ঈমান-কুফর সীমান্ত | বাংলা ইসলামিক লেখা পোস্ট | ঈমান নিয়ে ইসলামিক আলোচনা

0
728

স্মৃতি থেকে লিখছি। রেফারেন্স চাহিয়া কষ্ট দিবেন না। ভুলচুক জ্ঞানীরা ধরিয়ে দেবেন।

আট-দশ হাজার বছর আগে কিংবা তারও আগে। এশিয়া মাইনর (তুর্কি মুলুক ও আশপাশ) থেকে আর্যরা (Aryans) দেশত্যাগ করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। কারণ নির্দিষ্ট জানা যায় না। দুর্ভিক্ষ, অন্তর্কলহ, দুর্যোগ সবই লিস্টে আছে। পুরাণগুলোর (mythology) চরিত্রগুলোর মাঝে দারুণ মিল প্রমাণ করে, এগুলোর উৎস কমন। নর্স পুরাণে দেবরাজ থর, গ্রীক পুরাণে দেবরাজ জিউস (রোমানে জুপিটার), হিন্দু পুরাণে দেবরাজ ইন্দ্র সবাই শাস্তি দেন বজ্রনিক্ষেপ করে। সংস্কৃত-গ্রীক ভাষার মধ্যেও আছে দারুণ সব মিল। আদি আর্যরা ছিল প্যাগান, শক্তির উপাসক, প্রকৃতিপূজারী। আগুন-পানি-বাতাস-বজ্র ইত্যাদি প্রাকৃতিক শক্তির পূজা করত। ধীরে ধীরে শক্তিগুলোকেই মানবরূপে পূজা শুরু হয়। আগুনের দেবতা, পানির দেবতা, বাতাসের দেবতা।

তো আর্যদের একটা অংশ চলে এলো বর্তমান ইরানে। ভাষা নৃতত্ত্বে এসবের আলোচনাগুলো খুব ইন্টারেস্টিং, যেন চোখের সামনে ভাসে। ইরানী আর্যদের একটা অংশ চলে আসে ভারতে, সিন্ধু এলাকায়। এজন্য প্রাচীন পার্সী ‘যেন্দ’ ভাষা আর সংস্কৃত ভাষার মধ্যেও প্রচুর মিল, ধর্মীয় টার্মগুলোতেও। যেন্দ Yasna আর সংস্কৃত Yajna (যজ্ঞ) হিন্দুদের ধর্মানুষ্ঠান, এমন আরও আছে। আর্যরা যেসময় শক্তির পূজা করত মানবরূপ ছাড়া, সেসময় ভারতে বসবাসরত ভূমিপুত্র ছিল অস্ট্রালয়েড দ্রাবিড়রা। আর্যরা ছিল ককেশীয়, ফর্সা, খাড়া নাক। আর্যরাও ভূমিপুত্র না। পয়েন্ট রাইখেন। তো, দ্রাবিড়ীয়রা স্থানীয় দেবদেবীর পূজা করত, মানবাকারে। আর্যরা এসে কালে কালে তাদের উপাস্য শক্তিগুলোকে মানবরূপে পূজা আরম্ভ করে।

প্রাচীন দুনিয়ায় এই সিন্ধুনদ ছিল ভারতের ল্যান্ডমার্ক। নদীটা দিয়েই এলাকা চিনতো বাকি দুনিয়া। পার্সী আর্যরা চিনত তাদের জ্ঞাতিগুষ্টি কই থাকে? সিন্ধ এলাকায়। প্রাচীন ফার্সিতে সিন্ধকে বলা হত হিন্দ। সেই কানেকশনে সেমিটিক জাতিরাও বলত হিন্দ। ল্যান্ডমার্কের সুবাদে পুরো ভারতবর্ষই পরিচিত ছিল হিন্দ নামে। আরবরাও বলত হিন্দ। পুরো দুনিয়াই এই ভারতবাসীকে ডাকত হিন্দী বা হিন্দু। যদিও ধর্মবিশ্বাসে কেউ আর্য, কেউ দ্রাবিড় প্যাগান, কেউ বৌদ্ধ। একটা ভৌগোলিক পরিচয়। যেমনটা কেউ চিটাগাইঙ্গা বা সিলোটী বা বইঙ্গা, ধর্ম নির্বিশেষে। পরবর্তীতে যখন আলেক্সাণ্ডার থেকে নিয়ে মুসলিমরা যত বহিরাগতরা এসেছে সবাই ভারতীয়দের হিন্দু নামেই চিনেছে। এবং এইসব যবন-ম্লেচ্ছ (অপিরিচিত, বিদেশী) দের বিপরীতে ভারতবাসীরাও নিজেদের ‘হিন্দু’ বলে জেনেছে। তুমি ম্লেচ্ছ, আমি হিন্দু। আমি বেদ-বিশ্বাসীই হই, আর বৌদ্ধই হই, আর তামিল প্যাগানই হই, তোমার বিপরীতে আমি হিন্দু। বুইঝেন, পাক আর্মির বিপরীতে হিন্দু-মুসলিম-খৃষ্টান নির্বিশেষে সবাই বাঙালি।

সুতরাং হিন্দু ধর্ম যতটা না ধর্মবিশ্বাস, তার চেয়ে বেশি জাতীয়তাবাদ। এটা একক ধর্ম নয়, অনেক ধর্মের সমষ্টি, একই ভূমির সূত্রে। নির্দিষ্ট কোনো বিশ্বাসকেন্দ্রিক নয়। বিচিত্র আকীদার সমন্বয়ে এক প্রাকৃতিক জাতীয়তা। তোমার বিশ্বাস যাই হোক, এ অঞ্চলে তোমার জন্ম মানে তুমি হিন্দু। সে তুমি শৈব হও (শিবপূজা), শাক্ত হও (কালীপূজা), বৈষ্ণব হও (বিষ্ণুপূজা), গাণপত্য হও (গণেশপূজা), ব্রাহ্ম হও (নিরাকার ব্রহ্মপূজা), প্রেতপূজারী তান্ত্রিক হও, আর নাস্তিক কম্যুনিস্টই হও– কিচ্ছু যায় আসে না। এমনকি প্যাগান দ্রাবিড়দের বহু দেবদেবীর অর্চনাও হিন্দুসমাজে প্রচলিত আছে বা ছিল। শ্মশানকালী, রক্ষাকালী প্রভৃতি নামে বহু অনার্য দেবীর বেদীতে বৃটিশ আমল পর্যন্ত প্রাচীন প্যাগান অনার্য রীতিমত নরবলিও হত। এমনকি বুদ্ধকেও আত্মীকরণ করে নিয়েছে হিন্দুধর্ম বিষ্ণুর ‘বুদ্ধাবতার’ হিসেবে। সে হিসেবে বৌদ্ধরাও হিন্দু, যেহেতু বিষ্ণুরই উপাসনা করে। এতদাঞ্চলে পূজিত সব দেবদেবীকে আত্মস্থ করে নিয়েছে হিন্দুধর্ম। তোমার আকীদা যাই হোক তুমি হিন্দু। ব্যাপারটা আরও গোছানো স্পষ্টরূপ ধারণ করে সাভারকার-এর ‘হিন্দুত্ব’ কনসেপ্টে, যার ভিত্তিতে ভারতে ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হচ্ছে।

যে কারণে কথাগুলো বললাম। ইসলাম এমন না। যার যা বিশ্বাস-আকীদা সবকিছুকে ইসলাম ধারণ করবে, মুসলিম বলে ছাপ্পড় মেরে দেবে, বয়াপারটা এমন না। কাদিয়ানিদের কাফের ঘোষণা নিয়ে এক টকশোতে এক বুদ্ধিবিক্রেতা বলেছিলেন: হিন্দুদের মত মুসলিমদেরও এক বৃহত্তর মুসলিম ঐক্য করা উচিত। সুন্নী, কাদিয়ানী, শিয়া, ওয়াহাবী সবাই বৃহৎ ঐক্য গড়া; হিন্দুদের মত। খুব দুঃখের কথা, আজ আরবি নামধারী বাদ দেন, যারা বিভিন্ন দলে-উপদলে ভাগ হয়ে ইসলাম প্র্যাক্টিসিং বলে দাবি করছি, আমাদেরই ইসলাম সম্পর্কে ধারণা নেই। শুনতে খারাপ শোনা গেলেও এটাই সত্যি। এবং আরও কষ্টের কথা হল সম্মানিত আলিমগণও ‘ইসলামের সীমানা’ আইমিন ‘ঈমান-কুফরের সীমান্ত’ নিয়ে আলোচনার চেয়ে আরেক গ্রুপের মুণ্ডুপাতকেই জরুরি হিসেবে নিয়েছেন। আমি আগে মনে করতাম, সবাই তো মুসলমানই। শুধু সালাফীরাই ঈমান-কুফর-শিরক-তাওহীদ এগুলা নিয়ে বেশি মাতামাতি করে। কিন্তু আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী রাহিমাহুল্লাহর ‘ইকফারুল মুলহিদীন’ পড়ার পর আমি আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, বরং হানাফী মত কিছু ক্ষেত্রে ডিমার্কেশনটা আরও স্পষ্ট ও প্রবলভাবে ধারণ করে। তাহলে কেন এর চর্চা নেই, কেন এগুলোর বয়ান নেই। ওজুভঙ্গের বয়ান হচ্ছে, অমুক-তমুকের খণ্ডন হচ্ছে। ঈমানভঙ্গের কারণগুলো এতো সুস্পষ্ট থাকা সত্ত্বেও কেন এগুলো আম পাবলিককে জানানো হবে না। এগুলো তো আম মুসলিমকে মুখস্ত করিয়ে দেয়া উচিত যেমন ওজু-নামায ভঙ্গের কারণ মুখস্ত করানো হয়। সচেতন তরুণ আলিমগণের প্রতি আরজ, ‘ইকফারুল মুলহিদীন’, ‘নাওয়াকিদুল ঈমান ও শরাহ’ গুলোর সমন্বয়ে সহজভাষায় একটা ‘কিতাবুল ঈমান’ তৈরি করার দরখোয়াস্ত, যেটা বেহেশতী জেওরের মত ঘরে ঘরে তালিম হবে।

‘হিন্দু’ ধর্ম যেমন স্থানীয় সীমারেখায় পরম্পরাগত আদি প্রথা-পার্বণ-দর্শন-আচার ভিত্তিক, আকীদা যা-ই হোক। ইসলাম হল উল্টোটা। সম্পূর্ণ আকীদাভিত্তিক, জাতি-বর্ণ-স্থান-কাল যাই হোক। যেকোন জাতিসত্তা, যেকোন বর্ণের, যেকোন স্থানের, যেকোনো যুগের যে কেউ যদি নির্দিষ্ট কিছু আকীদা/বিশ্বাস ধারণ করে, সেগুলোর সামনে নিজেকে সমর্পণ করে, এবং মান্য করতে তৈরি হয়ে যায়, সে মুসলিম। এবং এই আকীদা আংশিক নয়, পুরোটাই মেনে নিতে হবে। এর একটা অংশও অস্বীকার করা, আর পুরোটা অস্বীকার করা সমান। যে কেউ, যদি এই পুরো আকীদা প্যাকেজটা না নেয়া, বা কিছু বাদ দেয়, কিছুতে দ্বিমত করে; ইসলাম তাকে কনটেইন করে না। স্পষ্ট শব্দে তাকে পরিত্যাগ করে। ইসলামের ভিতরে হিন্দুধর্মের মত বিশ্বাসগত বা ঈমানগত বৈচিত্র্যের সুযোগ নেই। একদম প্রান্তিক ব্যাখ্যা লেভেলে গিয়ে থাকলেও মূল কাণ্ড এক হতেই হবে। নচেৎ জন্মগত মুসলিমকেও ইসলাম সশব্দে ঘোষণা দিয়ে ত্যাজ্য করে। প্রত্যেক আরবি নামধারীই মুসলিম নয়, এমনকি প্রত্যেক নামাযীও মুসলিম নয়!!! যেমন ধরেন, কেউ যদি মনে করে, ইসলাম সত্য নাও হতে পারে। বা আল্লাহ দীন প্রচার হবার যেমন অধিকার আছে, আল্লাহকে অস্বীকার করার ব্যাপারটাও প্রচার হওয়া উচিত। আল্লাহর দীন হিসেবে ইসলাম আলাদা আবার কী? সবাই তো নিজেরটাকে সত্যই বলে থাকে। এমন আকীদাধারী যদি হাজী-নামাযীও হয়। সে আর মুসলিম নেই, কুফরের সীমায় চলে গেছে। নতুন করে তাকে শাহাদাত পাঠ করে ঈমান আনতে হবে।

এই তাত্ত্বিক বিষয়গুলোই টুকটাক পরের পর্বে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। খুব ডীপে না, আলিমগণের ব্যাপারস্যাপার, তাও সব আলিমের কম্মো না। আমি একদম মোটা কথা আলোচনা করব, যেগুলো অধিকাংশই আমরা জানি। বিস্তারিত জানতে আল্লামা কাশ্মিরীর ‘ওরা কাফের কেন’/ ‘ইকফারুল মুলহিদীন’ (একেবারেই একাডেমিক) এবং শাইখ উলওয়ানের ‘ঈমান ভঙ্গের কারণ’ (সীরাত পাবলিকেশন) বইদুটো পড়ে নেবেন। আর বুহুস গ্রপেও সুন্দর আলোচনা চলছে এই বেসিক নিয়ে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

3 × 1 =