কুয়াকাটায় দুই বছর আগের হত্যার লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয় সাগরে

0
483

আশুলিয়ার বিউটি পার্লারের মালিক মার্জিয়া কান্তার খুনের রহস্য

আনোয়ার হোসেন আনু, কুয়াকাটা (পটুয়াখালী) থেকে\ ঢাকার আশুলিয়ায় কান্তা বিউটি পার্লারের মালিক মার্জিয়া কান্তাকে (২৬) কুয়াকাটায় আবাসিক হোটেল আল মদিনার কক্ষে গলা টিপে হত্যার প্রায় দুই বছর পর পিবিআই’র তদন্তে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।

স্বামী ও তার এক সহযোগী কান্তাকে নিয়ে ওই হোটেলে পর্যটক হিসেবে ওঠার পর কোন এক সময় তাকে হত্যা করে পলিথিনে লাশ মুড়িয়ে খাটের নিচে রেখে দুই খুনি পালিয়ে যায়। এরপর হোটেল কর্তৃপক্ষের নজরে এলে তারা ঝামেলা এড়াতে রাতের অন্ধকারে কান্তার লাশ বস্তায় ভরে মোটর সাইকেলের পেছনে তুলে নিয়ে সাগরে ভাসিয়ে দেয়।

এভাবে ঘটনাটি আবাসিক হোটেল কর্তৃপক্ষের ধামাচাপা দেবার অপচেষ্টা এবং খুনিরা এতদিন ধরা ছোয়ার বাইরে থাকলেও পিবিআইর তদন্তে বিস্তারিত বেরিয়ে এসেছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নরসিংদী জেলার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ইন্সপেক্টর মোঃ মনিরুজ্জামান সাংবাদিকদের জানান, বেলাবো থানার নরসিংদী জেলার সোহরাব হোসেন রতনের মেয়ে মার্জিয়া আক্তার কান্তা ঢাকার আশুলিয়ায় বিউটি পার্লারের ব্যবসা করতেন।

সেখানে কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারীর শহিদুল ইসলাম সাগরের সাথে পরিচয়ের সূত্রে দুই লাখ টাকার কাবিননামায় মুসলিম শরীয়ত অনুযায়ী তাদের বিয়ে হয়। বিয়ের কিছু দিন পর মার্জিয়া কান্তা জানতে পারে তার স্বামী শহিদুল ইসলাম সাগরের আরও এক স্ত্রী রয়েছে। বিষয়টি গোপন করে তাকে বিয়ে করায় সহজে মেনে নিতে পারছিল না কান্তা।

এ নিয়ে তার ব্যক্তিগত ফেসবুক স্ট্যাটাসে স্বামী শহিদুল ইসলাম সাগরকে প্রতারক লম্পট হিসেবে তুলে ধরাই কাল হলো কান্তার জীবনে। এ ঘটনায় কৌশলের আশ্রয় নেয় আগের বিয়ে গোপন করা প্রতারক স্বামী শহিদুল ইসলাম সাগর। ভালবাসার অভিনয় করে ভারতে বেড়াতে নিয়ে যাবার কথা বলে দ্বিতীয় স্ত্রী মার্জিয়া কান্তার মনজয়ের চেষ্টা করে সফলও হয় স্বামী সাগর।

এরপর ২০১৮ সালের ২১ সেপ্টেম্বর আশুলিয়া থেকে স্বামী-স্ত্রী প্রথমে শরীয়তপুরে আবাসিক হোটেল নূর ইন্টারন্যাশনালে এসে রাত কাটায়। সেখানে স্বামী শহিদুলের মামাত ভাই মামুন এসে তাদের সাথে যুক্ত হয়। এর পরদিন তারা শরীয়তপুর থেকে কুয়াকাটার উদ্দেশ্যে এসে আবাসিক হোটেল আল মদিনার বি-১ নম্বর কক্ষে ওঠেন তারা। ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ বিকেলেও ওই হোটেল কক্ষে তালা ঝুলতে দেখে কোন সাড়াশব্দ না পাওয়ায় হোটেল কর্তৃপক্ষের সন্দেহ হলে মহিপুর থানা পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ এসে কান্তার ব্যবহৃত জামাকাপড় জব্দ করে নিয়ে গেলেও বক্স খাটের নিচে লাশ থাকার বিষয়টি তাদের নজরে আসেনি।

এর দুই তিন দিন পর ওই কক্ষ থেকে দুর্গন্ধ বেরুলে হোটেল ম্যানেজার আমির এবং হোটেল বয় সাইফুলের নজরে এলে তারা হোটেল মালিক দেলোয়ারকে জানায়। এরপর দেলোয়ার ও তার ছোট ভাই আনোয়ার এবং ম্যানেজার আমির ও বয় সাইফুল চারজনে মিলে হত্যার আলামত নষ্ট করে লাশ গুমের সিদ্ধান্ত নেয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী রাত এগারটার দিকে বস্তায় ভরে মোটরসাইকেলের পেছনে তুলে দোলোয়ার ও আনোয়ার কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের পশ্চিম দিকে লেম্বুরচর এলাকায় আন্ধার মানিক নদী মোহনায় নিয়ে যায়। সেখানে গলাসমান সাগরের পানিতে নেমে লাশ ভাসিয়ে দিয়ে দুইভাই হোটেলে ফিরে আসে। এরপর তারা এবিষয়টি নিয়ে আর কোথাও মুখ খোলেনি।


এঘটনার প্রায় একবছর পর নরসিংদী নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদালতে স্বামী শহিদুল ইসলাম সাগরসহ তার পরিবারের পাঁচজনের নাম উল্লেখ করে হতভাগ্য মার্জিয়া কন্তার বাবা সোহরাব হোসেন রতন বাদী হয়ে গত ৩১ জানুয়ারি ২০১৯ হত্যা করে লাশ গুমের মামলা দায়ের করে।

মামলাটি আদালত আমলে নিয়ে নরসিংদীর বেলাবো থানায় এজাহার হিসেবে গণ্যকরে তদন্তের নির্দেশ দেয়। পরবর্তিতে আদালতের নির্দেশে পিবিআই মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব গ্রহণ করে। অভিযুক্ত স্বামী শহিদুল ইসলাম সাগরকে গ্রেফতারের পর তদন্তের হালে পানি পায়। এরপর সহযোগী অপর খুনি মামাত ভাই মামুন পিবিআইর জালে চলতি বছর ১ সেপ্টেম্বর ধরা পড়লে তদন্তের আরও গতি পায়। মামুনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী তাকে নিয়ে পিবিআই কুয়াকাটার আবাসিক হোটেল আল-মদিনায় বৃহস্পতিবার (৩ সেপ্টেম্বর) অভিযানে গেলে খুব সহজেই হোটেল মালিক দোলোয়ার ও তার ছোট ভাই আনোয়ার ও হোটেল ম্যানেজার এবং বয় মার্জিয়া কান্তার লাশ গুমের সত্যতা স্বীকার করলে তাদের গ্রেফতার করা হয়। এরপর কুয়াকাটা থেকে তাদের চারজনকে নরসিংদী নিয়ে যায় পিবিআই।


মামলার তদন্তের বিস্তারিত অগ্রগতি তুলে ধরে পিবিআই তাদের নরসিংদী কার্যালয়ে শনিবার (৫ সেপ্টেম্বর) বিকেলে একটি সংবাদ সম্মেলন করেছে। গ্রেফতারকৃতরা হত্যাকান্ড ও লাশ গুমের সত্যতা স্বীকার করেছে বলে এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নরসিংদী পিবিআইর পরিদর্শক মোঃ মনিরুজ্জামান গ্রেফতারকৃতদের আদালতে সোপর্দ করার কথা জানিয়েছেন।

মহিপুর থানার ওসি মোঃ মনিরুজ্জামান বলেন, হোটেলে অবস্থানকারীরা ভাড়া পরিশোধ না করেই তাদের ব্যবহৃত কিছু জামাকাপড় রেখে পালিয়েছে মর্মে হোটেল আল মদিনার পক্ষ থেকে পুলিশকে জানানো হয়। পুলিশ ওইসব ব্যবহৃত জামাকাপড় তখন জব্দ করে থানায় রাখে। পরবর্তীতে খাটের নিচে লাশ পাওয়ার বিষয়টি পুলিশকে না জানিয়ে হোটেল মালিক ও কর্মচারীরা আলামত নষ্ট করে লাশ গুম করে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

one × five =