ছে- একেবারে প্রাথমিকতম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতেও আমরা অপারগ হয়েছি। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যার বাইরেও বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা নিয়ে এমন একটা আত্মসমালোচনা আমাদের কারও আছে?

সিরাজুল আলম খানের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারকারীরা ইতিহাসের সত্য অনুসন্ধানের জন্য নয়; ইতিহাস থেকে অন্যদের অবদান মুছে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। আমাদের জানার বাইরেও অনেক ঘটনার অনুঘটক ও সাক্ষী সিরাজুল আলম খান। তিনি যদি ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হলো’ বা ‘বঙ্গবন্ধুর সাথে স্মৃতিকথা’ লিখে যান, হয়তো অনেক অজানা কথা আমরা জানতে পারব।

মহান নেতা ফিদেল কাস্ত্রো বলেছেন, ‘এই যে নক্ষত্রের আলো সেও একদিন নিভে যাবে, সূর্য একদিন আর আলো দেবে না, পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে, সুতরাং কোনো কিছুতেই আমি জাহির করার কিছু দেখি না, ব্যক্তি হিসেবে আমাদের ভূমিকা খুবই সীমিত এবং আমাদের উচিত এই সীমাবদ্ধ ভূমিকাটুকু সঠিকভাবে পালন করা’- সিরাজুল আলম খান এই চেতনারই সার্থক উত্তরাধিকার।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

twenty − five =