বিশ্বমহামারী করোনা পরিস্থিতিতেও ঢাকায় থেমে নেই ফুটপাত চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য

0
497

নিজস্ব প্রতিবেদক: বিশ্বমহামারী করোনা পরিস্থিতিতেও ঢাকায় থেমে নেই ফুটপাত চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য। করোনাকালের প্রথম ঢেউ শুরুর পর লকডাউনের আওতায় আনা হয় গোটা রাজধানী। কর্মস্থল বন্ধের আশঙ্কায় বহু হকার সপরিবারে ঢাকা ছাড়েন লকডাউনের আগেই। অনেকে আটকা পড়েন নগরীতে। খেয়ে না খেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়েছে তাদের। একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল যারা গ্রামে ফিরে গিয়েছিলেন, তাদেরও। সরকার লকডাউন তুলে নিলে গ্রাম থেকে আবার ঢাকায় চলে আসেন তাদের অনেকেই। ফুটপাতে পসরা সাজিয়ে বসতে শুরু করেন তারা। রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনভুক্ত বিভিন্ন এলাকার রাস্তা ও ফুটপাতে এখন ক্ষুদ্র ব্যবসা করছেন লক্ষাধিক হকার। দরিদ্র এসব মানুষের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে একশ্রেণির ‘চাঁদাবাজ’ বিভিন্ন সংগঠন ও ইউনিয়নের সাইনবোর্ড ব্যবহার করে রাজধানীর ফুটপাত থেকে প্রতিদিন ২ কোটিরও বেশি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।


এদিকে, রাস্তা ও ফুটপাত দখল করে দোকান বসিয়ে জনচলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে ফুটপাতের হকারদের কাছ থেকে চাঁদাবাজির দায়ে রাজধানীর ৭টি অনিবন্ধিত সংগঠন ও ইউনিয়নকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন আদালত। এগুলোর কার্যক্রম বন্ধ এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অনিবন্ধিত সংগঠন ও ইউনিয়নগুলো হলো- বাংলাদেশ হকার্স ইউনিয়ন (আহ্বায়ক আবুল হাসেম কবির); ছিন্নমূল হকার্স সমিতি (সভাপতি কামাল ছিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক এমরান হোসেন); হকার্স সংগ্রাম পরিষদ (আহ্বায়ক আবুল হোসাইন); আওয়ামী হকার্স লীগ (সভাপতি জাকারিয়া হানিফ, সাধারণ সম্পাদক জাহিদ আলী); ইসলামী হকার্স শ্রমিক আন্দোলন (আহ্বায়ক আবুল কালাম জুয়েল ও যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুল মান্নান); আওয়ামী হকার্স লীগ (আহ্বায়ক লিয়াকত হোসেন ও যুগ্ম আহ্বায়ক মোয়াজ্জেম হোসেন), হকার্স সমন্বয় পরিষদ (আহ্বায়ক আবুল হোসাইন)।


এ সংক্রান্ত মামলায় ঢাকা বিভাগের ৪নং রাজউক অ্যাভিনিউয়ের যুগ্ম শ্রম পরিচালককেও আসামি করা হয়েছে। ২০১৭ সালের ২৩ মার্চ ঢাকার দ্বিতীয় শ্রম আদালতে (জেলা ও দায়রা জজ) বাংলাদেশ হকার্স লীগের সভাপতি এমএ কাশেম ও সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর জমাদার (ঠিকানা : পল্টনের ২৫ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ) কর্তৃক এক মামলার পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৫ অক্টোবর ওই আদেশ দেন ঢাকার দ্বিতীয় শ্রম আদালতের চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল ইমাম।বাদী আদালতের রায়ের নকল কপি হাতে পান গত ৪ নভেম্বর। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ফুটপাতে চাঁদাবাজির অভিযোগে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ৭২ জনকে আসামি করে রাজধানীর ৩ থানায় তিনটি মামলা করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সহকারী সম্পত্তি কর্মকর্তা মুহাম্মদ সামসুল আলম। মতিঝিল থানায় ১৬ জন, পল্টন থানায় ৪৯ জন এবং শাহবাগ থানায় ৭ জনকে আসামি করে এ তিন মামলা হয়।


জানা গেছে, সম্প্রতি পল্টনের যে ৭টি সংগঠন ও ইউনিয়নকে অবৈধ ঘোষণা করে এগুলোর কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত, সেগুলোর বেশির ভাগ নেতাকর্মীই এই ৩ মামলায় আসামি। বাংলাদেশ হকার্স লীগের সভাপতি আদালতে করা মামলায় উল্লেখ করেন- বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬-এর ১৯২ ধারার বিধানমতে রেজিস্ট্রিকরণ ব্যতীত কোনো ট্রেড ইউনিয়নের কাজ চালানো বেআইনি। কিন্তু আদালত কর্তৃক অবৈধ ঘোষিত ওই ৭ সংগঠন ও ইউনিয়নের রেজিস্ট্রেশন না থাকা সত্ত্বেও ট্রেড ইউনিয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

অনিবন্ধিত ইউনিয়ন নামধারী এসব সংগঠন ফুটপাতে চাঁদাবাজি করছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর নেতাকর্মীরা নিজেদের হকার নাম দিয়ে যেন চাঁদাবাজি, দখলবাজি, মিছিল মিটিং করতে না পারে এবং তাদের অবৈধ কার্যক্রম পরিচালনা করতে না পারে- সে লক্ষ্যে আদালতের দ্বারস্থ হন হকার সংগঠনের ওই নেতা।মামলার বাদী বাংলাদেশ হকার্স লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি এমএ কাশেম জানান, করোনাকালের আগে রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের ফুটপাতে দেড় লাখেরও বেশি হকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ব্যবসা চালিয়ে আসছিলেন।

সরকারি নিবন্ধন ছাড়াই কয়েকটি সংগঠন রাজধানীর থানা, ওয়ার্ডে কমিটি দিয়ে সেই কমিটির নেতাকর্মীদের দিয়ে এসব হকারকে জিম্মি করে তাদের কাছ থেকে দৈনিক ১০০ থেকে ৩০০ টাকা চাঁদা আদায় করে আসছিল। এ চাঁদাবাজির নেতিবাচক প্রভাব পড়ছিল নিবন্ধিত বৈধ হকার সংগঠনগুলোর ওপর। বিষয়টি প্রশাসনকে জানানো হলেও কাজ হয়নি। ফলে আদালতে যান তিনি।
এমএ কাশেম বলেন, সরকার লকডাউন উঠিয়ে নেওয়ার পর বর্তমানে লক্ষাধিক হকার রাজধানীতে ব্যবসা করছেন। করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও অবৈধ ওই সংগঠনগুলো তাদের চাঁদাবাজি বন্ধ করেনি। আদালতের নির্দেশ সত্ত্বে¡ও ওই সংগঠনগুলো হকারদের কাছ থেকে দোকানপ্রতি দৈনিক ১০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করছে। সেই হিসাবে দৈনিক ফুটপাত থেকেই তারা তুলে নিচ্ছে দুই কোটির বেশি টাকা।


ডিএসসিসির সহকারী সম্পত্তি কর্মকর্তা সামসুল আলম তার মামলাগুলোয় উল্লেখ করেন, রাস্তা ও ফুটপাত দখল করে দোকান বসিয়ে সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত জনচলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন ব্যবসায়ীরা (হকার)। এসব ব্যবসায়ীর কাছ থেকে আসামিরা প্রতিদিন ১০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করেন। ডিএসসিসির পক্ষ থেকে এসব চাঁদাবাজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন।এখনো এ চাঁদাবাজচক্র ডিএসসিসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নানাভাবে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে।
মতিঝিল থানায় দায়ের মামলার আসামিরা হলেন- সাইফুল ইসলাম, শিবলু, শাহজাহান মৃধা, মকবুল, নূরুল ইসলাম, বাবলু, তাজুল ইসলাম, সাদেক, আবদুর রহিম, পবন, সাইজুদ্দিন, আবুল কালাম জুয়েল, আজাদ, কালা কাশেম, ফারুক ও সহিদ রেজা বাচ্চু। শাহবাগ থানার মামলার আসামিরা হলেন- লম্বু শাহজাহান, বাবুল, মানিক, ইমরান, দুলন, শাহীন ও আইয়ুব।

আর পল্টন থানা মামলার আসামিরা হলেন- লম্বা হারুন, দেলু, নাসির, মিন্টু, আলী মিয়া, আবদুল গফুর, কাদের, খলিল, কোটন মিয়া, জাহাঙ্গীর, নসু, সাজু, রহিম, নুরু, জাহাঙ্গীর, আবুল হাসেম কবির, আবদুল ওয়াদুদ, সরদার বাবুল, বুড়া সালাম, জুয়াড়ি সালাম, আক্তার, জাহাঙ্গীর, কালা নবি, আবদুর রব, কামাল, নজরুল, মনির, শফিক, হাসান, সোর্স শহীদ, বড় মিয়া, কালাম, বিমল বাবু, শওকত, হাবিব, ভোলা, কানা সিরাজ, আবদুল হান্নান, আলমগীর, সেকান্দার হায়াত, মুরসিকুল ইসলাম শিমুল, শফিকুর রহমান বাবুল, মঞ্জুর ময়িন, আবুল হোসাইন, আরিফ চৌধুরী, খোকন মজুমদার, খায়রুল বাশার, রফিকুল ইসলাম, সাত্তার মোল্লা ও আবুল হাসেম। আসামিরা এখনো চাঁদাবাজি অব্যাহত রেখেছেন বলেও জানান বাংলাদেশ হকার্স লীগের সভাপতি এমএ কাশেম।


ঢাকা মহানগরে যানজট-শাসনব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়- ঢাকায় যানজট সৃষ্টির অন্যতম প্রধান কারণ ফুটপাত দখল করে হকারদের মার্কেট করা। ঢাকায় সাধারণ রাস্তা যেখানে ২০০ কিলোমিটার সেখানে সরু রাস্তা ২ হাজার ৬৪০ কিলোমিটার। দুই লেনের ২ হাজার ২১৫ কিলোমিটার রাস্তায় মাত্র ৪৩০ কিলোমিটার হাঁটা-চলার রাস্তা রয়েছে। এরও ৮৩.১ শতাংশ দখল হয়ে আছে।এই হাঁটা-চলার রাস্তার বেশির ভাগ হকাররা দখল করে রাখছে। ফুটপাতে প্রতি বর্গফুটের মাসিকভাড়া দিচ্ছে ১ হাজার ৮১২ টাকা। আর হকারদের কাছ থেকে বছরে আদায়কৃত অর্থের পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা। যা ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মোট বাজেটের কাছাকাছি। মাসিক হারে চাঁদা দেওয়ার পাশাপাশি প্রতিদিন আলাদাভাবেও চাঁদা দেন হকাররা।


বিআইডিজির গবেষণা ফেলো শাহনেওয়াজ হোসেন বলেন, ঢাকায় হাঁটার পথের বড় অংশ হকাররা দখল করে আছে। ফুটপাতে পার্কিং, যত্রতত্র দোকানের ব্যবস্থা করে ফুটপাত দখল- এটা কিন্তু যানজটের একটা বড় কারণ। ঢাকায় হকারদের মাসিকভিত্তিক ও প্রতিদিন এই দুই আকারে টাকা সংগ্রহ করে থাকে। আর এ টাকা স্থানীয় নেতা ও প্রশাসনের হাতে যায়। এ টাকা উত্তোলনের কাজে একজন লাইন্সম্যান নিয়োজিত থাকে। ফুটপাতে বসা আড়াই লাখের মতো হকারকে যদি সুনির্দিষ্ট একটা ব্যবস্থার মধ্যে আনা যায়, তা হলে মাসিক পাঁচ কোটি টাকা তোলা যাবে এবং এই টাকা ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার বা যানজট নিরসনে ব্যবহার করা যাবে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

ten + eighteen =