করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিতে ওষুধ কোম্পানির আড়াই লাখ প্রতিনিধি!

0
513

ফাঁকা রাস্তা। নেই আগের মতো মানুষের কোলাহল। করোনাভাইরাসের সংক্রমণে গোটা পৃথিবীর মতো থমকে গেছে পুরো দেশ। তবুও ঘর বন্দি মানুষের জরুরি ওষুধ পৌঁছে দিতে ভূমিকা রাখছে ওষুধ কোম্পানির বিপণন কর্মীরা। জানা যায়, কোম্পানিগুলো মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভরাই উৎপাদিত ওষুধ ভোক্তার কাছে পৌঁছে দেয়। এজন্য সারা দেশে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ওষুধ বিপণনের সঙ্গে যুক্ত আছে ২১৭টি ওষুধ কোম্পানির প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার কর্মী। যাদের প্রতিদিন কমপক্ষে দুবার হাসপাতাল ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের চেম্বারে যেতে হয়। ভোক্তার কাছে ওষুধ পৌঁছে দিতে মাঠ পর্যায়ের চার পদের মেডিকেল ও সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভ কাজ করে থাকে। তাদের মধ্যে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভরাই সবচেয়ে বেশি করোনা ঝুঁকিতে আছেন। কেননা যথেষ্ট সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়াই ওষুধ বিপণন করছে তারা। ফলে করোনাভাইরাস ঝুঁকিতে এসব বিপণনকর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্যরা।

বেশ কয়েকজন প্রতিনিধি অভিযোগ করে জানিয়েছেন, চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা সামগ্রী পৌঁছে দেওয়া, ডাক্তার ভিজিট করা এবং ফার্মেসিতে নিয়মিত ওষুধ পৌঁছে দেওয়াসহ নিয়মিত সব কাজ করছেন তারা। কিন্তু এ জন্য তাদের নেই যথেষ্ট সুরক্ষার উপকরন। সাথে কোম্পানির মাসিক টার্গেট পূরণের চাপ তো আছেই। এছাড়া ফিল্ডে থাকা বিক্রয় প্রতিনিধি ও ডেলিভারির কাজে নিয়োজিতরাও রয়েছে চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে।

দেশের অন্যতম একটি ফার্মাসিটিকেল কোম্পানির এক মেডিকেল সার্ভিসেস অফিসার নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, ‘করোনার মতো এমন ভয়াবহ সংকটেও ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসকদের ভিজিট করছি এবং ফার্মেসিগুলোতে ওষুধ পৌছে দিচ্ছি। কোম্পানি থেকে আমাদের সুরক্ষার জন্য তেমন কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সবকিছুর পরে আমিও মানুষ। স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতে সেবা দিতে আমার কোন ক্লান্তি নেই।

আমাদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিশ্চিতে কোম্পানির তেমন কোন ভূমিকা নেই। আমি নিজেকে যেমন ঝুঁকিতে ফেলছি, সাথে পরিবারের বাকি সদস্যদেরও ঝুঁকিতে ফেলছি। কিন্তু কোম্পানি এখন পর্যন্ত একটা হ্যান্ড সেনিটাইজার ছাড়া সুরক্ষার জন্য আর কিছুই দেয়নি। এদিকে কোম্পানি থেকে জানানো হয়েছে, মাসিক টার্গেট পূরণ না হলে টিএ/ডিএ দিতে পারবে না।’

তিনি আরো বলেন, ‘এমন পরিস্থিতিতে আমাদের তো করার কিছুই করার নেই। কোন রকম ব্যক্তিগত সুরক্ষা ছাড়াই হাসপাতাল, চিকিৎসকদের চেম্বার ও ফার্মেসিগুলো নিয়মতিই যেতে হচ্ছে আমাদের। রাষ্ট্রের এরকম অসময়ে আমার বসে থাকতে পারি না। আমাদেরও দায়িত্ব আছে। আমরা ছুটি চাই না। দ্রুত সময়ে মধ্যে আমাদের প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সরঞ্জাম নিশ্চিতের দাবি করছি।’ 

এ ব্যাপারে এস কে এফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের সিনিয়র মেডিকেল সার্ভিসেস অফিসার রাজিব আহম্মেদ মেডিভয়েসকে বলেন, ‘সুরক্ষার জন্য কোম্পানি থেকে হ্যান্ড সেনিটাইজার ও মাস্ক কিনতে বলা হয়েছে। তবে এখনো পিপিই পাইনি। আমি প্রত্যাশা করি পরিস্থিতির আলোকে কোম্পানি ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিশ্চিতে সহযোগিতা করবে। তাছাড়া আমরা জাতির কাছে দায়বদ্ধ।

ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের মেডিকেল সার্ভিসেস অফিসার নাছির উদ্দিন মেডিভয়েসকে বলেন, ‘এ সংকটে ওষুধ পৌঁছে দেওয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। কোম্পানি থেকে মাক্স ও হ্যান্ড সেনিটাইজার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তা সুরক্ষার জন্য যথেষ্ট না। সুরক্ষার জন্য প্রয়োজন পিপিই। তা না হলে আমরা কাজে যেতে পারবো না। তাছাড়া  নিজের সাথে আমি আমার পরিবারের সদস্যদেও ঝুঁকির মধ্যে ফেলছি।’

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প মালিক সমিতির মহাসচিব সফিউজ্জামান বলেন, ‘মাঠ পর্যায়ে কর্মীদের কোনো প্রকার বাধ্য করা হচ্ছে না। তাদের নিরাপদ ও নিয়মিত সুরক্ষা নিয়ম পরিপালন করে বিপণনকাজে যুক্ত থাকার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তাছাড়া এ ঝুঁকির মধ্যে কেউ কাজ করতে না চাইলে তাকেও বাধ্য করা হচ্ছে না। স্বাধীনভাবে কর্মীদের এক্ষেত্রে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। কর্মীদের সুরক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।’

সুরক্ষায় করণীয় নিয়ে মেডেভয়েসকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সুলতানা শাহানা বানু বলেন, ‘যেহেতু করোনাভাইরাস কোথাও কোথাও কমিউনিটি ট্রান্সমিশন শুরু হয়েছে। তাই খুব প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হওয়া যাবে না। বিশেষ করে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি ও ডেলিভারি ম্যানদের জরুরি ওষুধ পৌঁছে দিতে বাইরে বের হতে হয়, তাই অবশ্যই তাদেরকে ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া হাসপাতাল ও ফার্মেসিতে সর্দি-কাশি নিয়ে অনেক রোগী ওষুধ নিতে আসেন। এখন কার শরীররে এ ভাইরাস আছে তা তো পরীক্ষা ছাড়া বলা যাবে না। তাই অবশ্যই সবাইকে ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিশ্চিতে খুব সচেতন থাকতে হবে।’

দেশব্যাপী কর্মরত সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভ ও মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের সংগঠন ‘ফারিয়া’, করোনা প্রতিরোধে সদস্যদের নির্দেশনা দিয়েছে, সব হাসপাতাল-ক্লিনিক ভিজিট আপাতত বন্ধ রাখতে হবে, রোগীদের সংস্পর্শ এড়াতে প্রেসক্রিপশনের কোনো ছবি তোলা থেকে বিরত থাকতে হবে, ডাক্তারদের সঙ্গে রুটিন ভিজিট থেকে বিরত থাকতে হবে, সতর্কতার সাথে শুধু অর্ডার কালেকশন ও ডেলিভারি চলবে এবং সব ধরনের রিপোর্টিং বন্ধ থাকবে। রিপ্রেজেন্টেটিভরা নিজে থেকেই এ নির্দেশনা পালন করবেন।

উল্লেখ্য, দেশে প্রায় ২৭৩টি তালিকাভুক্ত কোম্পানি থাকলেও বর্তমানে পরিচালিত হচ্ছে ২১৭টি কোম্পানি। কোম্পানিগুলো দেশে ও বিদেশে প্রায় ২৮ হাজার ৫০০ ওষুধ বিপনন করে। ৭০ শতাংশ বাজার দখল রয়েছে শীর্ষ ১০টি কোম্পানির। এর বাইরে হোমিওপ্যাথিক, ইউনানি, আয়ুর্বেদিক ও হারবাল কোম্পানি রয়েছে। সেলস ও মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের মাধ্যমে কোম্পানিগুলো অভ্যন্তরীণ বাজারে ওষুধ এবং এ-সংক্রান্ত পণ্য বিক্রি করে। দেশে প্রায় ১ লাখ ৭ হাজার ৪৬৬টি তালিকাভুক্ত ফার্মেসি রয়েছে। এসব ফার্মেসি ছাড়াও বেসরকারি হাসপাতাল, চিকিৎসক, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ও দাতা সংস্থায় ওষুধ বিক্রি করে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

nineteen + five =