পরিবহন শ্রমিক নেতারা সাধারণ শ্রমিক ও ড্রাইভার-হেলপারদের পাশে নেই

0
522

এজাজ রহমান: খোঁজ নেই কল্যাণ ফান্ডের টাকার, ক্ষোভ-বিক্ষোভে অসহায় দিন কাটছে সাধারণ শ্রমিক ও ড্রাইভার-হেলপারদের, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে গণপরিবহন বন্ধ ঘোষণার পর কর্মহীন হয়ে পড়েছেন দেশের সড়ক পথের পরিবহন শ্রমিকরা। শ্রমিকদের পরিবার নিয়ে এখন অনাহারে-অর্ধাহারে অমানবিক জীবন কাটছে। পরিবার পরিজনদের মুখে খাদ্য তুলে দিতে বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন শ্রমিকরা। নানা উপায়ে চাঁদার টাকায় ফুলেফেঁপে ওঠা পরিবহন শ্রমিক নেতারা এখন উধাও হয়েছেন। ফেডারেশনের তহবিলে বিপুল পরিমাণ টাকা থাকলেও কোনো কাজে আসছে না। এরই মধ্যে অর্ধাহারে অনাহারে বিপর্যস্ত পরিবহন শ্রমিকরা খাদ্য সহায়তার দাবিতে ঢাকায় কয়েক দফা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন। গত ৩ মে ঢাকার মিরপুরে কয়েক হাজার পরিবহন শ্রমিক ত্রাণের দাবিতে বিক্ষোভ করে। এর আগে রাজধানীর ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, সাভার এবং ঢাকার বাইরে কুড়িগ্রাম ও বরিশালেও শ্রমিক বিক্ষোভ হয়েছে। তারা বলেছেন, হয় গণপরিবহন চালু করতে হবে, নতুবা তাদের খাদ্য সাহায্য দিতে হবে। সূত্রমতে, পরিবহন মালিক সমিতি, পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সংগঠন পরিচালনা ব্যয়, শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য স্বাভাবিক সময়ে বাহারি নামে বৈধ-অবৈধ বছরে কমপক্ষে দুই হাজার কোটি টাকা চাঁদাবাজি হয়ে থাকে।

করোনাকালে ৭০ লাখ পরিবহন শ্রমিক পরিবার পরিজন নিয়ে অর্ধহারে অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন। শ্রমিকদের নিয়ে রাজনীতি করে সরকারের ‘গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ হয়ে ওঠা এ সেক্টরের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা শাজাহান খান ও মসিউর রহমান রাঙ্গাও তাদের কোনো খোঁজ নিচ্ছেন না। একইভাবে শ্রমিক ও মালিকদের কল্যাণে কার্যকর ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে না বাংলাদেশ শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্ল্যাহের। নিজেদেরকে তারা গুটিয়ে রেখেছেন বলে পরিবহন শ্রমিকরা জানিয়েছেন। শুধু সড়ক পরিবহনই নয়, নৌপরিবহন খাতের ২০ লাখ শ্রমিকদের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা।

জানা গেছে, বর্তমানে দেশের সড়ক পরিবহন সেক্টরের সঙ্গে ৭০ লাখের বেশি শ্রমিকের রুটি রোজগার জড়িত। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রভাবে পরিবহন চলাচল বন্ধ ঘোষণার পর এসব শ্রমিক কার্যত বেকার হয়ে পড়েছেন। শ্রমিকরা বলছেন, তাদের কল্যাণ তহবিলের নামে প্রতিদিন যে অর্থ আদায় করা হয়, সেই টাকার সামান্য অংশও যদি তাদের জন্য ব্যয় করা হতো, তাহলে শ্রমিকরা উপকৃত হতো। সূত্র জানিয়েছে, ব্যক্তিমালিকানাধীন সড়ক পরিবহন শ্রমিক কল্যাণ তহবিলের বিপুল টাকা থাকলেও কোনো কাজে আসছে না। অন্যদিকে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনে শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের বিপুল অঙ্কের তহবিলও পরিবহন শ্রমিকদের জন্য কাজে আসছে না। দিনমজুরদের জন্য সরকার ঘোষিত ৭৬০ কোটি টাকার সহায়তা কতটুকু পরিবহন শ্রমিকরা পাবেন তাও কেউ জানে না।

এ তালিকা করা নিয়েও নয়ছয় করার অভিযোগ উঠছে। করোনাকেন্দ্রিক লকডাউনে সবচেয়ে বিপর্যয়ের মুখে থাকা পরিবহন শ্রমিকদের পাশে কেউ দাঁড়াচ্ছে না। বিশেষ করে এসব শ্রমিকের কল্যাণের নামে যুগ যুগ ধরে চাঁদা আদায়কারী সংগঠনগুলোও কোনোরকম সহায়তা করা থেকে মুখ ফিরিয়ে আছে। ৭০ লক্ষাধিক পরিবহন শ্রমিক পরিবারের চরম এই দুর্দিনে পরিবহন মালিক সংগঠনেরও কেউ এগিয়ে আসেনি। পরিবহনের চাঁদাবাজিকে পুঁজি করে গড়ে ওঠা ডাকসাইটে নেতাসহ চিহ্নিত মাফিয়ারা পর্যন্ত গা ঢাকা দিয়ে রয়েছেন। জানা গেছে, দেশের পরিবহন শ্রমিকদের সবচেয়ে বড় সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন। দেশজুড়ে বিস্তৃত এর কার্যক্রম।

বিভিন্ন যানবাহন থেকে প্রতিদিন গাড়িপ্রতি ৭০ টাকা করে আদায় করে বড় অঙ্কের চাঁদা। শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য সংগঠনটির রয়েছে বিপুল টাকার ফান্ড। তবে চলমান করোনা পরিস্থিতিতে উপার্জনহীন শ্রমিকদের কোনো কাজেই আসছে না এ টাকা। পরিবহন শ্রমিকরা যখন ‘অনাহারে-অর্ধাহারে’ দিন পার করছেন তখন সরকার নিয়ন্ত্রিত শ্রমিক কল্যাণ তহবিলেও ৪০০ কোটি টাকা পড়ে আছে। এ তহবিল থেকে অসহায় শ্রমিকরা কোনোরকম সহায়তা পাচ্ছেন না। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শাজাহান খানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এদিকে পরিবহন খাতের অভিজ্ঞরা জানান, শ্রমিক কল্যাণ তহবিলের ৪০০ কোটি টাকার বেশি ব্যবহার হচ্ছে না।

দিনমজুরদের জন্য সরকারের ঘোষিত ৭৬০ কোটি টাকার সহায়তার কতটুকু পরিবহন শ্রমিকরা পাবেন তা-ও তাঁরা জানেন না। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, ৯৮ শতাংশ পরিবহন শ্রমিক অনুদান বা অন্যান্য সরকারি সহায়তা পেতে বিড়ম্বনা হবে নিয়োগপত্র না থাকায়। সড়ক পরিবহন খাতে বেশুমার চাঁদাবাজির জায়েজ করতে বলা হয়, ‘সংগঠন পরিচালনা ব্যয়’। বাণিজ্যিক গাড়ি বাস, মিনিবাস, ট্রাক, পিকআপ, অটোরিকশা, ইজিবাইকসহ বিভিন্ন ধরনের পরিবহন থেকে এ চাঁদা তোলা হয়।

দিনে বাস ছাড়ার আগে মালিক সমিতিকে ৪০ টাকা ও শ্রমিক ইউনিয়নকে ৩০ টাকা দিতে হয় শ্রমিকদের। শ্রমিক ইউনিয়নগুলো আবার ৩০ টাকা থেকে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনকে দিয়ে থাকে ১০ টাকা। এই নির্দিষ্ট হারের বাইরেও চাঁদা আদায় করা হয় বিভিন্ন স্থানে। ঢাকার সায়েদাবাদ, গাবতলী, মহাখালী বাস টার্মিনালসহ বিভিন্ন স্ট্যান্ড থেকে দিনে কমপক্ষে কোটি টাকার চাঁদাবাজি হয় স্বাভাবিক সময়ে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সর্বশেষ তথ্যানুসারে, দেশে নিবন্ধিত ২০ ধরনের গাড়ি আছে ৪৪ লাখ।

এর মধ্যে প্রায় আট লাখ গাড়ি বাণিজ্যিক। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. হানিফ খোকন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ফেডারেশনের জন্য দিনে ১০ টাকা হারে ১০ লাখ গাড়ি থেকে চাঁদা তোলা হয়। দিনে কল্যাণ তহবিলের নামে তা তোলা হচ্ছে কমপক্ষে এক কোটি টাকা। জানা গেছে, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের অধীনে ঢাকাসহ সারা দেশে ২৩১টি পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন আছে। এ ফেডারেশনের অধীন বিভিন্ন শ্রমিক ইউনিয়নও শ্রমিকদের নাম সরকারি সহায়তার তালিকায় তোলার নামে কয়েকটি স্থানে চাঁদাবাজি করছে।

সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী জানান, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনে শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের শ্রমিক কল্যাণ তহবিল আছে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার। এই তহবিল থেকেও পরিবহন শ্রমিকরা কোনো সহায়তা পাচ্ছেন না করোনাকালে। এ ব্যাপারে শ্রম অধিদফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে পরিবহন শ্রমিক নেতারা জানতে পারেন, এ সহায়তা শুধু চিকিৎসার জন্য দিতে পারবে অধিদফতর। শ্রমিকেরা অভিযোগ করে জানিয়েছেন তারা সরকার থেকে যেমন সাহায্য সহযোগিতা পাচ্ছেন না। পাশাপাশি মালিক পক্ষ ও শ্রমিক ফেডারেশন থেকেও কোনো সাহায্য সহযোগিতা পাচ্ছেন না।

তারা বলেন, আমরা এখন বেকার অবস্থায় দুর্বিষহ জীবনযাপন করছি। কেউ আমাদের খোঁজখবর নিচ্ছে না। পরিবহন সেক্টরের বেশিরভাগ শ্রমিকই দৈনিক কাজের ভিত্তিতে মজুরি পান এবং সে আয়েই তাদের দৈনন্দিন সংসার চলে। সীমিত আয়ে যেখানে সংসার চালানো কষ্টকর সেখানে কারও পুঁজি গড়ে তোলার সুযোগও নেই। লকডাউনে কর্মহীন ৯০ লাখ সড়ক ও নৌপরিবহন শ্রমিকের পাশে দাঁড়াতে সড়ক ও নৌপরিবহনের মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

four × one =