ধানের দাম আরও কমেছে

0
623

নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার গোবিন্দপুর গ্রামের কৃষক ফিরোজ হোসেন এ বছর আমন মৌসুমে ২৫ বিঘা জমি থেকে ৩৯০ মণ ধান পান। দাম কম হওয়ায় এক মাস আগে পরিবারের প্রয়োজনে ৩০ মণ ধান ৬৮০ টাকা মণ দরে বিক্রি করেছিলেন। ভেবেছিলেন পরে দাম বাড়লে বাকি ধান বিক্রি করবেন। তাঁর সে আশার গুড়ে বালি। কারণ, দাম আরও কমেছে।

বর্তমানে নওগাঁর বাজারগুলোতে হাইব্রিড (স্বর্ণা ও স্বর্ণা-৫) জাতের প্রতি মণ ধান বিক্রি হচ্ছে ৫৭০ থেকে ৫৮০ টাকায়। ২০-২৫ দিন আগে এই ধানের দাম ছিল ৬৮০ থেকে ৭০০ টাকা।

দাম কমেছে সরু জাতের (শম্পা কাটারি ও বিন্নাফুল) ধানেরও। এই ধান প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে ৯৫০ থেকে ১ হাজার টাকায়। ২০-২৫ দিন আগে এই জাতের ধানের দাম ছিল ১ হাজার ৫০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত।

জেলার ধান কেনাবেচার অন্যতম বড় বাজার নিয়ামতপুর উপজেলার ছাতড়া বাজার। সপ্তাহের প্রতিদিনই ধান বেচাকেনা হয় ওই বাজারে। গতকাল রোববার সকালে ছাতড়া বাজারে ৪০ মণ স্বর্ণা জাতের ধান বিক্রি করতে আসেন কৃষক ফিরোজ হোসেন। তিনি বলেন, ‘এক মাস আগে ৬৮০ টাকা দরে ৩০ মণ ধান বিক্রি করেছিলাম। এক মাস পরে একই ধান প্রতি মণ ৫৭০ টাকা দরে বিক্রি করলাম।’ আড়তদারেরা ধানই কিনতে চান না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘লাভের আশায় আগে ধান বিক্রি করলাম না। এখন তো দেখছি আরও লোকসান।’

একই উপজেলার বুধুরিয়া গ্রামের কৃষক লোকমান আলী প্রতি মণ স্বর্ণা ধান ৫৭৫ টাকা দরে ১০ মণ ধান ছাতড়া বাজারে বিক্রি করেন। তিনি বলেন, ‘২০ বিঘা জমি থেকে ৩০০ মণ ধান পেয়েছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিক্রি করেছি মাত্র ৮০ মণ। আর বাকি ধান এখনো বাড়িতে পড়ে আছে। আমার কৃষি কার্ড আছে। সরকারি গুদামে ধান দেওয়ার জন্য চেয়ারম্যানের কাছে নাম লিখিয়েছিলাম। কিন্তু লটারিতে আমার নাম ওঠেনি। ধান ওঠার শুরুতেই ধান বিক্রি করা ভালো ছিল। তখন প্রতি মণ ধান ৬৮০-৬৯০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। লাভের আশায় ধান আটকে রেখে এখন আরও লোকসান গুনতে হচ্ছে। ধানের দাম আর উঠবে কি না, আল্লাহই জানে।’

তবে নওগাঁর বিভিন্ন চালের মোকামে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ধানের দাম কমলেও চাল আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জেলা কার্যালয় থেকে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে জেলায় ১ লাখ ৬৫ হাজার হেক্টর জমিতে আমনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। তবে চাষ হয়েছে ১ লাখ ৯৭ হাজার হেক্টর জমিতে। জেলায় মোট আমন চাষির সংখ্যা প্রায় ৭৭ হাজার।

ছাতড়া বাজারের মেসার্স জোবেদা ধান আড়তের মালিক শিষ মোহাম্মদ বলেন, বর্তমানে বাজারে ধানের দাম কমছে। গত ২০-২৫ দিনের ব্যবধানে প্রতি মণ ধানের দাম ১০০ টাকা পর্যন্ত কমেছে। নতুন ধান ওঠার শুরুতে স্বর্ণা জাতের ধান ৭০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। কিন্তু এখন সেই ধান ৫৭০-৫৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। শম্পা কাটারি ধানের দাম ১ হাজার ৫০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। কিন্তু সেই ধানও দাম কমতে কমতে ৯৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

বেশ কয়েকজন ধানের আড়তদার জানান, চালকল মালিকেরা ধান কেনা কমিয়ে দেওয়ায় তাঁরা কৃষকদের কাছে ধান কিনছেন কম। কিন্তু এখন বাজারে ধানের সরবরাহ বেড়ে গেছে। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেশি হওয়ায় ধানের দাম কমে গেছে।

চালকলমালিকেরা ধান কেনা কমিয়ে দিয়েছেন কেন জানতে চাইলে জেলা চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার বলেন, ‘পাইকারি বাজারে চালের বেচা-বিক্রি একদম কমে গেছে। আমন মৌসুমে এই জেলায় মোটা জাতের ধান চাষ হয় প্রায় ৮০ শতাংশ জমিতে। কিন্তু বর্তমানে মানুষের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন হয়ে গেছে। বেশির ভাগ মধ্যবিত্ত এমনকি নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষেরাও এখন সরু জাতের চাল খাচ্ছে। এর ফলে মোকামে মোটা চাল কেনার খরিদ্দার নেই বললেই চলে। এ জন্য মিলাররা (চালকলমালিকেরা) মোটা ধান কিনতে চান না। স্বাভাবিকভাবেই চাহিদার তুলনায় বাজারগুলোতে মোটা ধানের সরবরাহ বেশি থাকায় ধানের দাম পড়তি।’ তিনি আরও বলেন, বাজারে প্রভাব ফেলার জন্য সরকার ৬ লাখ মেট্রিক টন ধান কেনার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু ধান ওঠার পর এক মাস হতে চললেও সরকারের ধান সংগ্রহ অভিযান চলছে খুবই ধীরগতিতে। পুরোদমে ধান কেনা শুরু করলে হয়তো বাজারে কিছুটা প্রভাব পড়ত।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২৬ টাকা কেজি দরে জেলায় ১৯ হাজার ৫৮০ মেট্রিক টন ধান কেনার কার্যক্রম চলছে খুবই ধীরগতিতে। গত ২০ নভেম্বর থেকে ধান কেনা শুরু হয়। এক মাস পার হলেও গত শনিবার পর্যন্ত জেলায় ধান কেনা হয়েছে মাত্র ১ হাজার ৭৮০ মেট্রিক টন। এ বছর জেলায় সরকারি গুদামে চাল সংগ্রহের বরাদ্দ এসেছে ৪১ হাজার ৬১ মেট্রিক টন। এর মেধ্য গুদামে সেদ্ধ চাল কেনা হবে ১৭ হাজার ৮০ মেট্রিক টন। আতপ চাল কেনা হবে ২ হাজার ৩৮১ মেট্রিক টন।

জেলা খাদ্যনিয়ন্ত্রক গোলাম ফারুক হোসেন পাটোয়ারী বলেন, নওগাঁর ১১টি উপজেলার মধ্যে সদর উপজেলা ছাড়া ১০টি উপজেলার ৮৭টি ইউনিয়নে লটারির মাধ্যমে কৃষক নির্বাচন করা হয়েছে। এসব এলাকায় ধান সংগ্রহ কার্যক্রম পুরোদমে চলছে। এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৭৮০ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহ হয়েছে। মিলারদের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন হলে চাল সংগ্রহ অভিযানও শিগগিরই শুরু হবে। চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু হলে বাজারে হয়তো কিছুটা প্রভাব পড়তে পারে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

4 + fourteen =