যেভাবে মোর্শেদ মুরাদের খেলাপি ঋণের শুরু

0
955

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ৯৯০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে জাতীয় পার্টি নেতা-নেত্রী দম্পতি মোর্শেদ মুরাদ ইব্রাহিম ও সাবেক এমপি বেগম মাহজাবিন বর্তমানে সপরিবারে কানাডার অন্টারিও প্রদেশের অসোয়া শহরে বসবাস করছেন। অনেকটা নিভৃতেই থাকেন তারা। বাঙালি কমিউনিটিতে তেমন একটা যাতায়াত নেই তাদের।

জানা গেছে, দুই বছর আগে বেসিক ব্যাংকের ২৯৬ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে জাতীয় পার্টি নেতা-নেত্রী দম্পতি মোর্শেদ মুরাদ ইব্রাহিম ও সাবেক এমপি বেগম মাহজাবিন মোর্শেদের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মামলা হওয়ার পর আত্মসাৎ করা অর্থ কিস্তিতে পরিশোধের শর্তে তাদের জামিন দিয়েছিল আদালত। কিন্তু শর্তানুযায়ী কিস্তি পরিশোধ না করা ও আদালতে হাজির না হওয়ায় গত বছরের ১৯ এপ্রিল তাদের জামিন বাতিল করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে চট্টগ্রামের আদালত। শুধু বেসিক ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎই নয়, মোর্শেদ মুরাদ নামে-বেনামে তার পারিবারিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ৯৯০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পরিশোধ করেননি বলে তথ্য মিলেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মোর্শেদ পরিবারের কাছে শুধু রাষ্ট্রমালিকানাধীন বেসিক ব্যাংকেরই খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬৩৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১০২ কোটি টাকা ঋণের জিম্মাদার মোর্শেদ মুরাদ ইব্রাহিম। আর বর্তমানের পদ্মা ব্যাংকের (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক) ৭৬ কোটি টাকা, রূপালী ব্যাংকের ১১৩ কোটি টাকাসহ অন্যান্যা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এই পরিবারের খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও ৩৬০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে এই পরিবারের ৯৯০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের তথ্য মিলেছে। তবে দুদক ও ব্যাংকসংশ্লিষ্টরা বলছেন, তাদের প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেশি।

জাপার কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মোর্শেদ মুরাদ ইব্রাহিম ও তার স্ত্রী বেগম মাহজাবিন বর্তমানে জাপা চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা। গত ২২ জানুয়ারি তাদের নিয়োগ দেন পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। মোর্শেদ চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক সভাপতি। আর তার স্ত্রী মাহজাবিন মোর্শেদ জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনের (মহিলা আসন-৪৫) সাবেক সদস্য। মোর্শেদ মুরাদ সাবেক ফারমার্স ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালক ছিলেন।

অনুসন্ধানে মোর্শেদ পরিবারের বিভিন্ন ব্যবস্যা প্রতিষ্ঠানের নামে ৯৯০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে বেসিক ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায় ক্রিস্টাল স্টিল অ্যান্ড শিপ ব্রেকিং লিমিটেডের নামে ১৩৪ কোটি ৯৩ লাখ ৬৬ হাজার টাকা, আইজি নেভিগেশনের নামে  ১৪১ কোটি ৫ লাখ টাকা, ক্রিস্টাল ফিশারিজের নামে ১৮ কোটি টাকা এবং একই ব্যাংকের ঢাকার দিলকুশা শাখায় বে নেভিগেশনের নামে ১৩৭ কোটি টাকা। এ ছাড়া রয়েছে বেসিক ব্যাংকের চট্টগ্রামের জুবিলী রোড শাখায় মোর্শেদের ভাই রাশেদের মালিকানাধীন এমআরএফ ট্রেডিংয়ের নামে ৭০ কোটি টাকা, জিম্মাদার হিসেবে শীতল শিপ ব্রেকার্সের নামে ৭৮ কোটি টাকা ও শাহেদ শিপ ব্রেকার্সের নামে ৪৬ কোটি ১৪ লাখ টাকা (এই ঋণের সুপারিশকারী ও জিম্মাদার মোর্শেদ মুরাদ) এবং ফারমার্স ব্যাংকের চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ শাখায় ভাইয়ের স্ত্রী কানিজ ফাতেমার নামে ৩০ কোটি টাকা, চিটাগাং ফিশারিজের নামে ২৯ কোটি টাকা ও গরিবে নেওয়াজ ফিশিঙের নামে ১৭ কোটি টাকা। এর বাইরে রূপালী ব্যাংকের ঢাকার মতিঝিল শাখায় ক্রিস্টাল গ্রুপের নামে ১১৩ কোটি টাকা, দ্য প্রিমিয়ার ব্যাংকের বনানী শাখায় ৭৫ কোটি টাকা, আল আরাফাহ ব্যাংকের চট্টগ্রাম নিজাম রোড শাখায় ১৩ কোটি টাকা,  ট্রাস্ট ব্যাংকের ঢাকার দিলকুশা শাখায় ৫০ কোটি টাকা, প্রাইম ব্যাংকে মোর্শেদ মুরাদের ফারুক অ্যান্ড সন্সের নামে ২২ কোটি টাকা, সিটি ব্যাংকের গুলশান শাখায় ৩ কোটি টাকা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিডি ফিন্যান্স থেকে নেওয়া ১৫ কোটি টাকা এবং মোর্শেদ মুরাদ পরিবারের মালিকানায় থাকা প্রোটেকটিভ ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির নামে ৩ কোটি টাকা রয়েছে।

বেসিক ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় ২০১৮ সালের ১০ জানুয়ারি চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানায় মোর্শেদ-মাহজাবিন দম্পতির বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেন দুদকের সহকারী পরিচালক সিরাজুল হক। এর মধ্যে একটি মামলায় মোর্শেদ মুরাদের মালিকানাধীন ক্রিস্টাল স্টিল অ্যান্ড শিপ ব্রেকিং লিমিটেডের বিরুদ্ধে ১৩৪ কোটি ৯৩ লাখ ৬৬ হাজার ১৮৫ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়। অপর মামলায় বেসিক ব্যাংকের চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ শাখা থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করে ১৪১ কোটি ৫ লাখ ৪৫ হাজার ১০৫ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয় মাহজাবিন মোর্শেদের বিরুদ্ধে।

মামলা দুটির তদন্তের অগ্রগতির ব্যাপারে জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা সিরাজুল হক গত বৃহস্পতিবার এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘মামলা দুটির তদন্ত প্রায় শেষ। কমিশন অনুমোদন দিলে অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হবে।’

অন্যদিকে চট্টগ্রাম আদালতে দায়িত্বরত দুদকের আদালত পরিদর্শক এমরান হোসেন বলেন, ‘মামলা হওয়ার পর মোর্শেদ ও মাহজাবিন অন্তর্বর্তীকালীন জামিনে ছিলেন। আত্মসাৎ করা টাকা কিস্তিতে পরিশোধের শর্তে আদালত তাদের জামিন দিয়েছিল। কিন্তু তারা কিস্তি পরিশোধ না করায় ও আদালতে হাজির না হওয়ায় গত বছরের ১৯ এপ্রিল চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ দুজনের জামিন বাতিল করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। তারা আত্মগোপনে থাকায় পরোয়ানা কার্যকর করা যায়নি। সংশ্লিষ্ট থানায় তাদের বিরুদ্ধে পরোয়ানা পাঠানো হয়েছে।’

আদালতের পরোয়ানা মাথায় নিয়ে বিদেশে আত্মগোপনে থাকার বিষয়ে জানতে চাইল মাহজাবিন মোর্শেদ ফোনে (হোয়াটস অ্যাপ) গত বৃহস্পতিবার এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমি এখন কানাডায় নয়, ভারতে আছি। কাজ শেষে দেশে ফিরব।’ দুদকের মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর জামিন নিয়েছেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কোনো কথা বলব না, যা জানার মোর্শেদ মুরাদের কাছ থেকে জানুন।’ পরে মোর্শেদ মুরাদের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও তা বন্ধ থাকায় তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

এই প্রতিবেদক চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে মোর্শেদ মুরাদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ক্রিস্টাল স্টিল অ্যান্ড শিপ ব্রেকার্সে গেলে সেখানে কর্তব্যরত কর্মচারীরা জানান, বহু দিন সেখানে যান না মোর্শেদ মুরাদ। তিনি কোথায় আছেন, সে ব্যাপারেও কোনো ধারণা নেই তাদের। চট্টগ্রামের ২৬১ মাঝিরঘাট এলাকায় ক্রিস্টাল গ্রুপের কার্যালয়ে গেলে সেখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নাম-পরিচয় প্রকাশ করে মোর্শেদ মুরাদের অবস্থান সম্পর্কে কোনো তথ্য দিতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে সেখানকার এক কর্মকর্তা বলেন, মোর্শেদ-মাহজাবিন দম্পতি বর্তমানে সপরিবারে কানাডায় থাকেন।

দুদক কর্মকর্তারা জানান, বেসিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ১৩৭ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মোর্শেদ মুরাদের ভাই ফয়সাল মুরাদ ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালের ১৭ জানুয়ারি মতিঝিল থানায় একটি মামলা করে দুদক। মামলার বাদী দুদকের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ সিরাজুল হক। ওই মামলার অভিযোগে বলা হয়, বে নেভিগেশনের এমডি ফয়সাল মুরাদ ইব্রাহিমকে পর্যাপ্ত জামানত না রেখে এবং ঋণ মঞ্জুরের আবেদনে ব্যাংকের দিলকুশা শাখার নেতিবাচক মতামত থাকা সত্ত্বেও ঋণ মঞ্জুর করা হয়। এ মামলাটিরও চার্জশিট অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।

বেসিক ব্যাংকের চট্টগ্রামের জুবিলী রোড শাখা থেকে এমআরএফ ট্রেড হাউজের নামে ঋণ নিয়েছেন মোর্শেদ মুরাদের আরেক ভাই রাশেদ মুরাদ ইব্রাহিম। বতর্মানে প্রতিষ্ঠানটির কাছে ওই শাখার পাওনার পরিমাণ প্রায় ৭০ কোটি টাকা। এ ব্যাপারে দুদকের অনুসন্ধান অব্যাহত রয়েছে।

যেভাবে মোর্শেদ মুরাদের খেলাপি ঋণের শুরু : চট্টগ্রামের সুপরিচিত ব্যবসায়ী সেকান্দর হোসেন মিয়ার সন্তান মোর্শেদ মুরাদ ইব্রাহিম। তাদের পৈতৃক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল ইব্রাহিম কটন মিল। বড় অঙ্কের দায়দেনাসহ বাবার রেখে যাওয়া ইব্রাহিম কটন মিল প্রায় ১১ বছর আগে বিক্রি করে দেন মোর্শেদ। এরপর তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ক্রিস্টাল গ্রুপ নামে নতুন প্রতিষ্ঠান। নিজে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে থেকে মা গুলশান আরা বেগমকে করেন গ্রুপটির চেয়ারম্যান। আর ভাই রাশেদ মুরাদ ইব্রাহিমকে উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, আরেক ভাই ফয়সাল মুরাদ ইব্রাহিমকে অর্থ-পরিকল্পনা পরিচালক এবং স্ত্রী মাহজাবিন ও ভাইয়ের স্ত্রী কানিজ ফাতেমা রাশেদসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের করা হয় গ্রুপটির পরিচালক। প্রোটেকটিভ ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স নামে একটি বীমা প্রতিষ্ঠানও রয়েছে মোর্শেদ মুরাদ পরিবারের মালিকানায়।

ক্রিস্টাল গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্রিস্টাল স্টিল অ্যান্ড শিপ ব্রেকার্স লিমিটেড, ক্রিস্টাল ল্যান্ড মার্ক লিমিটেড, ক্রিস্টাল ফিশারিজ লিমিটেড, ইব্রাহিম ফার্মস লিমিটেড, ম্যাক্স ট্রেড লিমিটেড, এমআরএফ ফিশারিজ লিমিটেড, ফারুক অ্যান্ড সন্স লিমিটেড, হামিদা দোজা লিমিটেড, আইজি নেভিগেশন, বে নেভিগেশনসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। ব্যবসায়িক মন্দা ও ঋণখেলাপির কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগই দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ।

সাবেক ফারমার্স ব্যাংকের ১ কোটি শেয়ার বা ২.৪৯ শতাংশ মালিকানা ছিল মোর্শেদ মুরাদের হাতে। প্রতিটি শেয়ারের অভিহিত মূল্য ১০ টাকা হিসাবে ফারমার্স ব্যাংকে মোর্শেদ মুরাদের শেয়ার ছিল ১০ কোটি টাকার। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ব্যাংকটির অন্যতম পরিচালক ছিলেন তিনি। ওই সময় ব্যাংকটি থেকে নামে-বেনামে ঋণ সুবিধাও নিয়েছে তার পরিবার।

২০১৩ সালে অনুমোদন পাওয়া প্রোটেকটিভ ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্সের ৬০ শতাংশ শেয়ারের মালিকানায় রয়েছেন মোর্শেদ মুরাদ পরিবারের সদস্যরা। এর চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন তার ভাই রাশেদ মুরাদ। মোর্শেদ মুরাদ পরিচালক ছিলেন ইউনিয়ন ইনস্যুরেন্সেরও। এর আগে আইএফআইসি ব্যাংকের পরিচালকও হয়েছিলেন তিনি।

ক্রিস্টাল গ্রুপের কাছে প্রায় ১১৩ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে রূপালী ব্যাংকের। ওই ঋণের পুরোটাই খেলাপি হয়ে যাওয়ায় সম্প্রতি ঋণের জামানত বিক্রির জন্য নিলাম বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে ব্যাংকটি। রূপালী ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, খেলাপি হয়ে যাওয়া ঋণ আদায়ের জন্য একাধিকবার মোর্শেদ মুরাদের সঙ্গে বৈঠক হয়। কিন্তু ঋণটি পুনঃতফসিল করা সম্ভব না হওয়ায় নিলাম বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। এ পরিস্থিতিতে জামানতের সম্পদ বিক্রি করে টাকা আদায় সম্ভব না হলে মামলা করা হবে বলে জানান রূপালী ব্যাংকের ওই কর্মকর্তা।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

seventeen − three =