চিন্তাধারা ও আচার-আচরণেও উগ্রতার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে

0
465

শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর অনেক দেশেই ব্যাপকসংখ্যক মানুষের মধ্যে অনেক বিষয়ে অজ্ঞতা যেমন বাড়ছে, চিন্তাধারা ও আচার-আচরণেও উগ্রতার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। এর ফলে সমাজে প্রয়োজনীয় উদারতা এবং সততার অভাবও ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমাদের দেশে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আগের চেয়ে এখন অনেক বাড়ছে।

মানুষ রুটিরুজির অবস্থানের দিক থেকে আগের চেয়ে তুলনামূলকভাবে ভালো আছে। খাদ্যের অভাব নিয়ে এখন খুব কম মানুষই দুশ্চিন্তায় থাকে। অথচ চার-পাঁচ দশক আগে বিরাটসংখ্যক মানুষের ‘নুন আনতে পানতা ফুরায়’ কথাটি বেশ ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। মানুষ পরিবারের প্রয়োজনীয় খাদ্য ও কাপড়চোপড় কেনার অর্থ আয় করতে বেশ হিমশিম খেত। অনেকের জীবনে অভাবই তখন স্বাভাবিক নিয়ম হিসেবে দেখা যেত। কিন্তু গত তিন-চার দশকে আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দ্রুত পরিবর্তিত হতে থাকে। গত এক দশকে সেটি পৃথিবীকে অনেকটাই যেন তাক লাগিয়ে দিয়েছে, আমরা মধ্যম আয়ের দেশে প্রবেশ করেছি বলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও অর্জন করেছি।

আমাদের দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ নানা ধরনের সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও অনেক গুণ বেড়েছে। দেশে পরিসংখ্যান নিলে দেখা যাবে প্রায় পাঁচ কোটি শিক্ষার্থী শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন স্তরে রয়েছে। এসব পরিবর্তন ও উন্নয়নের বিষয়টি আমাদের সবারই জানা। কিন্তু যে বিষয়টি সচেতন মহলকে দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে, তা হচ্ছে সমাজের অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে মানুষের চিন্তা ও চেতনাবোধের সাযুজ্য উন্নতি খুব একটা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। সমাজে যে ধরনের জ্ঞানগত দক্ষ জনশক্তি দরকার রয়েছে তার অভাব প্রকটতর হচ্ছে। আমাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ধরে রাখার জন্য বিদেশ থেকে পাঁচ লাখেরও বেশি উচ্চতর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ কর্মকর্তা নিয়ে আসতে হয়েছে। অথচ দেশে ২৫ লাখেরও বেশি শিক্ষিত তরুণ-তরুণী বেকার রয়েছে বলে তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে। বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় লাখ লাখ উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণী অংশগ্রহণ করলেও কাম্যসংখ্যক উত্তীর্ণ প্রার্থী পাওয়া যাচ্ছে না। গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমে প্রতিনিয়ত বিপুলসংখ্যক তরুণকে নানা ধরনের বিষয়ে মতামত প্রদান নিয়ে ব্যস্ত থাকতে দেখা যাচ্ছে। খুব সুস্থ চিন্তাভাবনার সঙ্গে জড়িত আছে এমন মতামত দানকারীর সংখ্যা হাতে গোনা বললে খুব বেশি দোষের কিছু হবে বলে মনে হয় না। গ্রামগঞ্জ, শহরসহ সর্বত্র একদিকে মানুষের কর্মব্যস্ততা ও ছোটাছুটি দেখা যাচ্ছে, অন্যদিকে বিপুলসংখ্যক তরুণ-তরুণী নানা হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছে, প্রত্যাশিত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করতে পেরে বলা চলে নিজেদের খুব একটা দেশ ও জাতির সম্পদে পরিণত করার স্বপ্ন দেখছে না। এমন একটি বাস্তবতার মুখোমুখি অনেকেই সব প্রশ্নের উত্তর যে খুব একটা বুঝছে, জানছে কিংবা পথের সন্ধান করতে পারছে—তেমনটি সামান্যই দেখা যাচ্ছে। তবে তরুণ-তরুণীদের একটি অপেক্ষাকৃত ছোট অংশ নিজেদের শিক্ষাদীক্ষা, প্রশিক্ষণ ও যোগ্যতায় গড়ে তোলার কাজে নিরন্তর কাজ করে চলছে। এই সংখ্যাটি খুব বেশি না হলেও একটি অংশ দেশে বিভিন্ন জায়গায় নিজেদের অবস্থান তৈরি করছে, অন্য আরেকটি অংশ দেশের বাইরে সুযোগ সৃষ্টি করার মাধ্যমে চলে যাচ্ছে। দেশে যে বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী রয়েছে তাদের মধ্যে বর্তমান আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও বিশ্ববাস্তবতার পরিবর্তনকে  বোঝার ক্ষেত্রে এক বড় ধরনের ক্রান্তিকাল অতিক্রম করতে দেখা যাচ্ছে। এসব ক্রান্তিকালীন জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজে পাওয়ার সুযোগ খুবই সীমিত হয়ে পড়েছে।

দেশে এক ধরনের আর্থিক সচ্ছলতার যে পরিবেশ গড়ে উঠছে, তাতে সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনীতি, রাজনীতি ও বিশ্বজ্ঞানের প্রয়োজনীয় জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা যেন বেড়েই চলছে। এমন পরিস্থিতিতে সমাজে মানসম্মত যে জ্ঞানচর্চার প্রয়োজন ছিল সেটি আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক সংগঠন, গণমাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়া প্রদান করতে পারছে না। অধিকন্তু উগ্রতা, হঠকারিতা, বিভ্রান্তি, বিকৃতি এবং আবেগ-অনুভূতির সহজ অপব্যবহারের শিকার হচ্ছে বেশির ভাগ তরুণ-তরুণীই। তাদের মধ্যে বর্তমান একুশ শতকের বিশের দশকে যে ধরনের জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার প্রয়োজনীয়তা ছিল, তা থেকে তাদের বড় অংশই পিছিয়ে পড়েছে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় এসব প্রয়োজনীয় সামাজিক ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞানগত শিক্ষার ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। অন্যদিকে বিরাট অংশ উঠতি তরুণ-তরুণী সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা ধরনের বিভ্রান্তিকর তথ্য ও খবরাখবরে অনেক বেশি আস্থাহীনতায় বেড়ে উঠছে। বেশির ভাগ তরুণী জীবনে বেড়ে ওঠার এই সময়ে যেসব ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণে নিজেদের জিজ্ঞাসা ও প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়ার কথা ছিল, সেগুলো খুঁজে বের করে নিতে পারছে না। অবাধ তথ্যপ্রবাহের এই পরিবেশে তরুণ-তরুণীদের বড় অংশই দেশ, জাতি, আন্তর্জাতিক বাস্তবতা, জীবনবোধ, মানবিক মূল্যবোধসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে যথেষ্ট বিভ্রান্তিতে পড়েছে। এই বয়সের তরুণদের মধ্যে যুক্তিবাদ, বাস্তবজ্ঞান এবং চিন্তাধারা গঠনে যেসব মৌলিক শিক্ষাগত ধারণা থাকা আবশ্যকীয়, তা অনেকটাই যেন তাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে। ফলে সমাজে বাড়ছে নানা বিষয়ে অজ্ঞানতা, অন্ধবিশ্বাস, যা তরুণদের মধ্যে উগ্রতা, হঠকারিতা এবং ভুলপথে পরিচালিত হওয়ার ব্যাপক অবস্থান তৈরি করেছে। অথচ এর বিপরীতে এই তরুণদের মধ্যে দেশ, জাতি, বিশ্ববাস্তবতা, বিজ্ঞানচিন্তা ইত্যাদি নিয়ে যে যুক্তিবাদী চিন্তা, বিজ্ঞান মানসিকতা গড়ে ওঠা আবশ্যকীয় ছিল, সেটি তুলনামূলকভাবে কমে যাচ্ছে। সেটি এমনকি আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রদানে প্রতিষ্ঠিত নানা ধরনের পাবলিক, বেসরকারি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রকট আকার ধারণ করছে। এসব প্রতিষ্ঠানে এখন একুশ শতকের বিশ দশক উপযোগী সমাজচিন্তা, রাষ্ট্রচিন্তা, মানবচিন্তা এবং জ্ঞান ও প্রকৌশলচিন্তা ভীষণভাবে অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের আগে নিজেদের তৈরি করার মতো সামাজিক, মানবিক ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞানগত ধারণায় তৈরি করার বোধের প্রয়োজনীয়তা অপেক্ষাকৃতভাবে কমে গেছে। সেই জায়গায় অন্ধবিশ্বাস, পশ্চাৎপদতা, কুসংস্কার ও অবৈজ্ঞানিক বোধ ও বিশ্বাসে জড়িয়ে পড়া তরুণের সংখ্যা অনেক বেশি বেড়ে যাচ্ছে। সেখান থেকে অনেক বেশি উগ্র চিন্তাভাবনা ও বিশ্বাসে বেড়ে ওঠা তরুণের সংখ্যা বেড়ে চলছে। তাদের চিন্তার আইডল হিসেবে জ্ঞানবিজ্ঞান, শিল্পসাহিত্য, সংস্কৃতি এবং গবেষণার সাধকরা স্থান করে নিতে পারেননি। সেই জায়গায় তাঁদের সম্মুখে দেশ, জাতি এবং বিশ্ব পরিসরে উদারবাদী ভাবাদর্শ দর্শন, রাজনীতি চিন্তা, মানব গঠনের করণীয় চিন্তা খুব বেশি পরিলক্ষিত  হচ্ছে না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার অভ্যন্তরে জ্ঞানতাত্ত্বিক সীমাবদ্ধতা স্থান করে নিয়েছে, ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যতাবোধের নামে ভোগবাদিতা প্রাধান্য পেয়েছে, বিজ্ঞান সমাজ ও মানুষের অবস্থানের জ্ঞানগত ধারণা অর্জনে অদক্ষতা, অযোগ্যতা ও মানসিকতার অভাব প্রকটতর হয়েছে।

আমরা উচ্চশিক্ষাকে অনেকটাই গবেষণা থেকে বিযুক্ত করে ফেলেছি। ফলে আমাদের মধ্যে সৃষ্টিশীলতা, সৃজনশীলতা, বিজ্ঞানচিন্তা, উদ্ভাবনীচিন্তা ও সমাজচিন্তা অনেকটাই হারিয়ে যেতে বসেছে। এর ফলে বেশির ভাগ তরুণ-তরুণীর মধ্যেই চারপাশে কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, অবৈজ্ঞানিক জ্ঞান ধারণা ইত্যাদি স্থান করে নিচ্ছে। আমরা বিশ্ব জ্ঞানচর্চা থেকে নিজেদের অনেক বেশি সরিয়ে নিয়েছি। এর ফলে সমাজে অজ্ঞতা যেমন বাড়ছে, একইভাবে রক্ষণশীলতা ও উগ্রতা দ্রুতগতিতে বেড়েই চলেছে। অথচ সমাজে সততার অভাব সর্বত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে। মানুষের মধ্যে ঘুষ, দুর্নীতি, অনিয়ম, মিথ্যাচার, সুবিধাবাধিতা, দ্বিচারিতা ইত্যাদি নিয়ে যেসব বৈশিষ্ট্য বেড়ে উঠছে, তা আধুনিক মানুষ হওয়ার ক্ষেত্রে আমরা বড় ধরনের পশ্চাৎপদতার দিকে ধাবিত হচ্ছি। এসব বৈশিষ্ট্য নিয়ে একটি সমাজ অর্থনৈতিকভাবে যতই অগ্রসর হওয়ার দাবি করুক না কেন, তা কোনো অবস্থায়ই সমাজে শান্তি, শৃঙ্খলা, মানবিক মূল্যবোধ, উন্নত জীবনব্যবস্থা, গণতন্ত্র, সুশাসন, ধর্মচারণ ইত্যাদিকে নিশ্চয়তা দিতে পারবে না। কেননা একজন মানুষ তখনই সমাজের জন্য জনসম্পদে পরিণত হন, যখন তিনি সমাজকে নিজের সৃষ্টিশীলতা দিয়ে বিকশিত করতে অবদান রাখতে পারেন। সে রকম অবদান রাখার জন্য প্রত্যেক মানুষকে শিক্ষাসচেতন, সমাজসচেতন, জীবনদক্ষ, রাষ্ট্রসচেতন, সৎ ও নিষ্ঠাবানসহ নানা গুণে গুণান্বিত মানুষ হয়ে উঠতে হয়। এসব গুণের সমন্বয় সাধন শিক্ষা, সংস্কৃতি, মানবিক মূল্যবোধ, উদারতাবাদ ও বিজ্ঞান সচেতনতার বৈশিষ্ট্যকে অর্জন করেই শুধু লাভ করা যেতে পারে। আমরা এখন সমাজের দিকে তাকালে যে অবক্ষয়ের বিষয়গুলো দেখতে পাই, তাতে এসব গুণাগুণের পরিবেশ খুব বেশি কার্যকর হতে দেখি না। সমাজ ক্রমেই রক্ষণশীল হয়ে উঠছে, উদারতাবাদ অনেকটাই কোণঠাসা পর্যায়ে চলে যাচ্ছে, মানুষ দ্রুতই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। সমাজে যুক্তিবাদের চেয়ে অন্ধবিশ্বাস, অবৈজ্ঞানিক প্রচার-প্রচারণা সর্বত্র প্রাধান্য পাচ্ছে। সেটি গ্রাম, শহর, গণমাধ্যম, শিক্ষাঙ্গন, রাজনীতিসহ সর্বত্র ব্যাপকভাবে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। সাম্প্রদায়িকতা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়ানো হচ্ছে, আগামী প্রজন্মের মনমানসিকতায় জায়গা করে নিচ্ছে। এর ফলে যেসব মানুষ নিকট-ভবিষ্যতে সমাজ ও রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দেবেন তাঁরা দেশটাকে আদৌ শান্তি-শৃঙ্খলায় পরিচালিত করতে পারবেন না—সেটি নিশ্চিত করে বলা যায়। ১৭ কোটি মানুষ এখন এই দেশে অর্থনৈতিক যেটুকু উন্নতির স্বাদ পাচ্ছে, তাতে উগ্রতা, হঠকারিতা এবং অশিক্ষা-কুশিক্ষা কতটা ঘ্রাস করে নেবে, সেটি এখনই যদি ভাবা না হয়, মানুষকে উদারবাদী জ্ঞান-চিন্তায় দক্ষ  ও সচেতন জনগোষ্ঠীতে পরিণত না করা হয়, তাহলে বড় ধরনের বিপদ এড়িয়ে যাওয়া আমাদের পক্ষে  কতটা সম্ভব হবে বলা মুশকিল। কেননা সমাজের অভ্যন্তরে উগ্রতা ও হঠকারিতার বিস্তার ক্রমেই সর্বগ্রাসী হয়ে উঠছে—এর বিপরীতে শুধু শিক্ষা ও উদারবাদিতাই আমাদের জন্য পাথেয় হতে পারে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

19 + 2 =