প্রধানমন্ত্রী বলেছেন স্বল্প সময়ে স্বল্প খরচে বিচার পাওয়া মানুষের অধিকার নিয়ে

0
467

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিচারাধীন মামলাগুলোর দীর্ঘসূত্রতা কমিয়ে দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা গ্রহণে বিচারক ও আইনজীবীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, স্বল্প সময়ে ও স্বল্প খরচে ভোগান্তিমুক্ত বিচার প্রাপ্তি মানুষের অধিকার। গতকাল সকালে ঢাকা জেলার নবনির্মিত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ভবন উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ আহ্বান জানান। তিনি গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। খবর বাসস। আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন এবং প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন। আইন সচিব গোলাম সারোয়ার অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন।


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আদালতের রায় বাংলায় লেখার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এ ক্ষেত্রে তিনি প্রয়োজনে ট্রান্সলেটর নিয়োগ দানের ব্যবস্থা গ্রহণে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং বিচার বিভাগের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, রায় যদি কেউ বাংলায় লিখতে না পারেন, ইংরেজিতে লেখেন কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু সে রায়টা বাংলায় ট্রান্সলেশন করে যেন প্রচার হয়, সে ব্যবস্থাটা করে দিতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের দেশে মামলার রায়গুলো ইংরেজিতে দেওয়া হয়। অনেকে সে রায়টা বুঝতে না পারায় আইনজীবীরা যেভাবে বোঝান সেভাবে তাদের বুঝতে বা জানতে হয়।

তিনি আরও বলেন, দীর্ঘদিন যাবৎ ইংরেজিতে লিখতে লিখতে অনেকে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন, তাই বাংলাতেই রায় লিখতে হবে, এ ধরনের চাপ প্রয়োগ ঠিক নাও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে আমি বলব এগুলো ট্রান্সলেশন করা এমন কোনো কঠিন কাজ নয়, অনেক প্রফেশনাল ট্রান্সলেটর আছেন। তাদেরও আপনারা প্রশিক্ষণ দিয়ে নিতে পারেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রধান বিচারপতিকেও আমি অনুরোধ করব, আইনমন্ত্রীও এখানে আছেন, আপনারা কিছু ব্যবস্থা নিন। জুডিশিয়ালের অনেক কথা, শব্দ, টার্মস যেগুলো আমাদের সাধারণ ক্ষেত্রে ব্যবহার হয় না সেগুলোর অনুবাদ যদি সহজভাবে করা যায়। এ ব্যাপারে যদি কোনো ফান্ড লাগে তারও ব্যবস্থা করব। কিন্তু আমি চাই এটা যেন হয়।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘জুন ২০২০ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন আদালতে ৩৭ লাখ ৯৪ হাজার ৯০৮টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এসব মামলার দীর্ঘসূত্রতা কমিয়ে দ্রুততম সময়ে রায় প্রদানের উপায় বের করার জন্য সব বিচারক এবং আইনজীবীর কাছে আমি অনুরোধ জানাচ্ছি। তিনি বলেন, এত মামলা এভাবে জমে যেন না থাকে, কীভাবে এসব মামলার বিচারকাজ দ্রুত সম্পন্ন করা যায়, অবশ্যই এ ব্যাপারে একটু আন্তরিক হবেন এবং ব্যবস্থা নেবেন। এজন্য যে কোনো ধরনের সহযোগিতা করতেও সরকার প্রস্তুত রয়েছে। কিন্তু এতগুলো মামলা এভাবে পড়ে থাকুক, তা আমরা চাই না।

শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের মানুষ যেন ন্যায়বিচার পায়, বাংলাদেশের মানুষ যেন ভালো থাকে, স্বস্তিতে থাকে, শান্তিতে থাকে, নিরাপদে থাকে এবং উন্নত জীবন পায়। আর এভাবেই যেন আমরা জাতির পিতার স্বপ্নের উন্নত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে পারি, সে লক্ষ্য নিয়েই সরকার কাজ করে যাচ্ছে।

শেখ হাসিনা বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্য, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবার নির্মমভাবে হত্যার মাধ্যমে এ দেশের মানুষের মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠা করা হয় বিচারহীনতার সংস্কৃতি। আমরা এ জঘন্য হত্যাকান্ডের বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করেছি। আওয়ামী লীগ সরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারবদ্ধ উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, এ লক্ষ্যে ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার জন্য সমতার ভিত্তিতে সুবিচার নিশ্চিত করা এবং বিচারব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন করে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আমাদের সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, বিচারকের সংখ্যা বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণ ও এজলাস সংকট নিরসনের পাশাপাশি মামলা ব্যবস্থাপনার দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে। ২০১০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ১১ বছরে অধস্তন আদালতে ১ হাজার ১২৬ জন বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া দরিদ্র-অসহায় ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে সরকারিভাবে আইনি সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে দেশের ৬৪ জেলা সদরে এবং সুপ্রিম কোর্টে লিগ্যাল এইড অফিস স্থাপন করা হয়েছে। বাংলাদেশে একটি স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠায় আওয়ামী লীগ সরকার সব সময়ই আন্তরিক উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, তাঁর সরকার ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর পরই ‘দি কোড অব ক্রিমিন্যাল প্রসিডিউর (সংশোধন) আইন, ২০০৯’ পাসের মাধ্যমে বিচার বিভাগ পৃথক্করণের কাজটিকে স্থায়ী রূপ দিয়েছে।

অধস্তন আদালতের বিচারকদের জন্য পৃথক বেতন স্কেল বাস্তবায়ন, বিচারকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির পাশাপাশি জুডিশিয়াল ভাতা প্রদানসহ বিচার বিভাগের বিভিন্ন উন্নয়নের প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৪২টি জেলায় চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের জন্য ৮-১০ তলা পর্যন্ত ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এরই মধ্যে ২৯টি জেলায় নবনির্মিত আদালত ভবন উদ্বোধন করা হয়েছে। তিনি বলেন, এসব ভবনে স্থাপিত আদালতে এখন উন্নত পরিবেশে বিচারিক কাজ চলছে।

অবশিষ্ট জেলাগুলোতেও চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। সন্ত্রাসবিরোধী মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে সাতটি সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল স্থাপন, সাতটি বিভাগীয় শহরে সাইবার ট্রাইবুন্যাল স্থাপন, নারী ও শিশু নির্যাতন মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ২০১৮ সালে ৪১টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল স্থাপনের পর ২০২০ সালে আরও ছয়টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া সাতটি মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করা হয়েছে উল্লেখ করেন তিনি।

সরকারপ্রধান আরও বলেন, ধর্ষণের মামলায় ধর্ষকদের কঠোর শাস্তি প্রদানের জন্য মৃত্যুদন্ডের বিধান রেখে তাঁর সরকার ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২০’ প্রণয়ন করেছে এবং মাদকসংক্রান্ত মামলাগুলোর দ্রুত বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮ প্রণয়ন করেছে। তিনি বিচারপতি ও আইনজীবীদের কল্যাণ কামনা করে তারা যেভাবে মানুষের পাশে রয়েছেন সেভাবেই তাদের মানুষের পাশে থাকার আহ্বান জানান।

তাঁর সরকার দারিদ্র্যের হার ৪০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে এবং শিক্ষার হার উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের অর্থনৈতিক কার্যক্রম, সামাজিক খাতে নিরাপত্তাবিধান এবং দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ন্যায়বিচার প্রদান অব্যাহত রাখতে ভার্চুয়াল আদালত পরিচালনার জন্য ‘আদালত কর্তৃক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার, আইন, ২০২০’ প্রণয়ন করা হয়েছে। কেরানীগঞ্জের কারাগারে এ ধরনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। দাগী আসামিদের বিচারের ক্ষেত্রে পর্যায়ক্রমে দেশের সব কারাগারেই ভার্চুয়াল কোর্টের ব্যবস্থা রাখতে সরকার পদক্ষেপ নিচ্ছে।

করোনাভাইরাসে সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমসহ দেশ-বিদেশে যারা মারা গেছেন তাদের আত্মার মাগফিরাত ও শান্তি কামনা করেন প্রধানমন্ত্রী।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

5 × 5 =