যুক্তরাষ্ট্রের অত্যাধুনিক যুদ্ধ-প্রযুক্তির কাছে হার মানতে হলো তাদের

0
697

ইরানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি কাসেম সোলেমানিকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে বহুবার। অন্তত দুই দশক ধরে শত্রুপক্ষের চোখে ধুলো দিয়েছেন তিনি। আইএস, ইসরায়েল-আরব-যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তচরেররা অসংখ্যবার হামলার চেষ্টা চালিয়েছে কুদস বাহিনী প্রধানের ওপর। কিন্তু ইরানি বাহিনীর চতুরতায় কিছুতেই সফল হচ্ছিল না তারা।

অবশেষে মুহূর্তের জন্য বাগে পাওয়া মাত্রই হত্যা করা হয় সোলেমানিকে। যুক্তরাষ্ট্রের অত্যাধুনিক যুদ্ধ-প্রযুক্তির কাছে হার মানতে হলো তাদের।

গত বৃহস্পতিবার (২ জানুয়ারি) দিনগত রাতে বাগদাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মার্কিন বাহিনীর হামলায় প্রাণ হারান ইরানের ইসলামি বিপ্লবী বাহিনী বা আইআরজিসির কুদস ফোর্সের কমান্ডার মে. জেনারেল কাসেম সোলেমানি। বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার সময় তার গাড়িতে আঘাত হানে দু’টি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন মিসাইল।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ডেইলি মেইল জানায়, প্রায় নিঃশব্দ এমকিউ-৯ রিপার ড্রোন দিয়ে হামলা চালানো হয় সোলেমানির গাড়িবহরে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন এ ড্রোনটিকে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ও ভয়ংকর বলে মনে করা হয়।

 ‘হান্টার-কিলার’ বলে পরিচিত ড্রোনটি পাঠানো হয়েছিল কাতারে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল কমান্ড হেডকোয়ার্টার থেকে। এটি একই সঙ্গে হামলা ও ঘটনার ভিডিওচিত্র পাঠাতে সক্ষম। ৬৪ মিলিয়ন ডলার (৫৪৩ কোটি টাকা প্রায়) মূল্যের হাইটেক ড্রোনটিতে চারটি লেজার গাইডেট হেলফায়ার মিসাইল ছিল। এতে অন্তত ১৭ কেজি বিস্ফোরক থাকে যা, খুব সহজেই একটি ট্যাংক ধ্বংস করতে সক্ষম। ড্রোনটি এতটাই শব্দহীনভাবে উড়তে পারে যে শিকার তার বিপদের কথা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারবে না।

দু’জন ক্রুর পরিচালনায় ড্রোনটি প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ২৩০ মাইল বেগে যমদূতের মতো এসে হাজির হয় সোলেমানিদের গাড়ির ওপর। হামলা চালায় বিশেষভাবে তৈরি হেলফায়ার আর৯এক্স ‘নিনজা’ মিসাইল দিয়ে। এ মিসাইলের শেষভাগে ছয়টি পাখা থাকে যা লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার আগমুহূর্তে বের হয়। এটি লক্ষ্যবস্তুর ওপর সুনিপুণভাবে আঘাত হানতে সাহায্য করে ও বিস্ফোরণের ব্যাপ্তি কমিয়ে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে শিকারকে।

বিমানবন্দরের সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেছে সোলেমানির গাড়িবহর চোখের নিমিষে অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হওয়ার দৃশ্য। হামলায় প্রাণ হারান ইরানের জাতীয় বীর কাসেম সোলেমানি ও ইরাকি শিয়া সশস্ত্র সংগঠন হাশদ আল-শাবির উপ-অধিনায়ক আবু মাহদি আল-মুহানদিসসহ ১০ জন। সোলেমানি ও মুহানদিস যে গাড়িতে ছিলেন তাতে আঘাত হানে অন্তত দু’টি মিসাইল। আর তাদের দেহরক্ষীদের গাড়িতে একটি মিসাইল ধ্বংসযজ্ঞ চালায়।

২ জানুয়ারি সোলেমানিকে হত্যা করা হলেও এর পরিকল্পনা ছিল বহুদিনের। দ্য টাইমসের খবর অনুসারে, গত রোববার (২৯ ডিসেম্বর) ইরাকের কাতায়েব হিজবুল্লাহ ঘাঁটি ও সিরিয়ায় হামলা হওয়ার পর সোলেমানিকে হত্যা পরিকল্পনার অনুমোদন দেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।

তবে এটি ছিল খুবই গোপন নির্দেশনা। এ বিষয়ে পশ্চিমা মিত্ররা তো বটেই, ডেমোক্রেটিক পার্টির জ্যেষ্ঠ নেতাদেরও তিনি কিছু জানাননি। কোনো আলোচনা করেননি কংগ্রেসের সদস্যদের সঙ্গেও। ‘গ্যাং অব এইট’ বলে পরিচিত কংগ্রেসের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে স্পর্শকাতর বিষয়ে আলোচনার রীতি রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। কিন্তু সোলেমানিকে হত্যার নির্দেশের ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো পরামর্শ করেননি ট্রাম্প। তিনি একক সিদ্ধান্ত নিয়ে গোপন হামলার নিয়ম ভঙ্গ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে সামরিক সদস্যদের জীবন হুমকির মুখে পড়লে সেক্ষেত্রে তাৎক্ষণিকভাবে একক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন প্রেসিডেন্ট। ধারণা করা হচ্ছে, ট্রাম্পও সোলেমানি হত্যায় এ যুক্তিই দেখাবেন।

গত দুই দশক ধরে বেশ কয়েকবার পশ্চিমা দেশ, ইসরায়েল ও আরব বেশ কয়েকবার কাসেম সোলেমানিকে হত্যার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ট্রাম্পের উত্তরসূরী বারাক ওবামা ও জর্জ ডব্লিউ বুশ সোলেমানিকে হত্যা পরিকল্পনার বিরোধিতা করেন। তারা বুঝতে পেরেছিলেন, এর ফলাফল ভয়াবহ হতে পারে।

গত বছর ইসরায়েল ও আরবের গুপ্তচরদের সোলেমানি হত্যাচেষ্টার একটি পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দেওয়ার কথা জানিয়েছিল তেহরান। গুপ্তচরেরা কেরমান শহরে সোলেমানির বাবার তৈরি একটি মসজিদের পাশে জমি কিনে স্থাপনা তৈরি করতে চেয়েছিল। সেখানে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে বিস্ফোরক বসিয়ে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সময় বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ইরানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তিকে হত্যার পরিকল্পনা ছিল তাদের।

গত বৃহস্পতিবার সিরিয়া থেকে একটি ফ্লাইটে বাগদাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পৌঁছান ইরানের সর্বোচ্চ সামরিক কর্মকর্তা কাসেম সোলেমানি। দু’টি টয়োটা এসইউভি নিয়ে প্লেনের কাছে তাকে অভ্যর্থনা জানান ইরাকি কর্মকর্তা আবু মাহদি আল-মুহান্দিস।

সোলেমানি, মুহান্দিস ও তাদের সর্বজ্যেষ্ঠ সঙ্গী কর্মকর্তারা একটি গাড়িতে এবং দেহরক্ষীরা পরের গাড়িতে ছিলেন। বিমানবন্দরের কার্গো এরিয়া পার হয়ে বাইরে যাওয়ার সময় গাড়ি দু’টিতে একইসঙ্গে একাধিক মিসাইল আঘাত হানে। এতে মুহূর্তেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় সেগুলো, ক্ষত-বিক্ষত হয়ে প্রাণ হারান সব আরোহী। বিস্ফোরণে সোলেমানির শরীরের এমনই অবস্থা হয়েছিল যে, তার মরদেহ চিনতে হযেছে হাতের একটি আংটি দেখে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

4 × one =