দুমকিতে “ভিটি আছে ঘর নেই”

0
434

পটুয়াখালী প্রতিনিধি: পটুয়াখালীর দুমকিতে প্রকল্প-২ আওতায় “ভিটি আছে ঘর নেই” এমন হতদরিদ্র গৃহহীন অসহায় পরিবারকে সরকারী বরাদ্দে ঘর নির্মাণ করে দেয়ার তালিকা প্রণয়নে সীমাহীন অনিয়ম-দূর্ণীতি ও অর্থ বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠেছে।

প্রকল্পের শর্তভঙ্গ করে অনৈতিক সুবিধা গ্রহনে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি দুষ্টচক্র তৃণমূলের কতিপয় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, জনপ্রতিনিধি ( ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্য) এবং কতিপয় চিহ্নিত দালালের মাধ্যমে হাজার হাজার টাকা লেনদেনে স্বচ্ছল পরিবারকে অসচ্ছল দেখিয়ে তালিকায় নাম অন্তভর্‚ক্ত করা হয়েছে।

এতে প্রকৃত অসচ্ছল গৃহহীন পরিবারগুলো তাদের ন্যয্য প্রাপ্তি (সরকারি বরাদ্দের ঘর) সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আর অর্থ-বিত্ত, রাজনৈতিক প্রভাবে অস্বচ্ছল পরিবারগুলোর সহজ প্রাপ্যতা ব্যহত করে অপেক্ষাকৃত ধনী ও সম্পদশালীরা প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত সরকারি বরাদ্দের ঘর নির্মাণ তালিকায় তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করিয়ে নিয়েছে।


তথ্যানুসন্ধানে জানাগেছে, প্রকল্প-২’র আওতায় স্থানীয় প্রশাসন প্রণীত তালিকায় দুমকি উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের তিনশতাধিক গৃহহীন অসচ্ছল পরিবারকে সরকারী বরাদ্দে বসত:ঘর নির্মাণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। দুমকি উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভ‚মি) আল-ইমরান, লেবুখালী ইউনিয়ন ভ‚মি কর্মকর্তা (তহসিলদার) মো: সেলিম ও সার্ভেয়ার মো: মজিবুর রহমান স্বাক্ষরিত তালিকাটি জেলা প্রশাসকের মাধ্যামে মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে।

প্রেরিত তালিকার দু’তৃতীয়াংশই স্বচ্ছল পরিবার এবং প্রত্যেকেরই বসবাসের উপযুগী পাকা, আধাপাকা ও টিনশেডের বসত:ঘর থাকার অভিযোগ ওঠেছে। একই পরিবারের একাধিক সদস্যর নামও ওই তালিকায় রয়েছে। এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা না হলেও পিত্রালয়ের ঠিকানা ব্যবহার করে এ তালিকায় নাম ওঠানো হয়েছে। কেউ কেউ অঢেল ধনসম্পদের মালিক হলেও ছেলে-মেয়ের নামে সরকারী বরাদ্দের পাকা ঘর পাওয়ার লোভ সামলাতে পারেননি।

চিহ্নিত দালালচক্রের মাধ্যমে ২০/২৫ হাজার ক্ষেত্র বিশেষে আরও বেশী টাকা লেনদেনে জড়াজীর্ণ গোয়ালঘর কিম্বা পাকের ঘরের ছবি দেখিয়ে ওই তালিকায় নাম দেয়া হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, উজেলা ভ‚মি অফিসের সার্ভেয়ার, এসিল্যান্ডের গাড়ী চালক ও একজন অফিস সহায়কের সমন্বয়ে উপজেলার ৫ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধি, দলীয় নেতা-কর্মী ও চিহ্নিত কয়েকজন দালাল চক্র অনৈতিক আর্থিক সুবিধা নিয়ে এমন একটি বিতর্কিত তালিকাটি তৈরী করেছেন।


উপজেলার শ্রীরামপুর ইউনিয়নের চরবয়েড়া গ্রামের বাসিন্দা শুকুর আলী হাওলাদারের সহায়সম্বলহীন স্ত্রী রাজিয়া বেগম অভিযোগ করেন, সরকারী অর্থে বসত:ঘর পাওয়ার আশায় উপজেলা ভ‚মি অফিসে আবেদন করলেও কোন ফল হয়নি। এসিল্যান্ড সাহেব দরখাস্ত দিতে বললেন। কিন্ত অফিস কর্মচারীরা ঘর পেতে নগদ ২০হাজার টাকা দাবি করেন। গরিব মানুষ, টাকা দিতে পারি নাই বলে তার নাম ওই তালিকায় ওঠানো হয় নাই।

একই এলাকার মৃত আ: খালেক হওলাদারের ছেলে বাবুল হাওলাদার, মুরাদিয়া ইউনিয়নের সন্তোষদির আলী হোসেন শরীফের ছেলে মিজানুর শরীফ, একই গ্রামের মোতালেব ফকিরের ছেলে রিপন ফকির জানায়, বসবাসের উপযুগি ঘর না থাকলেও আমাদের নাম ঘরের তালিকায় আসেনি। নগদ টাকা দিতে না পারায় নাম দেয়া হয়নি। ভ‚মি অফিসের অফিস সহায়ক মনিরসহ একটি চক্র প্রতিটি নামের বিপরীতে ২০/২৫হাজার টাকা ঘুষ নিয়ে তাদের নাম দিয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে চরবয়েড়া গ্রামের জনৈক বাসিন্দা অভিযোগ করে জানান, প্রণীত তালিকায় একাধিক ব্যক্তির নাম রয়েছে যারা স্বচ্ছল ব্যক্তি এবং তাদের দালান কোঠার মালিক। টাকার বিনিময়ে একই পরিবারের দু’তিনজনের নামেও সরকারী ঘর পাওয়ার তালিকায় ঢুকানো হয়েছে। তিনি প্রশ্ন করেন, তালিকার ১৩৪ নং ক্রমিকের মো: সেলিম সিকদার একজন ধনী লোক। ৫/৬একর জমির মালিক। তার নাম কিভাবে তালিকায় ঢুকলো? ক্রমিক নং ৬৩,৬৯ ও ৭০নং ক্রমিকের কামরুল হাওলাদার, ফাতেমা বেগম ও মোসা: কুলসুম একই পরিবারের সন্তান। সম্পর্কে পরস্পর ভাইবোন।

একই পরিবারের ৩জনের নাম তালিকা ভুক্ত হওয়ার নেপত্থ্যে অর্ধলক্ষাধিক টাকার ঘুষ লেনদেন হয়েছে। তালিকার ৩২নং ক্রমিকে চরবয়েড়া গ্রামের মৃত মন্নান খানের স্ত্রী আমেনা বেগমের নাম দেয়া হয়েছে। অথচ এর একবছর পূর্বে ছেলে হেলাল খানের নামে সরকারী বরাদ্দের একটি ঘর নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে। মা-ছেলে একান্নভুক্ত পরিবার। এছাড়া ১৬নং ক্রমিকে সালমা বেগম এবং ৭২নং ক্রমিকে নাদিরা বেগম উভয় পিতা দেলোয়ার হোসেন সচ্ছল পরিবারের সদস্য। এভাবে শুধুমাত্র শ্রীরামপুর বা মুরাদিয়ায় নয়, পুরো উপজেলার ৫ইউনিয়নের তালিকা প্রণয়নেই ঘুষ লেনদেনে প্রকল্পের শর্তভঙ্গ করে ন্যাহ্য প্রাপ্যদের বঞ্চিত করে অপেক্ষাকৃত বিত্তবানদের নামে সরকারী ঘর বরাদ্দের ব্যবস্থা হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানাযায়, উজেলা ভ‚মি অফিসের সহকারী কমিশনার (এসিল্যান্ড) মো: আল-ইমরাণ’র নির্দেশে সার্ভেয়ার মজিবুর রহমান, এসিল্যান্ডের গাড়ী চালক রাব্বি ও অফিস সহায়ক মনিরুজ্জামান সমন্বয়ে গঠিত একটি চক্র এসিল্যান্ডের বিশ্বস্ততার সুযোগে উপজেলার ৫ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধি, ক্ষমতাসীন আ’লীগের ইউনিয়ন ও ইউনিট কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ চিহ্নিত কয়েকজন দালাল চক্র প্রতিটি ইউনিয়নের হতদরিদ্রদের নাম সংগ্রহ করে তালিকা প্রণয়ন করেছেন।


অভিযোগ অস্বীকার করে লেবুখালী ইউনিয়ন ভ‚মি অফিসের সহকারী ভ‚মি কর্মকর্তা (তহশিলদার) মো: সেলিম জানান, তালিকা তৈরীতে আমার কোন ভ‚মিকা নেই। তৈরী করা তালিকায় (এসিল্যান্ড) স্যারের নির্দেশে স্বাক্ষর করেছি মাত্র। তবে তালিকায় কাদের নাম দিয়েছে বা দেয় নাই তা আমি কিছুই জানিনা। উপজেলা সার্ভেয়ার মজিবর রহমান বলেন, এসিল্যান্ড স্যারের নির্দেশে কাজ করেছি। কারো নাম দেয়া বা না দেয়ায় আমার কোন এখতিয়ার নেই। কারো কাছ থেকে টাকা পয়সা নেয়ার প্রশ্নই ওঠেনা। উপজেলা ভ‚মি অফিসের অফিস সহায়ক মো: মনিরুজ্জামান অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, নাম দেয়ার ক্ষমতা স্যারের (এসিল্যান্ড), আমার কাছে কেউ পরামর্শ চাইলে সব সময়ই স্যারের সাথে যোগাযোগ করতে পরামর্শ দিয়েছি। অমার সাথে কারো কোন ধরণের লেনদেন হয়নি। গাড়ী চালক রাব্বি জানান, আমি চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী, ঘর দেয়া না দেয়ার বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।


মুরাদিয়া ইউপি চেয়ারম্যান মো: জাফর উল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেন, সরকারী খরচে ঘর বরাদ্দের তালিকা ভ‚মি অফিস করেছে। আমার ইউনিয়ন থেকে তালিকা চেয়েছিল। ৭৫জনের একটি তালিকা জমাও দিয়েছিলাম। কিন্ত চুড়ান্ত তালিকায় মাত্র ৭/৮টি নাম আছে, বাকীদের নাম বাদ গেছে। কেন কিভাবে এবং কেইবা বাদ দিল তা এখনও জানি না। শ্রীরামপুর ইউপি চেয়ারম্যান মো: আমিনুল ইসলাম সালাম জানান, ঘর বরাদ্দের তালিকা নিয়ে ভ‚মি অফিস কেন এমন তুঘলোকী কান্ড করলো তা আমার বোধগম্য নয়। তবে শুনেছি কেউ কেউ বাণিজ্য করেছে। কে বা কারা ঘর বাণিজ্যে জড়িত এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, উপজেলা পরিষদ, প্রশাসন ও ভ‚মি অফিস সমন্বয়ে তালিকা তৈরী হয়েছে, এর সাথে দলীয় কতিপয় নেতা-কর্মীরা জড়িত ছিল।


উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভ‚মি) আল ইমরান বলেন, প্রকল্পের বিধি বিধান অনুসরণেই তালিকা তৈরী করা হয়েছে। তবে এসে উপজেলা পরিষদ, উপজেলা প্রশসন, ইউপি চেয়ারমানরা ছাড়াও রাজনৈতিক সুপারিশ বিবেচনা করতে হয়েছে। বিশেষত: করোনাকালীন দূর্যোগের কারনে শতভাগ যাছাই-বাছাই সম্ভব হয়নি। এতে দু’একটি ভুল ত্রটি থাকতে পারে। আর্থিক লেনদেন প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমার জানা নেই, এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কেউ কারো বিরুদ্ধে আমার কাছে কোন অভিযোগ করেনি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে খতিয়ে দেখা হবে এবং অভিযুক্তের প্রমান পেলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।


উপজেলা নির্বাহী অফিসার শঙ্কর কুমার বিশ্বাস বলেন প্রকল্প-২’র ঘর বিতরণ তালিকা তৈরীর বিষয়টি আমি অবগত। তালিকা তৈরীতে উপজেলা চেয়ারম্যান, বিভিন্ন ইউপি চেয়ারম্যানবৃন্দ ও কিছু রাজনৈতিক সুপারিশ ছিল। করোনা পরিস্থিতির কারনে ইচ্ছা থাকা সত্তে¡ও শতভাগ যাছাই করা সম্ভব হয়নি। দু’একটা ত্রটি থাকলে বা বের হয়ে তা বাতিল করা যাবে। টাকা আদায় প্রশ্নে বলেন, সুনির্দিষ্ট প্রমান পেলে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে কঠর ব্যবস্থা নেয়া হবে।


উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এড. হারুন অর রশিদ হাওলাদার এ প্রসঙ্গে বলেন, জনপ্রতিনিধি এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিরা সুপারিশ করবে-এটা স্বাভাবিক ঘটনা। আমিও সুপারিশ করেছি। কিন্ত সুপারিশ বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ বিধি বিধানে পারমিট করলে তা রাখবেন, না রাখলে তো সমস্যা নেই। সুপারিশ আমলে নেয়া-না নেয়ার এখতিয়ার তাদের। নিয়ম বহির্ভূত কাজ করলে তার দায় তাদের (তালিকা প্রনয়নকারী) এবং জবাবদিহিও তারা করতে বাধ্য।


উল্লেখ্য যে, ১ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখে জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত “দৈনিক গনজাগরন” “দৈনিক গণকন্ঠ” “দৈনিক নাগরিক সময়” “বরিশাল প্রতিদিন” “দৈনিক মানবজমিন”সহ অনলাইন পোর্টাল “দি বরিশাল” “দৈনিক কালজয়ী” “পিবিএ এজেন্সি” ২ সেপ্টেম্বর অনলাইন “আজকালের কন্ঠ” ৩ সেপ্টেম্বর “দৈনিক দেশ রূপান্ত” ৪ সেপ্টেম্বর “দৈনিক যুগান্তর” ৫ সেপ্টেম্বও “দৈনিক আমার সংবাদ” দুমকিতে “ভিটি আছে ঘর নেই” তালিকা প্রণয়নে অনিয়ম-দূর্ণীতি সহ বিভিন্ন শিরোনামে নিউজ প্রকাশিত হয়েছে

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

two × two =