ঋণখেলাপিদের দেশে ফেরাতে চায় দুদক

0
710

ঋণের নামে ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বের করে পাচারের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যাচ্ছে দুদক। বিদেশে পলাতক পাচারকারীদের ধরে এনে বিচারের মুখোমুখি করতে নেয়া হচ্ছে বিভিন্ন পদক্ষেপ। এর অংশ হিসেবে ইন্টারপোল ও এফবিআইয়ের সহায়তায় এদের দেশে আনার চেষ্টা চালাচ্ছে সংস্থাটি। প্রথম অবস্থায় করা ২০০ জনের তালিকার শীর্ষে আছেন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রশান্ত কুমার হালদার, বেসিক ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী ফখরুল ইসলাম, এনন টেক্সের কর্ণধার ইউনুছ বাদল, শেয়ার কেলেঙ্কারির অন্যতম হোতা লুৎফর রহমান বাদল, যুবলীগ নেতা কাজী আনিসুর রহমান, জজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার আবদুল আজিজ, ঢাকা ট্রেডিংয়ের টিপু সুলতান, স্বাস্থ্য অধিদফতরের আবজাল হোসেন, এমএম ভেজিটেবলসের চেয়ারম্যান জহির উদ্দিন, বিসমিল্লাহ গ্রুপের গাজী সোলেমান ও তার স্ত্রী নওরীন হাসিব।

এ ছাড়া ঋণের নামে ব্যাংকের টাকা তুলে বিদেশে পাচারকারীদের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরির কাজও শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে। এই তালিকায় দেশে-বিদেশে অবস্থানরত অনেক রাঘববোয়ালের নাম চলে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে যাদের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা রয়েছে তারাই থাকছেন প্রথম ধাপের তালিকায়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, যে বা যারা অবৈধভাবে ব্যাংকের বা সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করে তা পাচার করে বিদেশে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন, তাদের প্রত্যেককেই অপরাধের জন্য বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। ইন্টারপোলসহ আন্তর্জাতিক সব আইনি টুলস-টেকনিক প্রয়োগ করে অপরাধীদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করা হবে।

দেশের সম্পদ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা অব্যাহত রাখা হবে। এখানে কাউকে ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, কতিপয় দুর্বৃত্তের কাছে দেশের মানুষ জিম্মি হতে পারে না। দেশের অর্থনীতি ধ্বংস হতে পারে না। যারা ঋণের নামে ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে পাচার করেছে তাদের ছাড় দেয়ার কোনো সুযোগ নেই।

সূত্র জানায়, দুদকের এ সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ তালিকাটি সরকারের কাছেও হস্তান্তর করবে। তালিকা প্রণয়নের সময় জাতীয় সংসদে যে ৩০০ ঋণখেলাপির নাম প্রকাশ করা হয়েছে তাদের বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হবে বলে জানা গেছে।

দুদকের তিনটি বিশেষ শাখা এ নিয়ে কাজ করছে। পরিচালক মীর জয়নুল আবেদীন শিবলীর নেতৃত্বে গঠিত গোয়েন্দা ইউনিট, পরিচালক বেনজির আহমেদের নেতৃত্বে ব্যাংকিং খাত কমিটি ও পরিচালক গোলাম শাহরিয়ার চৌধুরীর নেতৃত্বে মানি লন্ডারিং কমিটির সদস্যরা নানা মাধ্যম থেকে তথ্য সংগ্রহ করছে। কমিটির পক্ষ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির কাছে চিঠি দিয়ে ঋণখেলাপিদের তালিকা চাওয়া হবে।

সব কটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের এমডির কাছে চিঠি দিয়ে কার নামে কি পরিমাণ ঋণ অনাদায়ী ও খেলাপি আছে এবং ওই ঋণের টাকা কোথায় বিনিয়োগ হয়েছে- সেই তথ্য চাওয়া হবে। ঋণের কি পরিমাণ অর্থ দেশের বাইরে চলে গেছে, কারা এসব অপরাধে জড়িত সেই তালিকাটি গুরুত্বসহকারে করতে চায় দুদক।

এরপর করণীয় ঠিক করা হবে। দুদক তালিকাটি সরকারকে দেয়ার পাশাপাশি গণমাধ্যম সূত্রে দেশবাসীও জানতে পারবে ঋণের টাকা আত্মসাৎ ও পাচারকারীদের বিষয়ে।

এদিকে দুদকের প্রথম ২০০ জনের তালিকার বেশিরভাগই পাচার করা টাকায় বিদেশে ব্যবসা করছেন বলে জানা গেছে। ওইসব দেশে তারা বিলাসী জীবনযাপন করছেন।

যেসব ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তারা পাচার করেছেন ওই ব্যাংকগুলোর ঋণের টাকা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। এ বাস্তবতায় দুদক প্রথম ধাপে বিদেশে পলাতক পাচারকারীদের একটা বড় গ্রুপকে দেশে ফিরিয়ে এনে শাস্তি কার্যকর করতে চায়।

সূত্র জানায়, অবৈধভাবে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের টাকা হাতিয়ে নিয়ে কিংবা সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করে যেসব প্রভাবশালী ব্যক্তি লন্ডন, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাচার করে, সেসব দেশে অবস্থান করছেন তাদের নাম ইন্টারপোলের কাছে পাঠাবে দুদক। একই সঙ্গে এদের বিষয়ে এফবিআইয়েরও সহায়তা নেয়া হবে। এ সংক্রান্ত একটি চুক্তিও আছে দুদক-এফবিআইয়ের মধ্যে।

তদন্ত টিমের এক কর্মকর্তা জানান, এ মুহূর্তে দুদকের হাতে যে ২০০ জনের তালিকা রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে অন্তত ২৫ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে।

এর মধ্যে বিসমিল্লাহ গ্রুপের কর্ণধার খাজা সোলায়মান, তার স্ত্রী নওরীন হাবিব ও পরিচালকরা জনতা ব্যাংক থেকে ঋণের নামে ১২০০ কোটি টাকা বের করে পুরোটাই বিদেশে পাচার করে দিয়েছেন।

তারা সবাই এখন কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায়। বেসিক ব্যাংকের সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের মামলার আসামি ব্যাংকটির সাবেক এমডি কাজী ফখরুল ইসলাম কানাডায় আত্মগোপনে আছেন।

যুবলীগের সাবেক দফতর সম্পাদক কাজী আসিনুর রহমান অন্তত ৫০ কোটি টাকা পাচার করেছেন। তিনি আছেন মধ্যপ্রাচ্যে। শেয়ার কেলঙ্কারির আরেক হোতা লুৎফর রহমান বাদলের বিরুদ্ধে হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে।

তার বিরুদ্ধে মামলাও রয়েছে দুদকের। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাবেক প্রধান প্রশান্ত কুমার হালদার পাচার করেছেন সাড়ে তিন হাজার থেকে চার হাজার কোটি টাকা।

তিনি কোন দেশে পালিয়ে আছেন তা শনাক্তের চেষ্টা চলছে। জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার আবদুল আজিজ জনতা ব্যাংক থেকে ক্রিসেন্ট গ্রুপের একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের নামে ৯৯৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পাচার করে দেন।

তিনিও দেশে ছেড়েছেন। মোস্তফা গ্রুপের কর্ণধার তার সহযোগী প্রতিষ্ঠান এমএম ভেজিটেবলসের নামে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক থেকে ১৭৪৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পাচার করে দেন।

তিনি কানাডায় আছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। ঢাকা ট্রেডিংয়ের বর্ণধার টিপু সুলতান ৩৫০ কোটি টাকা ঋণ নেন বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক থেকে। ঋণের ওই পুরো অর্থই তিনি দেশের বাইরে পাচার করে দেন।

এনন ট্যাক্সের কর্ণধার ইউনুছ বাদল জালজালিয়াতির মাধ্যমে জনতা ব্যাংক থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেন। তিনি শিল্প স্থাপনের নামে ঋণ নিয়ে পাচার করেন বলে দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা যায়।

তিনিও গোপনে দেশ ছেড়েছেন। এবি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান এম ওয়াহিদুল হক ও সাবেক দুই ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে ১৬৫ কোটি টাকা পাচারের সুনির্দিষ্ট তথ্য রয়েছে দুদকের হাতে।

বেসিক ব্যাংকের আবদুল হাই বাচ্চু ব্যাংক থেকে ঋণ দেয়ার নামে চার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগ রয়েছে। বেসিক ব্যাংকের টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের দায়ের করা ৬১টি মামলায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় বাচ্চুকে।

তিনি এর দায়ও স্বীকার করেন বলে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান। তবে এরপর আর কোনো অগ্রগতি নেই। তবে দুদক চাইছে বেসিক ব্যাংকের টাকা যেসব দেশে পাচার হয়েছে, যারা পাচারে জড়িত, তাদের কাউকে দিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির র্ভিত্তিতে বাচ্চুকে চার্জশিটভুক্ত আসামি করতে।

সে কাজটির জন্য কোন কোন দেশে টাকা পাচার হয়েছে তা নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি আসামিরা কে কোন দেশে আছেন তা জেনে ইন্টারপোলের সাহায্যে দেশে ফিরিয়ে আনতে চায় দুদক।

বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে ফারমার্স ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী চেয়ারম্যান বাবুল চিশতির বিরুদ্ধে শত শত কোটি টাকা দেশের বাইরে পাচারের তথ্য রয়েছে সংশ্লিষ্টদের কাছে। এসব বিষয়ে তদন্ত শেষে প্রতিবেদন দাখিল করবেন দুদকের কর্মকর্তারা।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

thirteen − 9 =