অভাবী সংসারে পাঁচ ভাইবোন। পড়াশোনা করার সুযোগ হয়নি। ১১ বছর বয়সে পাশের গ্রামে অন্যের বাড়িতে কাজ শুরু করেন। যে বাড়িতে কাজ করতেন ওই বাড়িতেই থাকা-খাওয়া। ভালো খাবার কখনো কপালে জুটত না। বাড়ির মালিকদের খাবারের অবশিষ্ট খেতে দেয়া হতো। এভাবে একটানা ওই বাড়িতে সাত বছর কাজ করেন। এক সময় ওই বাড়ি থেকে পালিয়ে আসেন নিজ বাড়িতে। এটি নওগাঁ সদর উপজেলার বোয়ালিয়া ইউনিয়নের খাগড়কুড়ি দক্ষিণপাড়া (হাতিপোতা) গ্রামের বাসিন্দা বৃদ্ধ ফজলুল হকের (৬৫) জীবনের গল্প।
দাদা-বাবা তিন পুরুষ কাজ করেই চালিয়েছে সংসার। অন্যের জমিতে ৪০ বছর ধরে বসবাস করছেন। বাঁশের বেড়ায় মাটির প্রলেপ দিয়ে টিনের ছাপড়া ঘরে তাদের বসবাস। ফজলুল হকের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। বড় ছেলে ও মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। তাদের আলাদা সংসার। তাদেরও প্রতিনিয়ত জীবনযুদ্ধে টিকে থাকতে সংগ্রাম করতে হচ্ছে। ছোট ছেলে তার সঙ্গেই থাকেন। সেলুনে কাজ করে। কেউ পড়াশোনা করেনি। শুধু নামটা লিখতে পারে।
গত বর্ষায় ঘরের বেড়ার দেয়াল ধসে যায়। পরে বেড়া ঠিক করে আবারও মাটির প্রলেপ দিয়েছেন। দাদা-বাবা তিন পুরুষ পেরিয়ে গেলেও ভাগ্যের পরিবর্তন করেতে পারেননি ফজলুল হক। অন্যের জমিতে বাড়ি করেই হয়তো জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত থাকতে হবে তাকে।
বৃদ্ধ ফজলুল হক বলেন, কষ্ট সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে বাড়ি আসার পর আরেক গেরস্থের বাড়িতে বছরে ১২ টাকা বেতনে কাজ শুরু করি। সেখানে প্রায় তিন বছর কাজ করা হয়। এরপর ২০ বছর বয়সে বিয়ে করি। বছর চুক্তি হিসেবে কাজ করতে গিয়ে তিন মাসের কাজ বকেয়া থেকে যায়। এরপর নতুন বউকে বাড়িতে রেখেই আবারও তিন মাসের জন্য যেতে হয়। সেই কাজ শেষ করে বাড়ি আসি। স্ত্রীকে নিয়ে কষ্ট করে জীবন চলতে থাকে। তিনবেলা ঠিক মতো খাওয়া হতো না। অভাবের মধ্য দিয়ে দিন পার করেছি।
তিনি বলেন, সকাল ৭টা থেকে বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত ইটের ভাটায় কাজ করছি। যেখানে পারিশ্রমিক পাই ৩০০ টাকা। সেই টাকা দিয়ে চাল ও সবজি কেনা। বলতে গেলে শরীরটাই সম্পদ। কাজ না করলে তো খাওয়া হবে না। এবার বয়স্ক ভাতার কার্ড পেয়েছি।
স্ত্রী আকলিমা দুঃখ করে বলেন, স্বামী জীবনে অনেক কষ্ট করেছে। কিন্তু কোনো উন্নতি করতে পারিনি। এ বয়সেও ইটেরভাটায় কাজ করতে হচ্ছে। অন্যের জমিতে বাড়ি করে আছি। জমির মূল মালিক মারা যাওয়ায় তাদের ছেলেরা জায়গা ছেড়ে দিতে বলছে। কিন্তু যাব কোথায়?
স্থানীয় শাহিন আলম বলেন, দিনমজুরির কাজ করে তাদের সংসার চলে। যখন থেকে বুঝতে শিখেছি তখন থেকেই দেখছি তিনি কঠোর পরিশ্রম করেন। এতো বয়স হয়েছে তারপর তিনি পরিশ্রম করেই চলছেন। কিন্তু জীবনে কোনো উন্নয়ন করতে পারেননি। দিন আনা-দিন খাওয়া অবস্থা তাদের। এলাকাবাসী হিসেবে আমার চাওয়া তারা যেন সচ্ছলভাবে চলতে পারেন এবং নিজস্ব একটা বাসস্থান হয়।
স্থানীয় ৩নং ওয়ার্ডের মেম্বার আজিজুল রহমান বলেন, ফজলুল হক একজন অসহায় ও সহজ সরল প্রকৃতির মানুষ। অন্যের জমিতে বাড়ি করে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বসবাস করছেন। অসচ্ছলতার কারণে তাকে একটি বয়স্ক ভাতার কার্ড করে দেয়া হয়েছে। বয়স্ক মানুষ তারপরও পরিশ্রম করে সংসার চালান। তার নিজস্ব কোনো জায়গা না থাকায় সরকার থেকে বাড়ি করে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।