জেলার শিল্পাঞ্চল অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে পরিচিত ফতুল্লা। শিল্পাঞ্চল এলাকা হিসেবে পরিচিত এ ফতুল্লায় জ্বালানী তেল সরবরাহকারী ডিপো স্থাপিত হয়েছে এ অঞ্চলে। বুড়িগঙ্গা নদী বেষ্ঠিত গড়ে উঠা জ্বালানী তেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে একদল তেল চোর চক্রের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। যমুনা ও মেঘনা ডিপোর তেল চুরিকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে কয়েকদফা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। অস্ত্রের ঝনঝনানিতে আতংকিত হয়ে পড়ে ডিপোর কর্মরত সাধারন কর্মজীবি মানুষ।
এক পর্যায়ে ক্ষমতার যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতাসীন দলের কথিত নেতারা নিয়ে নেন যমুনা ডিপোর চোরাই তেলের ব্যবসার নিয়ন্ত্রন। আর যমুনা ডিপোর চোরাই তেলের ব্যবসাকে পুঁিজ করে কয়েক বছরে টোকাই থেকে কোটিপতি বনে গেছেন এমন ব্যাক্তির সংখ্যাও কম নয়। আর এ চোরাই তেলের ব্যবসার নিয়ন্ত্রন নিতে ব্যবহার করা হচ্ছে স্থানীয় সাংসদ থেকে শুরু করে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশারী নেতাদের। ঠিক এমনি ভাবেই বর্তমানে ফতুল্লার যমুন ডিপোর চোরাই তেলের ব্যবসা নিয়ন্ত্রনে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের প্রয়াত সাংসদ নাসিম ওসমানের ছেলে আজমেরী ওসমানের নাম ব্যবহার করা হচ্ছে। বর্তমানে ফতুল্লার যমুনা ডিপোর চোরাই তেলের নিয়ন্ত্রক সাবেক সাংসদ সারাহ্ বেগম কবরীর ক্যাডার মির্জা পাভেল ক্ষমতাসীনদলের প্রভাবশালী নেতা এবং সাংসদদ্বয়ের ছেলে এবং ভাতিজার নাম ব্যবহার করে চোরাই তেলের ব্যবসা নিয়ন্ত্রন করে আসছে দীর্ঘদীন ধরে। এদিকে সরকারী সম্পদ রক্ষার্থে হার্ডলাইনে যাওয়ার ঘোষনা দিয়েছেন ফতুল্লা মডেল থানার ওসি আসলাম হোসেন। যে কোন কিছুর বিনিময়ে ফতুল্লার শান্তি নিশ্চিত এবং সরকারী সম্পদ রক্ষার্থে যমুনা ও মেঘনা ডিপোকে কেন্দ্র করে তেলচোরদের চিহ্নিত করে অভিযান পরিচালনা করা হবে বলে জানিয়েছেন স্থাণীয় প্রশাসন।
সূর্ত্রে জানা যায়, ফতুল্লার যমুনা ডিপোর তেলচোরদের নিয়ন্ত্রক‘পাভেল’ সবাই চিনে মির্জা পাভেল নামেই। বাবা হাবিবুর রহমান মুন্সি। নোয়াখালী জেলার হলেও নানা বাড়ির সূত্রে জন্মলগ্ন থেকেই পঞ্চবটিতে। মামা প্রভাবশালী অঢেল ভূসম্পদের মালিক মৃত গফুর ভূইয়া। মামাতো ভাই, খোকা, সেন্টু, রিপন, পিপুল এবং মাসুদ ওরফে ওলা মাসুদ। তাদের মধ্যে খোকা ও সেন্টু ছিলেন ভাগিনা ফরিদ ও ক্রসফায়ারে নিহত মমিনউল্লাহ ডেভিডের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ৯৬ সালে মুকুল হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে খোকা, সেন্টুসহ তাদের ৫ ভাই এবং আত্মী স্বজনেরা যুক্ত হন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। যদিও চাচা আব্দুর রশিদ আগের থেকেই ফতুল্ল থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং চাচাতো ভাই মুকুল ছিলেন একই থানা যুবলীগের সভাপতি। ৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে বেপরোয়া হয়ে উঠে মাসুদ ওরফে ওলা মাসুদ। বিশাল বাহিনী আর ঝুট সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে পুরো পঞ্চবটি এলাকাতেই ছিলো তার আধিপত্য। সেই সুবাধে তার ফুফাতো ভাই মির্জা পাভেল রাজনীতিতে হাতেখড়ি। উঠতি বয়স তার। ভাইদের দেখে দেখেই শেখা। তবে, এলাকায় প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি সে তখনও। ২০০১ সালে বিএনপি-জামাত জোট সরকার ক্ষমতায় এলে এলাকা ছেড়ে গা ঢাকা দেন মাসুদ। বসতি গড়েন ঢাকার কেরানীগঞ্জে। আর মির্জা পাভেল কোনো রকম গোবেচারা টাইপ এলাকাতেই থেকে যায়। তার ছোট ভাই বাবু। বর্তমানে যাকে মানুষ চেনে, জানে বেয়াদ্দব বাবু হিসেবে। অনেকের কাছে সে মেজর বাবু হিসেবেও পরিচিত। এই বাবু বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ছিলো। সেই সুবাধে পাভেলরা ছিলো সুরক্ষিত। কিন্তু ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে সেনা বাহিনীর চাকরি থেকে চলে আসেন বাবু। কথিত রয়েছে শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে তার চাকরি চলে যায়। তবে, তাদের মামাতো ভাই মাসুদ পূর্বের অবস্থান থেকে ফিরে এসে নিজদের ব্যবসা বাণিজ্য নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তবে, পূর্বের স্বভাব বদলায়নি এখনও।
সূত্র মতে, কবরী এমপি হওয়ার পর তার পিএস হন ঢাকা-৫ আসনের বিএনপির সাবেক এমপি সালাউদ্দিনের ঘনিষ্ঠজন সেন্টু। এপিএস হন লাল চুইল্লা শফি। এই দুইজনের হাত ধরে পাভেল ভিড়ে যায় কবরী বলয়ে। নিজে হয়ে উঠেন স্বঘোষিত ছাত্রলীগ নেতা। বিশাল হোন্ডা বাহিনী নিয়ে ফতুল্লা, পঞ্চবটি, ধর্মগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকা দাবড়িয়ে বেড়াতো সে। ফলে রাতারাতি এলাকাজুড়ে ‘কবরীর ক্যাডার’ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে। সে সময়ই তার বাহিনী এবং তার ছোট ভাই মেজর বাবুর হাতে চলে আসে অবৈধ অস্ত্র।
পরবর্তীতে কবীর সময় শেষ হলে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন শামীম ওসমান। রাতারাতি বোল পাল্টে শামীম ওসমান বলয়ে ফিরে আসে পাভেল ও তার ছোট ভাই বাবু। কিন্তু বিশেষ একটা সুবিধে করতে পারেনি। তখন তারা দুই ভাই স্থানীয় মাদক সেবী ও ব্যবসায়ীদের একত্রিত করে ভিড়ে যায় আজমেরী ওসমানের বলয়ে। এই সুবাধে পুরো এলাকার নিয়ন্ত্রণ চলে যায় তাদের হাতে। পূর্বের যে কোনো সময়ের থেকেও বেপরোয়া হয়ে উঠে মির্জা পাভেল, মির্জা বাবু ওরফে বেয়াদ্দব বাবু ওরফে মেজর বাবু।
সূত্র মতে, আজমেরী ওসমানের নাম ভাঙিয়ে ফতুল্লার যমুনা ও মেঘনা ডিপোর চোরাই তেল ব্যবসার মূল নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠে পাভেল। তার সাথে তার ভাই বাবুও। বিশাল এক সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে প্রতিদিনই তেলবাহী জাহাজ, যমুনা ও মেঘনা ডিপো থেকে হাজার হাজার লিটার তেল চুরির মহোৎসবে মেতে উঠা তারা। সরকারি ঘরে চুরি করে রাতারাতি আঙুলফুলে কলাগাছ বনে যায় তারা।
স্থানীয় পর্যায় থেকে জানা যায়, এলাকার ছোট বড় ছিচকে সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকসেবীদের বিরাট অংশই নিয়ন্ত্রণ করে পাভেল ও তার ছোট ভাই বাবু। প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত পাভেলের অফিস খ্যাত তার মামা মৃত গফুর ভূঁইয়ার বাড়ির উল্টো দিকে আসর জমে। মাদকসেবী, বিক্রেতা আর তেল চুরির ভাগ বাটোয়ারা সবই হয় এখানে। এদিকে ক্ষমতাসীন দলের আর্শিবাদ থাকার কারণে তেল চুরি বেশ কয়েক বছর ধরে করে আসলেও পাভেলের টিকিটিও ছুঁতে পারেনি কেউ। ফলে এলাকাজুড়ে সে দুর্দান্ত প্রতাপের সাথেই তার অপকর্ম করে ফিরছিলেন। চলতি বছরে তথা এসপি হারুন নারায়ণগঞ্জে যোগ দেওয়ার পর ফতুল্লার চোরাই তেল ব্যবসায়ী ইকবালের আস্তানায় হানা দেয় ডিবি। কিন্তু তখনও সুরক্ষিত ছিলো পাভেলের ডেরা। ওই ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় পাভেল ও তার ভাই বাবুর নাম থাকলেও পুলিশ তাদেরকে গ্রেফতারে চেষ্টাও চালায়নি। শেষ পর্যন্ত র্যাব-১১ একটি দলের হাতে পাকড়াও হয় পাভেল ও তার এক সহযোগি উত্তম।
এদিকে পাভেলের আটকের সংবাদে বৈধ তেল ব্যবসায়ীদের মধ্যে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফিরে এলেও জামিনে বের হয়ে এসে পূনরায় পাভেল ও তার ভাই বাবু সেই পূর্বের অবস্থানেই ফিরে যান। এখনো রয়েছে বহাল তবিয়তে। রয়েছে তাদের বাহিনীও। তেল চুরিও চলছে পূর্বের দুর্দান্ত প্রতাপে। সন্ত্রাস, মাদক বিক্রেতাদের শেল্টার চলছে আগের মতো। অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে মহড়াও চলছে আগের মতো। তাই এলাকাবাসীর দাবি, সরকারী সম্পদ রক্ষাসহ এলাকার শান্তি বজায় রাখার ক্ষেত্রে তেল চোর কথিত ছাত্রলীগ নেতা পাভেলকে ও তার ছোট ভাই বেয়াদব বাবুকে গ্রেফতারের মাধ্যমে রক্ষিত অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান পরিচালনা করবেন সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ। আর এ জন্য নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের নব্য পুলিশ সুপার আনিছুর রহমানের হস্তক্ষেপই কামনা করেন স্থানীয়রা । কেননা, অবৈধ অস্ত্রের জোরেই স্থানীয়দের উপর প্রভাব বিস্তার করে এই চক্রটি।
এ ব্যাপারে ফতুল্লা মডেল থানার ওসি আসলাম হোসেন জানান, ফতুল্লাবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিন্তে বদ্ধ পরিকর স্থানীয় প্রশাসন। অপরাধী যত বড়ই ক্ষমতাশালী ব্যাক্তিই হউক না কেন তাদের ছাড় দেওয়ার ব্যাপারে জিরো টলারেন্সে রয়েছি আমরা। এ থানায় যোগদানের পর থেকেই আইনের সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইতিমধ্যে ফতুল্লাবাসীর আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছি। আর ফতুল্লায় যমুনা ও মেঘনা ডিপোর চোরাই তেল ব্যবসায়ী ও নিয়ন্ত্রকদের তালিকা আমরা প্রস্তুত করেছি। বর্তমানে চোরাই তেলের ব্যবসার মাধ্যমে সরকারী রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে যারাই অবৈধভাবে সরকারী অর্থ আতœসাতের ঘটনায় জড়িত তাদের বিরুদ্ধে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন হার্ডলাইনে রয়েছেন। অতীতের ন্যায় তেল চোরদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। মূলত ফতুল্লার আইনশৃংখলার অবনতির পিছনে যত বড়ই প্রভাবশালী ব্যাক্তিই জড়িত থাকুক না কেন তাদেরকে ছাড় দেয়া হবে না। অপরাধীদের একমাত্র স্থান হবে জেল খানা।
এছাড়া ফতুল্লা বাসীর উদ্দেশ্যে ওসি আসলাম হোসেন আরো বলেন, পুলিশের একার পক্ষে অপরাধ নিয়ন্ত্রন করা অনেকটাই কষ্টসাধ্য হয়ে উঠে। ফতুল্লাবাসী যদি প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে পুলিশকে অপরাধীদের বিষয়ে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেন তাহলে আমরা ফতুল্লাবাসীকে শান্তিময় এলাকা উপহার দিতে পারবো। এ ব্যাপারে ফতুল্লাবাসীর সার্বিক সহযোগিতায় আমরা প্রত্যাশা করি।