করোনার ও ডেঙ্গু থেকে সাবধান বাংলাদেশ

0
559

করোনাভাইরাসের প্রকোপ বৃদ্ধির পর ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় কয়েক হাজার ভবনের নির্মাণকাজ আকস্মিক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেগুলো পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। এছাড়া সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত, মার্কেট-শপিংমল ও স্কুল-কলেজ দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকায় জনশূন্য এসব প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন আনাচে-কানাচে পড়ে থাকা নানা পাত্র, ওয়াটার রিজার্ভার ও ছাদে বৃষ্টির পানি জমছে, যা পরিষ্কার করার কেউ না থাকায় সেখানে নির্বিঘ্নে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার লার্ভা জন্ম নিচ্ছে। এ অবস্থায় করোনা প্রতিরোধে চলমান সরকারি ছুটি ঈদের পর পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হওয়ায় এসব স্থানে এডিস মশার বিস্তার আরও ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পাবে বলে স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন। স্থানীয়রা জানান, ঢাকা মহানগরীর প্রতিটি পাড়া-মহলস্নায় ২০ থেকে ৫০টি নির্মাণাধীন ভবন রয়েছে। যার বেশিরভাগই মার্চের মাঝামাঝি থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। সেখানকার ওয়াটার রিজার্ভার, বেজমেন্টের গর্ত, খোলা ছাদ এবং পড়ে থাকা মিকচার মেশিন, সেন্টারিংয়ের স্টিলের ফর্মা, ইট ভেজানোর হাউজে কমবেশি বৃষ্টির পানি জমেছে, যা এডিস মশার উপযুক্ত প্রজননক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। এছাড়া ঢাকার কর্মজীবীর বিপুল সংখ্যক মানুষ দীর্ঘ ছুটি পেয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যাওয়ায় তাদের ঘরের বারান্দা, কার্নিস, বাথরুমের উমুক্ত কমোড ও ছাদে লাগানো ফুলের টবে জমা পানি এডিস মশার লার্ভা জন্মাচ্ছে।

অন্যদিকে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে ছুটি থাকায় সেখানকার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। ফলে সেখানকার বিভিন্ন আনাচে-কানাচে ও খোলা মাঠের ছোট-বড় গর্তে গত কয়েকদিনের বৃষ্টির পানি জমে এডিস মশা নির্বিঘ্নে বংশ বিস্তার করছে। এছাড়া অফিস-আদালত, মার্কেট-শপিংমলসহ বন্ধ থাকা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও একইভাবে এডিস মশার লার্ভা জন্ম নিচ্ছে।

অথচ ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনও এখন এ ব্যাপারে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। রাজধানীতে এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংসে ১০ মে’র পর থেকে দুই সিটি করপোরেশনের অভিযান চালানোর কথা থাকলেও তা কার্যত শুরু হয়নি। দীর্ঘ ছুটিতে বন্ধ থাকা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভবনের ছাদ, বাথরুমের কমোডসহ অন্যান্য জায়গায় পানি জমে থাকলে, তা স্ব স্ব কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে পরিষ্কার করার তাগিদ দেওয়া হলেও সরকারি সে নির্দেশনা প্রায় কেউই মানছে না। সরকারি ভবনে গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে কাজ করবে বলে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী আশ্বস্ত করলেও এ ধরনের কোনো তৎপরতা এখনো চোখে পড়েনি।

এদিকে করোনার ভয়ে গৃহবন্দি নগরবাসী ঘরের ভেতর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা করলেও বাসার গ্যারেজে থাকা পরিত্যক্ত টায়ারসহ অন্য কোনো পাত্র, ওয়াটার রিজার্ভার কিংবা আশপাশে জমা বৃষ্টির পানিতে এডিস মশার লার্ভা জন্মাচ্ছে কিনা তারা তার খোঁজ নিচ্ছেন না। এ কাজের জন্য তারা সিটি করপোরেশনের ওপর ভরসা করে আছেন। অথচ সে কাজ দূরে থাক, করোনা পরিস্থিতির কারণে সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের রুটিন ওয়ার্কও অনেকটা বন্ধ। ফলে পয়ঃ ও ময়লা পানি নিষ্কাশনের ড্রেনও একরকম বন্ধ হয়ে আছে। কোথাও কোথাও ড্রেনের মুখেই বৃষ্টির পানি জমা হচ্ছে। যেখানে নির্বিঘ্নে এডিস মশার প্রজননক্ষেত্র হয়ে উঠছে। সংশ্লিষ্টরা এরই মধ্যে দুই সিটি করপোরেশনের বেশ কিছু ওয়ার্ডে এডিসের লার্ভা শনাক্ত করেছে।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়বে-এমন আলামত আগেই পাওয়া গেছে। এর ওপর দীর্ঘ মেয়াদি সাধারণ ছুটির কারণে সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও নির্মাণাধীন ভবন জনশূন্য থাকায় এবার ডেঙ্গু পরিস্থিতি কোনদিকে গড়াবে তা নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী ছিল ৭৩ জন। চলতি বছরের ২৬ মার্চ পর্যন্ত দেশে এ রোগী শনাক্ত হয়েছে ২৬৯ জন। এ হিসেবে গত বছরের তুলনায় এ বছরে প্রথম তিন মাসে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় চার গুণ বেশি। যদিও এপ্রিল থেকে মে মাসের মধ্যবর্তী সময় পর্যন্ত খুব বেশি ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়নি। স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর মানে এই না যে, ডেঙ্গু রোগে কেউ আক্রান্ত হচ্ছে না। এর কারণ হচ্ছে, করোনার ভয়ে কেউ ডেঙ্গু রোগের পরীক্ষা করাতেই হাসপাতালে যাচ্ছেন না।

কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, এ বছরের প্রথম তিন মাসে এডিস মশার ঘনত্ব অন্যান্য বছরের চেয়ে বেশি। তাই সাধারণ মানুষ সচেতন না হলে এবং সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে এডিস নিধনে জোরালো তৎপরতা না চালানো হলে এ বছর ডেঙ্গু মৌসুমে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা গত বছরকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে।

এদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) স্বাস্থ্য বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, গত বছর এই সময়ের তুলনায় এবার এডিস মশার লার্ভার উপস্থিতি দ্বিগুণের বেশি। সচেতনতা না বাড়লে আসন্ন বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে। তাদের ভাষ্য, তাদের বিপুল সংখ্যক লোকবল করোনা প্রতিরোধের বিভিন্ন কার্যক্রমে সম্পৃক্ত থাকায় এমনিতেই তারা ডেঙ্গু মশক নিধনে তৎপর হতে পারছে না। এর ওপর নগরীতে হাজার হাজার ভবন জনশূন্য থাকায় আগামীতে পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে তা নিয়ে তারা চরম শঙ্কায় রয়েছেন।

ডেঙ্গুর প্রকোপের বিষয়ে কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, ‘ডেঙ্গুর প্রকোপ ঠেকাতে এখনই পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। বিশেষ করে সিটি করপোরেশেনের যে ইউনিট মশা নিধনে শুরু থেকে কাজ করছে তাদের এ নিয়েই কাজ করা উচিত। করোনার পাশাপাশি এটিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। নয়তো ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে পারে। আর মানুষকেও সচেতন হতে হবে। নিজের ঘরের আশপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে।’

এদিকে মশক নিধনে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন লার্ভিসাইডিং এবং জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম চালাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দাবি করলেও বাস্তবে সে তৎপরতা আশানুরূপভাবে দেখা যায়নি। বরং সরেজমিন নগরীর বিভিন্ন স্থান ঘুরে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ছাদ, নির্মাণধীন ভবনের ওয়াটার রিজার্ভার, রাস্তাসংলগ্ন ড্রেনের মুখ ও মাঠ-ঘাটের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক হারে মশার প্রজননস্থলের দেখা মিলেছে। যদিও এসব প্রজননস্থলে এডিস মশার লার্ভা আছে কিনা তা জানা যায়নি।

তবে কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, এখন পর্যন্ত নগরীতে যে পরিমাণ এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে তা উদ্বেগজনক। তারা জানান, মশার লার্ভার উপস্থিতি হিসাব করা হয় ব্রম্নটো ইনডেক্স বা সূচকের মাধ্যমে। জরিপে প্রতি ১০০ প্রজনন উৎসের মধ্যে ২০টি বা তার বেশিতে যদি এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়, তাহলে সেটাকে ঝুঁকিপূর্ণ উপস্থিতি বলা যায়। অথচ এরই মধ্যে ডিএনসিসির ১২, ১৬, ২৮, ৩১ ও ১ ও ডিএসসিসির ৫, ৬, ১১, ১৭, ৩৭ ও ৪২ নম্বর ওয়ার্ডে এইডিসের ব্রম্নটো সূচক মিলেছে ২০ পয়েন্টের বেশি। উত্তরের শুধু ১২ নম্বর ওয়ার্ডে এই সূচক ৩০। উত্তরে ৪১ ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৫৯টি ওয়ার্ডে এ জরিপ চালানো হয়েছে। ডিএনসিসির উত্তরা এবং ধানমন্ডির দুইটি ওয়ার্ডে দুইটি করে এলাকায় জরিপ হয়েছে। জরিপ করা হয়েছে এসব এলাকার ১ হাজারটি বাড়ি। এর মধ্যে বেশকিছু বাড়ি জনশূন্য ছিল।

এদিকে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে যেভাবে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে এতে এডিস মশা বাড়বে, নাকি কমবে তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা সুস্পষ্ট ধারণা দিয়েছেন। তারা জানান, এ ধরনের বৃষ্টিপাতের মধ্যে যদি তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা বাড়তে থাকে তাহলে এডিস মশার বিস্তার ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়বে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ চন্দ্রিমা ইমতিয়া বলেন, এডিস মশা যেহেতু পরিষ্কার পানিতে বেশি জন্মায়, তাই বৃষ্টির কারণে বিভিন্ন স্থানে নতুন করে জমা স্বচ্ছ পানিতে এডিসের উপদ্রব বাড়তে পারে। বৃষ্টির পানি জমা স্থানগুলো এডিস মশার লার্ভার বিস্তার ও প্রজননের সবচেয়ে অনুকূল স্থান বলে জানান তিনি।

অপর এক কীটতত্ত্ববিদ বলেন, এডিস মশার বিস্তার করবে কী করবে না তা নির্ভর করছে কী হারে বৃষ্টিপাত হচ্ছে তার ওপর। তার মতে, মুষলধারে বৃষ্টিতে লার্ভা ধুয়ে মুছে শেষ হয়ে যায়। তবে থেমে থেমে বৃষ্টি হলে মশা বাড়বে, ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়বে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে যেভাবে বৃষ্টি হয়েছে, তা এডিসের বংশ বিস্তারের জন্য সুবিধাজনক। দীর্ঘমেয়াদি সাধারণ ছুটিতে নগরীতে হাজার হাজার ভবন জনশূন্য পড়ে থাকা, কয়েকদিন পর পর থেমে থেমে বৃষ্টি এবং তাপমাত্রা ও বাতাসের আর্দ্রতা বেড়ে যাওয়ায় বিষয়টি উদ্বেগজনক বলে মনে করেন এই কীটতত্ত্ববিদ।

এদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তর আগামী কয়েকদিনের যে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছে তাতে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। তারা জানান, এক সপ্তাহ পরই ঈদের ছুটি শুরু হবে। আর এর আগে কয়েক দফা বৃষ্টি হলে তা জনশূন্য ভবনগুলোতে জমে থাকবে। এ সময় তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বাড়লে এডিস মশা প্রজননের জন্য যথেষ্ট সুবিধা পাবে।

জানা গেছে, তাপমাত্রা ২৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও বায়ুমন্ডলের ৭০ থেকে ১০০ শতাংশ আর্দ্রতা হলো এডিস মশা প্রজননের জন্য উপযোগী আবহাওয়া। গত কয়েকদিন ধরেই ঢাকার তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে রয়েছে। যদিও বায়ুমন্ডলের আর্দ্রতা এখন ৭০ শতাংশের কম। যা কয়েকদিনের মধ্যে বাড়বে বলে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে জানানো হয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

seventeen − 5 =