বরগুনায় সেই বাঁশের সাঁকো মেরামতের দরপত্র বাতিল

0
514

বরগুনায় ৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩৩ টি লোহা সেতুর মেরামত ও পুনর্নির্মাণের টেন্ডার বাতিল করা হয়েছে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের (এলজিইডি) ওয়েবসাইটের মাধ্যমে এই তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ বিষয়ে কথা বলতে নারাজ ছিলেন।

২৮ জুলাই বরগুনার স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি) ৪৪ কোটি টাকা ব্যয়ে বরগুনার আমতলী ও তালতলী উপজেলায় ৩৩ টি লোহার সেতু সংস্কার ও পুনর্নির্মাণের জন্য দরপত্র আহ্বান করেছে। ‘চারটি বাঁশের সেতু সংস্কারের জন্য বরাদ্দ করা ৯ কোটি টাকা’ শিরোনামে জাগো নিউজে এই খবর প্রকাশিত হয়েছিল।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) এই খবর শুনে কেঁপে উঠল। এ প্রসঙ্গে মঙ্গলবার (২ সেপ্টেম্বর) বিকেলে দরপত্র বাতিল করা হয়।

জাগো নিউজে এই সংবাদ প্রকাশের পরে জানা গেছে, বরগুনা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) নির্বাহী প্রকৌশলী ফোরকান আহমেদ খান আমতলী ও তালতলী উপজেলার ৩৩ টি লোহা সেতুর মেরামত ও পুনর্নির্মাণের টেন্ডারে ত্রুটি ও ভুলগুলি উল্লেখ করেছেন। ৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে। তিনি রশিদ খানকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। বরগুনার নির্বাহী প্রকৌশলী ফোরকান আহমেদ খান তখন প্রধান প্রকৌশলের নির্দেশ মোতাবেক দরপত্রটি বাতিল করে দেন।

তবে বরগুনায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ফোরকান আহমেদ খানের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি পৌঁছাতে পারেননি।

বরগুনা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি) কর্তৃক ৮৫ মিটার দৈর্ঘ্যরে একটি আয়রন ব্রিজ মেরামতের প্রাক্কলন ব্যয় ধরা হয়েছে তিন কোটি টাকা। ঘটনাস্থল আমতলী উপজেলার হলদিয়া ইউনিয়নের তুজির বাজার। গত শুক্রবার (২৮ আগস্ট) দুপুরে টেন্ডারের অন্তর্ভুক্ত ওই ব্রিজটি তন্নতন্ন করেও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে একটি বাঁশের সাঁকো পাওয়া গেছে।

এ নিয়ে কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুর রাজ্জাক মোল্লার (৬৫) সাথে। ব্রিজের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বাঁশের সাঁকোটি দেখিয়ে দেন। তিনি বলেন, “এখানে ব্রিজ পাবেন কই? দুই-তিন কিলোমিটারের মধ্যেও কোনো ব্রিজ নেই। যুগ যুগ ধরে কত জনপ্রতিনিধি, কত অফিসের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি আমরা। কিন্তু কেউ এখানে একটি ব্রিজ নির্মাণ করেনি। প্রতিদিন শত শত গ্রামবাসী বাঁশের সাঁকো দিয়েই এই খাল পার হয়। নিজেদের উদ্যোগে এই সাঁকো তৈরি করেছি আমরা। ওই যে বাঁশের সাঁকো দেখছেন, ওটাই এখানকার ব্রিজ।”

স্থানীয় যুবক মো. সজীব (২৫) বলেন, দেশটা চোরে ভরে গেছে। এই সাঁকোটিকেই কাগজে-কলমে ব্রিজ দেখিয়ে সংস্কারের নামে কোটি কোটি টাকা লোপাটের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এখানকার সংসদ সদস্য ছিলেন। তিনি যদি জানতে পারেন তাঁর সংসদীয় এলাকায় এ সাগর চুরি হচ্ছে, তাহলে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের অবশ্যই আইনের আওতায় নেয়া হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের আয়রন ব্রিজ পুননির্মাণ প্রকল্পের (আইবিআরপি) আওতায় গত ২৮ জুলাই ৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে বরগুনার আমতলী ও তালতলী উপজেলায় ৩৩টি লোহার ব্রিজ সংস্কারের জন্য দরপত্র আহ্বান করে জেলার স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি)। দরপত্রে আমতলী উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে ২৬টি ও তালতলী উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে ৭টি ব্রিজ সংস্কারের জন্য বরাদ্দ অনুমোদন দেয়া হয়। মোট আটটি প্যাকেজে আহ্বান করা হয় এ দরপত্র। দরপত্র জমাদানের শেষ তারিখ আগামী ৬ সেপ্টেম্বর। দরপত্রে পুরোনো আয়রন ব্রিজের স্থলেই কেবলমাত্র সংস্কারে জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ব্রিজ নেই এমন কোথাও নতুন করে ব্রিজ নির্মাণের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়নি। সরেজমিন ঘুরে বাস্তবে দেখা যায়, ৩৩ টির মধ্যে ২২ টি পুরাতন আয়রন ব্রিজ এবং ১১ টিই বাঁশের সাঁকো।

দরপত্রে হলদিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ তক্তাবুনিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন নাশবুনিয়া খালের উপর চার কোটি টাকার অধিক ব্যয়ে সংস্কারের আওতায় আনা টেন্ডারের দুই নম্বর প্যাকেজে অন্তর্ভুক্ত আছে ১১০ মিটার (৩৬০ ফুট) দৈর্ঘ্যের ব্রিজ। কিন্তু সেখানে ব্রিজ তো দূরের কথা খালেরও সন্ধান পাওয়া যায়নি। এমনকি উপজেলার কোথাও নাশবুনিয়া নামে কোনো খাল নেই বলেও নিশ্চিত করেছেন উপজেলার নবীন-প্রবীণ অধিবাসী এবং সাবেক জনপ্রতিনিধিসহ বর্তমান জনপ্রতিনিধিরাও।

এছাড়াও আড়াই কোটি টাকার অধিক ব্যয়ে দরপত্রের তিন নম্বর প্যাকেজের অন্তর্ভুক্ত একই ইউনিয়নের রামজি বাজার সংলগ্ন ৭০ মিটার (২২৯ ফুট) দৈর্ঘ্যের একটি ব্রিজ সংস্কারের কথা বলা হলেও সেখানে স্থানীয়দের উদ্যোগে নির্মিত একটি বাঁশের সাঁকো ছাড়া কোনো ব্রিজ খুঁজে পাওয়া যায়নি।

একই ইউনিয়নে সংস্কারের জন্য দরপত্রের দুই নম্বর প্যাকেজে থাকা দুলপুকুরিয়া এলাকার এলাহিয়া দাখিল মাদরাসা সংলগ্ন ৬০ মিটার (১৯৬ ফুট) দৈর্ঘ্যের ব্রিজ এবং একই প্যাকেজের অন্তর্ভুক্ত দক্ষিণ রাওগা কেরাতুল কোরআন দাখিল মাদরাসা সংলগ্ন ৬০ মিটার (১৯৬ ফুট) দৈর্ঘ্যের ব্রিজটিও খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই দুই জায়গায়ই নিজেদের তৈরি দুটি বাঁশের সাঁকো দেখিয়েছেন স্থানীয়রা। চার কোটি টাকারও অধিক ব্যয়ে এই দুই স্থানে ব্রিজ সংস্কারের কথা। ব্রিজই নেই অথচ সংস্কারের নামে কোটি কোটি টাকার প্রাক্কলন ব্যয় দেখিয়ে দরপত্র আহ্বান করায় এ প্রকল্পটিকে ভুয়া ও ভৌতিক প্রকল্পের পাশাপাশি লুটপাটের প্রকল্প হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন স্থানীয়রা।

স্থানীয় ঠিকাদার মো. মোস্তাফিজুর রহমান সোহেল বলেন, দরপত্র আহ্বান করার পর আমি কয়েকটি ব্রিজ ঘুরে দেখেছি। প্রকল্পের ৪নং ও ৫নং প্যাকেজের আওতায় গুলিশাখালী ইউনিয়নের প্রত্যন্ত ডালাচরা গ্রামে সাত কিলোমিটার এলাকায় ছয়টি ব্রিজ সংস্কারে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে প্রাক্কলনের চেইনেজের সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। প্রাক্কলনে বাইনবুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শরীফ বাড়ি পর্যন্ত সাত কিলোমিটার দূরত্ব দেখানো হলেও বাস্তবে এর দূরত্ব হচ্ছে দুই কিলোমিটারেরও কম।

তিনি আরও বলেন, বারেক হাওলাদার ও শরীফ বাড়ি সংলগ্ন এলাকায় কোনো ব্রিজ নেই। সেখানে বাঁশের সাঁকো রয়েছে। আর উত্তর ডালাচরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় ব্রিজ বা সাঁকো কোনোটির অস্তিস্ত¡ পাওয়া যায়নি। এছাড়াও বাকি দুটি ব্রিজ যানবাহন চলাচলের উপযোগী। শুধু রেলিংয়ের সামান্য সংস্কারই যথেষ্ট। অথচ সংস্কারের নামে বিপুল অর্থ বরাদ্দ দেখানো হয়েছে। আহ্বান করা দরপত্রের ৩৩টি ব্রিজের মধ্যে যেসব স্থানে ব্রিজ আছে তা সংস্কারের ক্ষেত্রে অধিকাংশ ব্রিজেরই দৈর্ঘ্য বেশি দেখানো হয়েছে। এছাড়াও সংযোগ সড়কে প্রয়োজনের অতিরিক্ত মাটির কাজ এবং রেল পোস্টসহ নানা খাত দেখিয়ে প্রয়োজনের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

হলদিয়া ইউনিয়নের তুজির বাজার সংলগ্ন ৮৫ মিটার দৈর্ঘ্য যে ব্রিজটি সংস্কারের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে, সেখানে থাকা বাঁশের সাঁকোটির দৈর্ঘ্য হচ্ছে ৬০ মিটার। এছাড়াও এখানে মাটির কাজের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় নয় লাখ টাকা। একই ইউনিয়নের রামজী বাজার সংলগ্ন ব্রিজেরও একই অবস্থা। সেখানেও ব্রিজ নেই। আছে ৫১ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি বাঁশের সাঁকো। একই অর্থ বছরে এলজিইডির একই প্রকল্পের আওতায় বরগুনার বেতাগী উপজেলার তিনটি ব্রিজে যে ব্যয় ধরা হয়েছে সেই তুলনায় আমতলীর ২৬টি ব্রিজের প্রতিটিতে তুলনামূলক দ্বিগুণ ব্যয় ধরা হয়েছে।

এদিকে ভুয়া ও ভৌতিক এই দরপত্রটি বাতিলের দাবিতে ইতোমধ্যেই এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলীকে চিঠি দিয়েছেন বরগুনার ঠিকাদাররা। ওই চিঠির অনুলিপি দেয়া হয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ও সচিবকেও। চিঠিতে প্রয়োজনের তুলনায় প্রকল্পের প্রাক্কলন ব্যয় দ্বিগুণ করার পাশাপাশি দরপত্রটি বাতিলের যৌক্তিকতাও তুলে ধরা হয়েছে।

নিয়মানুসারে প্রাক্কলন তৈরির ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয়ের সার্ভেয়ার (পরিমাপক) ব্রিজ পরিমাপ করবেন। এছাড়াও উপ-সহকারী প্রকৌশলী সরেজমিনে পরিদর্শনের পর প্রাক্কলন তৈরি করার কথা।

যোগাযোগ করা হলে আমতলী উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয়ের সার্ভেয়ার আবদুল কুদ্দুস বলেন, ব্রিজের দৈর্ঘ্য ও মাটি পরিমাপের কথা থাকলেও আমি কিছুই করিনি। প্রাক্কলন তৈরির পর আমাকে স্বাক্ষরের জন্য বলা হলেও আমি সরেজমিনে পরিদর্শন না করে স্বাক্ষর করবো না বলে জানিয়ে দেই। পরবর্তীতে কীভাবে প্রাক্কলন অনুমোদন করা হয়েছে তা আমার জানা নেই।

একই বক্তব্য উপ-সহকারী প্রকৌশলী নিজাম উদ্দিনের। তিনি বলেন, সরেজমিন পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দেয়ার পর প্রাক্কলন তৈরির নিয়ম থাকলেও আমি এসবের কিছুই করিনি। ঢাকা থেকেই প্রাক্কলন তৈরি ও অনুমোদন করা হয়েছে। এর বাইরে আমি কিছুই জানি না।

আমতলী উপজেলা প্রকৌশলী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, প্রধান প্রকৌশলী মহোদয়ের অনুমোদন ক্রমে প্রকল্প পরিচালক প্রকল্প তৈরি করেছেন। আমাকে যেভাবে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে আমি সেভাবেই বাস্তবায়ন করছি। প্রাক্কলনে আমার স্বাক্ষর নেই। কাগজপত্রে আমি আমার আগের প্রকৌশলীর স্বাক্ষর দেখেছি।

বরগুনা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) প্রধান নির্বাহী প্রকৌশলী ফোরকান আহমেদ খান বলেন, এই প্রকল্পের প্রাক্কলন তৈরি থেকে শুরু করে কোনো কাজেই জেলা পর্যায়ের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী সংশ্লিষ্ট নেই। এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলীর অনুমোদন ক্রমে সব কিছুই প্রকল্প পরিচালক নির্ধারণ করেছেন। বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমরা শুধুমাত্র নির্দেশনা অনুসরণকারী মাত্র।

এ বিষয়ে আইবিআরপি প্রকল্পের পরিচালক মো. আবদুল হাই বলেন, এ বিষয়ে আমি নিজেও জানি না। বরগুনা থেকে প্রাক্কলন পাঠানো হয়েছে এবং তা অনুমোদন করা হয়েছে। আমার মনে হয় এতো বড় ভুল হওয়ার কথা নয়। তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যেই আমরা সরেজমিনে তদন্তের জন্য কমিটি গঠন করেছি। অভিযোগের সত্যতা পেলে দরপত্র বাতিল করা হবে।

বরগুনার নির্বাহী প্রকৌশলীর বক্তব্য প্রসঙ্গে আবদুল হাই বলেন, তিনি হয়তো জানেন না বা এটা তার অজ্ঞতাজনিত বক্তব্য। নয়তো এমন কথা বলার কথা নয়।

তবে এ বিষয়ে এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী মো. আব্দুর রশীদ খানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

2 × five =