দেশে তথ্যপ্রযুক্তি জগতে নাজমুস সাকেব নাঈম পরিচিত একটি নাম। তার তৈরি করা পেখম ওয়েবসাইটটি অনলাইনে হোটেল বুকিংয়ের জন্য বিকাশ, সেবাসহ বিভিন্ন অনলাইন ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ। ফেসবুক-কমার্স বা এফ-কমার্সের জন্য গ্রহকসেবা সমাধান অর্থাৎ ফেসবুকের মাধ্যমে পণ্য কিনতে গ্রাহককে পুরো প্রক্রিয়ায় সহায়তার জন্য সাকেব উদ্ভাবিত চ্যাট বট ‘দ্য জেড বয়’ নিয়ে মার্কিন সাময়িকী এন্ট্রাপ্রেনার ও ফোর্বস–এ ২০১৭ সালে তার সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়।
সাকেব বেশ কয়েকটি দেশি–বিদেশি প্রতিষ্ঠানে তথ্যপ্রযুক্তিবিদ হিসেবে নানা পদে কাজ করেছেন। রীতিমতো এ জগতের তারকা খ্যাতিও মিলেছে তার। অথচ সেই তিনিই কি-না পাপুয়া নিউগিনিতে বসবাসরত আবদুল ওয়াহেদ নামে এক বাংলাদেশির ডেবিট কার্ড হ্যাক করে প্রায় তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন!
২০১৪ সালের ওই জালিয়াতির ঘটনায় পাপুয়া নিউগিনিতে অবস্থানরত বাংলাদেশি গত বছরের ডিসেম্বরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা দায়ের করেন।
তদন্তের প্রায় এক বছর পর হ্যাকিং ও জালিয়াতি-সংক্রান্ত নানা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে গত ২৫ আগস্ট সাকেব ও তার সহযোগী মইনুল ইসলাম মামুনকে মহাখালী ডিওএইচএস থেকে গ্রেফতার করে ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগ।
পরে আদালতের নির্দেশে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে সাকেবকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। রিমান্ড শেষে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. সাতারুজ্জামানের আদালতে হ্যাকিং ও জালিয়াতির বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন সাকেব।
তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গ্রেফতার নাজমুস সাকেব নাঈম যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞানে স্নাতক করেছেন। তিনি থাইল্যান্ডের সিয়াম ইউনিভার্সিটিতে অতিথি শিক্ষক হিসেবে কাজের পাশাপাশি নেপালের একটি ব্যাংকে পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন।
অন্যদিকে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ থেকে পড়াশুনা শেষ করে ১৯৮৮ সালে পাপুয়া নিউগিনিতে পাড়ি জমান বাদী আব্দুল ওয়াহেদ। সেখানে প্রথমে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত হলেও পরবর্তীতে শিক্ষকতা ছেড়ে ব্যবসা শুরু করেন তিনি।
ওয়াহেদ পাপুয়া নিউগিনির শীর্ষস্থানীয় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দেশ বেশ এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডের (Desh Besh Enterprises Ltd.) ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
প্রতিষ্ঠানটি সে দেশের সুপার মার্কেট, সুপার শপ চেইন, ফাস্ট ফুড অ্যান্ড বেকারি, রেস্টুরেন্ট চেইন, ফিলিং স্টেশন, ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড লজিস্টিকস, কনটেইনার ইয়ার্ড, অ্যাপার্টমেন্ট ইত্যাদি ব্যবসায় জড়িত।
২০০৭ সালে পাপুয়া নিউগিনির ব্যাংক সাউথ প্যাসিফিক লিমিটেডে ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট খুলে ভিসা ইন্টারন্যাশনাল ডেবিট কার্ড গ্রহণ করেন আব্দুল ওয়াহেদ। ২০১৪ সালের অক্টোবর মাসের শেষের দিকে ব্যবসায়িক কাজে সিঙ্গাপুরে যান। কাজ শেষে ফিরবেন বাংলাদেশে।
ব্যবসায়িক কাজ শেষে সিঙ্গাপুরের পার্ক রয়েল হোটেলের বিল পরিশোধ করতে হোটেলের পজ মেশিনে নিজের ভিসা কার্ড প্রবেশ করাতেই মেশিনের স্ক্রিনে ভেসে উঠে-‘ইওর কার্ড হ্যাস বিন রেসট্রিক্টেড। প্লিজ কনটাক্ট টু ইওর ব্যাংক।’ কয়েকবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন আব্দুল ওয়াহেদ।
পরে নিজের কাছে থাকা নগদ টাকা ও পরিচিতজনদের সহায়তায় পাপুয়া নিউগিনিতে ফিরে যান তিনি। যোগাযোগ করেন ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানায়, প্রতারণামূলক বৈদেশিক লেনদেন সন্দেহে তার ভিসা কার্ডটি রেসট্রিক্টেড করা হয়েছে।
তবে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এই লেনদেনের দায় আব্দুল ওয়াহেদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে জানায়, তিনি তার কোনো আত্মীয়/কর্মচারীকে কার্ডের তথ্য সরবরাহ করেছেন, যে তথ্য ব্যবহার করে ওই আত্মীয়/কর্মচারী ২০১৪ সালের ২১ জুলাই থেকে ২১ অক্টোবর পর্যন্ত তার ভিসা কার্ড ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, হংকং, চীন, থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশে অনলাইনে কেনাকাটা ও ভার্চুয়াল কার্ড ক্রয় করে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
ব্যাংকের এ দায়সারা বিবৃতি প্রত্যাখ্যান করেন আব্দুল ওয়াহেদ। ক্ষতিপূরণ দাবি করে পাপুয়া নিউগিনির ন্যাশনাল কোর্টে ব্যাংকটির বিরুদ্ধে মামলা করেন তিনি।
ব্যাংকটি ভুক্তভোগী ওয়াহেদের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ তোলে, আত্মীয়/কর্মচারীকে কার্ডের তথ্য পাচার করে আব্দুল ওয়াহেদ নিজেই দাবিকৃত টাকা খরচ করিয়ে ক্ষতিপূরণ দাবির পাশাপাশি ব্যাংকের সুনাম নষ্ট করেছেন।
ক্ষতিপূরণ আদায়ের পাশাপাশি ব্যাংকের অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণে আইনি লড়াই শুরু করে আব্দুল ওয়াহেদ। আইনজীবী পেটার বেসউইকের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, হংকং, চীন ও থাইল্যান্ডে তার কার্ড থেকে এই প্রতারণামূলক বৈদেশিক লেনদেনের বিষয়ে আইনগত সহায়তা প্রার্থনা করেন তিনি। তবে দেশগুলোর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও শীর্ষস্থানীয় আইনজীবীদের সঙ্গে সশরীরে যোগাযোগ করেও ব্যর্থ হন আব্দুল ওয়াহেদ।
ক্ষতিপূরণ আদায়ের পাশাপাশি ব্যাংকের অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণে দেশে দেশে ঘুরতে ঘুরতে বিপর্যস্ত আব্দুল ওয়াহেদ বাংলাদেশে ডিএমপির তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় গত বছরের ১০ অক্টোবর মামলা করেন। মামলা নম্বর ১৭।
গ্রেফতার সাকেব সম্পর্কে তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ‘ভিসা কার্ডটি হ্যাক করে কার্ডের গোপন তথ্য চুরি করা হয়েছে। হ্যাকড ভিসা কার্ডটি দিয়ে ২০১৪ সালের ২১ জুলাই দ্যলোডনেট ডটকমে (Theloadnet.com) প্রথম ১৪.৯৫ মার্কিন ডলার বিল পরিশোধ করেন। সর্বশেষ ২০১৪ সালের ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত নিজের Entropay অ্যাকাউন্টে ভার্চুয়াল ভিসা কার্ড জেনারেট করে ২০৯৯ মার্কিন ডলার ট্রান্সফার করে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন সাকেব।
তিনি আরও বলেন, হ্যাকড ভিসা কার্ডটি ব্যবহার করে প্রথমদিকে দেশীয় কিছু অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে প্ল্যাটফর্মে ১৬টি দামি মোবাইল কিনে আত্নীয়-স্বজন ও পরিচিত জনদেরকে উপহার দেন সাকেব। ২০১৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর থাই এয়ারওয়েজে স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, শ্যালিকা ও শাশুড়িকে নিয়ে যান থাইল্যান্ডে।
সাকেব তার Entropay অ্যাকাউন্টে ভার্চুয়াল ভিসা কার্ড জেনারেট করে হ্যাকড ভিসা কার্ড থেকে ব্যালেন্স ট্রান্সফার করেন। সেই ভার্চুয়াল কার্ড ব্যবহার করে অনলাইনে থাই এয়ারওয়েজের টিকিট কিনে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ব্যাংকক যান।
পুলিশ জানায়, পরিবারের সদস্যরা বিলাসবহুল হোটেলের অবস্থানের পাশাপাশি শপিং ও ঘোরাঘুরিতে ব্যস্ত থাকলেও হোটেল রুম থেকে বের হননি সাকেব। হ্যাকড কার্ড ব্যবহার করে অনলাইন শপিংয়ে ব্যস্ত সময় কাটে তার। অনলাইনে একদিনে ১০০টির বেশি লেনদেনও করেন তিনি।
নিজেকে ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখতে ২০১৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর অনলাইনে থাই এয়ারওয়েজে ব্যাংকক এবং ওই বছরের ১ নভেম্বর এমিরেটস এয়ারলাইন্সে ঢাকা থেকে দুবাই হয়ে ব্যাংককে যাওয়ার জন্য বিজনেস ক্লাসে পরিবারের সদস্যদের টিকিট কনফার্ম করলেও ভ্রমণ করেননি সাকেব বা তার পরিবারের কেউ।
তেজগাঁওয়ের ডিসি হারুন অর রশীদ আরও জানান, ২০১৪ সালের ২৪ জুলাই থেকে ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত ৮০ দিনে বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডে অবস্থান করে সাকেব তার Entropay অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে দুটি ভার্চুয়াল ভিসা কার্ড (Bank of Valletta, Malta) জেনারেট করে হ্যাককৃত ভিসা কার্ড থেকে বিল পরিশোধের মাধ্যমে ৬৯ বারে ৯৮৪৫৯.৩৬ মার্কিন ডলার এবং একই বছরের ২৮ জুলাই থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত Netelleruk অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে ভার্চুয়াল ভিসা কার্ড জেনারেট করে সাত বারে ৯৮১.২৮ মার্কিন ডলার হাতিয়ে নেন।
২০১৪ সালের ২০ জুলাই থেকে পরের বছর ২০১৫ সালের ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ৮টি চেকআউটের মাধ্যমে ৩৪ লাখ ৯৩ হাজার ১২০ টাকা সাকেবের অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করা হয়।
বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডে অবস্থান করে হ্যাককৃত ভিসা কার্ড ব্যবহার করে অনলাইনে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, হংকং, চীন ও থাইল্যান্ডে বিভিন্ন দামি সফটওয়্যার, অ্যাপলের ম্যাকবুক, আইফোন, রোলেক্স ঘড়ি, ক্লিভ ক্রিশ্চিয়ান ব্র্যান্ডের পারফিউম, ক্যামেরা, ওয়ালেট, কসমেটিকস কেনেন সাকেব।