মুসলিমদের ওপর নির্যাতনের ভয়ংকর তথ্য

1
884

ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের (সিএএ) বিরোধিতাকারী ও সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৩৪ জন নিহতের খবর পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় আরও ২০০ মানুষ আহত হয়েছেন। হতাহতদের বেশিরভাগই মুসলিম।ভারতের বিরোধী দলীয় নেতৃবৃন্দসহ অনেকেই এই সহিংসতাকে মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর পরিকল্পিত হামলা বলে উল্লেখ করেছেন।

দিল্লির এমন পরিস্থিতিতে ভয়াবহ আতঙ্কে রয়েছেন সংখ্যালঘু মুসলিমরা।

সোমবার ওই সংঘাতের প্রথমদিনে এক পুলিশসহ ৫ জন নিহত হয়। মঙ্গলবার তা বেড়ে দাঁড়ায় সাতে। এরপরই দিল্লির সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর চলে পরিকল্পিত হামলা। সোমবার, মঙ্গলবার ও বুধবারের ওই হামলায় সর্বশেষ খবরে ৩৪ জন নিহত হওয়ার কথা জানা গেছে। তবে হতাহতের পৃকৃত সংখ্যা আরও বেশি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কেননা বুধবার রাতেও আহতদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার খবর মিলেছে।

আহতদের মধ্যে কমপক্ষে ৪৬ জনের শরীরে বুলেট পাওয়া গেছে। অর্থাৎ তারা আহত হয়েছে বন্দুকের গুলিতে। আরও উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে, হাসপাতালগুলোতে এমন অনেক আহতের খোঁজ পাওয়া গেছে যাদের চোখে অ্যাসিড ঢালা হয়েছে।

স্থানীয় সংবাদ মাধ্যম আনন্দবাজার জানায়, অ্যাসিড হামলায় দৃষ্টি হারিয়েছেন কমপক্ষে চারজন। খুরশিদ নামে এক জনের দু’চোখই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ওই ব্যক্তি তেগ বাহাদুর হাসপাতাল থেকে লোকনায়ক জয়প্রকাশ হাসপাতালে আসার জন্য অ্যাম্বুল্যান্স পর্যন্ত পাননি। রিকশায় এসেছেন। দুই চোখ-সহ পুরো মুখ ঝলসে গিয়েছে ওয়কিলের। ফলে এটা স্পষ্ট, পরিকল্পিত এই দাঙ্গায় আগুন লাগানো, পাথরবাজি, গুলির সঙ্গে চালানো হয়েছে অ্যাসিড হামলাও। এমনকি পুলিশকেও নাকি অ্যাসিড হামলার মুখে পড়তে হয়েছিল।

টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেখানে ভয়ংকর কিছু ঘটনা ঘটেছে। একের পর এক ক্ষতবিক্ষত মানুষকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তাদের কেউ গুলিবিদ্ধ, আবার কারো মাথা থেঁতলে গেছে হাতুড়ির আঘাতে।

এক ব্যক্তির শরীরে ৫টি গুলি লেগেছে। এমনকি তার মুখ এবং মাথার কয়েক জায়গা ক্ষতবিক্ষত হয়ে পুরো শরীর রক্তে ভিজে গেছে। আরো দু’জনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে একেবারে অচেতন অবস্থায়। তাদের শরীরে এসিড নিক্ষেপ করা হয়েছে।

সেলিম নামে এক ব্যক্তি তার স্বজনের মরদেহ গ্রহণের জন্য অপেক্ষায় আছেন। ইশরাক হাসান নামে ২৪ বছর বয়সী ওই ব্যক্তির দেহ মর্গে রয়েছে। সেলিম বলেন, ইশরাকের শরীরে পাঁচটি গুলি লেগেছে। মঙ্গলবার বিকেলে মুস্তাফাবাদে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন তিনি। মাথা ও বুকে বেশ কয়েকটি বড় ধরনের ক্ষত রয়েছে। সম্ভবত তলোয়ার দিয়ে আঘাত করা হয়েছে তাকে।

২১ বছর বয়সী আবদুস সামাদ গিয়েছিলেন নামাজ পড়তে। মুস্তাফাবাদ এলাকার একটি মসজিদে মঙ্গলবার বিকেলে তাকে ধরে রড দিয়ে পেটানো হয়। তবে তিনি বেঁচে গেছেন। বর্তমানে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তিনি বলেন, ওই মসজিদে যারা যারা ছিল, সবাইকে রড দিয়ে পেটানো হয়েছে।

মুহাম্মদ সাহিল নামে এক তরুণের বাবাকে নিজের বাড়ির বাইরে গুলি করা হয়েছে। কিন্তু মঙ্গলবারের ওই ঘটনায় আহত বাবাকে বাঁচাতে পুলিশের সহায়তা চেয়ে হতাশ হয়েছেন সাহিল।

তিনি আরো বলেন, একপর্যায়ে খুব কষ্ট করে গভীর রাতে বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে আসি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাবাকে বাঁচাতে পারিনি।

শুধু তাই নয় গত কয়েকদিনের ভয়াবহ সহিংসতায় সংখ্যালঘু মুসলিমনদের বহু ঘরবাড়ি, দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুড়েছে আগুনে। বাদ যায়নি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মসজিদগুলোও। এক মসজিদে আগুন লাগিয়ে তার মিনারে গেরুয়া পতাকা উত্তোলন করেছে চরমপন্থি হিন্দুরা। সেই ছবি আর ভিডিও ফুটেজ আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোতে ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে এখনও। ভয়ে বহু মুসলিম ঘর-বাড়ি ছেড়ে নিরুদ্দেশে যাত্রা করেছে। ফলে দিল্লি জাফরাবাদ ও মৌজপুরে এলাকার মুসলিম বসতিগুলোতে এখন কবরের নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। ফাঁকা রাস্তা জুড়ে পাথর, ইট, ভাঙা কাচ, ভাঙা লোহার রড। ভিতরের গলি থেকে আজও পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে কালো ধোঁয়া। মৌজপুরের গলির একটি দোকানে আগুন নেভেনি। বলাবাহুল্য এই দোকানের মালিকও একজন মুসলিম।

এ নিয়ে আনন্দবাজারের বক্তব্য, ‘দোকানের মালিক কোন ধর্মের, তা দেখেই আগুন লাগানো হয়েছে। এ পাড়ায় ধর্মের জোরে যাদের দোকান বেঁচে গিয়েছে, অন্য গলিতে সেই ধর্মের জেরেই দোকান পুড়েছে।’

জাফরাবাদের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাসিন্দার বরাত দিয়ে পত্রিকাটি জানায়, ‘ভিতরের মহল্লায় অশান্তি চলছে। কোথায় কতজনের মরদেহ পড়ে রয়েছে, কেউ জানে না। পুলিশ এখনও ঢুকতে পারেনি ভিতরে।’ অর্থাৎ পুলিশ এখনও সে চেষ্টা করেনি বা তাদের সেখানে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না।

আনন্দবাজার জানায়, খাজুরি খাসের গামরি এক্সটেনশনে মুহম্মদ সাইদ সালমানি মঙ্গলবার দুধ কিনতে বেরিয়েছিলেন। এসময় তার বাড়িটি ঘিরে ফেলে দাঙ্গাকারী হিন্দুরা। খবর পেয়ে বাড়ির দিকে ছুটে যান সালমানি। কিন্তু পাড়ার লোকেরা নিরাপত্তার স্বার্থেই তাকে বাড়ির দিকে যেতে দেননি। ফলে আগুনে পুড়ে মারা যান ৮৫ বছরের মা আকবরি। একই সঙ্গে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায় তার রোজগারের একমাত্র অবলম্বন দর্জির দোকানটি ।

তেগবাহাদুর ও লোকনায়ক জয়প্রকাশ হাসপাতালের চিকিৎসকেরা বলছেন, হতাহতদের বেশির ভাগই গরিব বা মধ্যবিত্ত। ২৮ বছরের মুবারক হুসেন দ্বারভাঙা থেকে বাবরপুরে এসে শ্রমিকের কাজ করতেন। বিজয় পার্কে তার বুকে গুলি লাগে। মুদাস্‌সির খান, শাহিদ খান আলভি অটো চালাতেন। ভজনপুরার মারুফ আলিকে কপালে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি করে মারা হয়েছে।

সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার তিন দিন পর এদিকে বুধবার দিল্লি দাঙ্গ কবলিত এলাকাগুলো পরিদর্শনে যান জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল। এসময় এক মুসলিম ছাত্রী তাকে বলেন, পুলিশ হামলা বন্ধের কোন্রও চেষ্টা করেনি। বরং দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে থেকে বিষয়টি উপভোগ করেছে। ওই ছাত্রীর কথার কোনও উত্তর ছিল না দোভালের কাছে। তবে তিনি বিষয়টি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

7 + 19 =