জেনার চেয়ে গীবত করার পাপ বেশি

0
775

ইসলামে গীবত বা পরনিন্দা করাকে সম্পূর্ণরূপে হারাম বলে ঘোষণা করে তা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে গীবত শোনাও অন্যায়। সুতরাং গীবত যে রকম পাপ, শ্রবণ করাও তেমনি পাপ। গীবত বা পরনিন্দাকে নবী করিম (সা.) অত্যন্ত কঠোর ভাষায় নিন্দা করেছেন এবং এর পরিণাম সম্পর্কে তার উম্মতকে অবহিত করে বলেছেন, ‘আগুন যেমন শুকনো কাঠ জ্বালিয়ে ভস্মীভূত করে ফেলে, গীবতও তদ্রম্নপ মানুষের সওয়াবগুলো ধ্বংস করে ফেলে।’ অপর এক হাদিসে মহানবী (সা.) গীবতের পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করে বলেছেন, গীবত জেনা-ব্যভিচারের চেয়েও মারাত্মক। কোনো ব্যক্তি ব্যভিচার করার পর তওবা করলে আলস্নাহতায়ালা তাকে ক্ষমা করে দিতে পারেন। কিন্তু গীবতকারীকে ততক্ষণ পর্যন্ত আলস্নাহ মাফ করেন না, যতক্ষণ না যার গীবত করা হয়েছে তিনি ওই গীবতকারীকে মাফ করেন। (বায়হাকি)। পবিত্র কোরআনের সুরা হুজরাতের ১১নং আয়াতে আলস্নাহতায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা একে অপরের

\হপ্রতি দোষারোপ করো না।’ একই সুরার পরবর্তী আয়াতে মহান আলস্নাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা অনুমান থেকে দূরে থাকো। কেননা অনুমান কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাপের কাজ। তোমরা একে অপরের গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না এবং একে অপরের পশ্চাতে গীবত করো না।’ আলস্নাহতায়ালা বলেন, পশ্চাতে ও সম্মুখে পরনিন্দাকারীর জন্য কঠিন দুর্ভোগ। (সুরা হুমাযাহ :আয়াত ১)।

ইসলামের পরিভাষায় কারও অনুপস্থিতিতে তার কোনো দোষ-ত্রম্নটি অন্যের কাছে আলোচনা করাই গীবত। যদিও তার মধ্যে ওই দোষগুলো বিদ্যমান থাকে। মহানবী সালস্নালস্নাহু আলাইহি ওয়াসালস্নাম জনৈক সাহাবির প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘গীবত হচ্ছে তাই- যা শুনলে তোমার ভাইয়ের খারাপ লাগবে, তা নিয়ে আলোচনা করার নামই গীবত।’

ওই সাহাবি আবার জিজ্ঞেস করেন, আমি যা বলছি তা যদি ওই ব্যক্তির মধ্যে বিদ্যমান থাকে তবু কি তা গীবত হবে? তখন মহানবী (সা.) প্রতু্যত্তরে বলেন, ‘যদি তার মধ্যে ওই দোষগুলো থাকে তাহলেই তো গীবত হবে আর তা না থাকলে সেটা হবে তোহমত যার অর্থ অপবাদ।’

নিশ্চিত না হয়ে কারও সম্পর্কে মন্দ কিছু ধারণা করাও গীবতের অন্তর্ভুক্ত। এ ধরনের মন্দ ধারণাকে ইমাম গাযযালী আন্তরিক গীবত বলে অভিহিত করেছেন। এ প্রসঙ্গে কুরআন মজিদের সুরা হুজরাতের ৬নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, ‘যদি তোমাদের কাছে কোনো ফাসিক কোনো খবর নিয়ে আসে, তা ভালোমতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অনুসন্ধান করে নেবে।’ নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘আলস্নাহ মুসলিমের রক্ত, ধনসম্পদ ও তার প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করাকে হারাম করেছেন।’

গীবত ও পরনিন্দা থেকে বাঁচার উপায় সম্পর্কে বলা হয়েছে, প্রথমত পবিত্র কুরআন ও হাদিসে গীবতের ক্ষতি ও অনিষ্ট সম্পর্কে যা উলেস্নখ করা হয়েছে তার মর্ম উপলব্ধি করে তার ওপর দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস স্থাপন করা। দ্বিতীয়ত, নিজের দোষ অনুসন্ধান করা। নিজের দোষ বের হওয়ার পর মনে করতে হবে, আমার মতো অন্যেরও দোষ থাকা অসম্ভব নয়। নিজে যেহেতু দোষ থেকে বাঁচতে পারিনি, সেহেতু অন্যের দোষও থাকতে পারে।

মানুষ সাধারণত যেসব কারণে গীবত করে থাকে ইমাম গাযযালী (রহ.) তার আটটি কারণ উলেস্নখ করে তা থেকে বাঁচার উপায়ও বর্ণনা করেছেন। ১. ক্রোধ- কেউ কারও প্রতি ক্রোধাম্বিত হলে সে তার গীবতে লিপ্ত হয়। সুতরাং ক্রোধ দমন করলেই এসব গীবত থেকে বাঁচা যায়। ২. কারও সন্তুষ্টি লাভের জন্য ওই ব্যক্তির শত্রম্নদের গীবত করা হয়। এ অবস্থায় মনে করতে হবে কোনো মানুষের সন্তুষ্টি লাভের জন্য আলস্নাহতায়ালার অসন্তুষ্টি অর্জন করা নির্বুদ্ধিতা ও মূর্খতা ছাড়া আর কিছু নয়।

৩. নিজের দোষ হতে অব্যাহতি লাভের জন্য অপরের দোষ উদঘাটন, নিজের দোষ ঢাকার জন্য অপরের দোষ প্রকাশ করে আলস্নাহতায়ালার অসন্তুষ্টি অর্জন করা কখনো সঙ্গত হতে পারে না। ৪. আত্মপ্রশংসা-নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশের জন্য অন্যের নিন্দা করা। ৫. ঈর্ষা-নিজের যোগ্যতা দিয়ে যারা মান-সম্মান অজর্ন করেছেন, ঈর্ষাপরায়ন ব্যক্তির কাছে তা সহ্য হয় না। কারণে-অকারণে সে ওই সম্মানিত ব্যক্তির দোষ অম্বেষণ করতে থাকে এবং ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হয়। এসব ব্যক্তি দুনিয়াতে ঈর্ষার অনলে দগ্ধ হয়, আর আখিরাতে জাহান্নামের আগুনে দগ্ধ হয়। হিংসুকের হিংসায় সম্মানিত ব্যক্তির সম্মান এতটুকুও লাঘব হয় না।

ক্ষতি হিংসুকেরই হয়। ৬. উপহাস ও ঠাট্টাবিদ্রম্নপ-অনেক সময় মানুষ মজা করা কিংবা অন্যকে অপদস্থ করার উদ্দেশ্যে তার ক্রিয়াকলাপ নিয়ে ঠাট্টাবিদ্রম্নপ ও উপহাসে মত্ত হয়। ৭. অসতর্কতা-অনেক সময় পরহেজগার ব্যক্তিরাও পাপের আলোচনা করতে গিয়ে পাপীর নামও উলেস্নখ করে ফেলেন। অথচ তিনি খেয়াল করেন না যে, এটা গীবতের মধ্যে গণ্য হয়ে যায়।

সুতরাং পাপাচার নিয়ে আলোচনা করার সময় সতর্ক থাকতে হবে, যাতে কখনো কারো নাম উচ্চারিত না হয় এবং কারও প্রতি ইঙ্গিত করা না হয়। ৮. মূর্খতা-মূর্খতা মানুষের জন্য বড় অভিশাপ। অনেকে জানেই না যে, কোনো কথা গীবতের মধ্যে পড়ে, আর কোনো কথা গীবতের মধ্যে পড়ে না কিংবা পাপ নিয়ে আলোচনার সময় পাপীর নাম নিলে গীবত হয়ে যায়।

তবে অনিষ্টকর ব্যক্তির ক্ষতি হতে জনসাধারণকে সচেতন করার উদ্দেশ্যে অনিষ্টকারীর নাম নেওয়া বৈধ। এটা গীবতের মধ্যে পড়ে না। অনুরূপভাবে বিচারকের সামনে সাক্ষী হিসেবে পাপীর নাম নেওয়া গীবত নয়। এছাড়া যারা প্রকাশ্যভাবে পাপ করে এবং পাপকে দোষের মনে করে না তাদের নাম নেওয়ার বিষয়টিও গীবতের অন্তর্ভুক্ত হবে না।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

2 × three =