সাউথ-বাংলা ব্যাংকের চেয়ারম্যান আমজাদের দুর্নীতি

0
500

এসএম আমজাদ হোসেন। খুলনা অঞ্চলের লকপুর গ্রুপের কর্ণধার ও সাউথ-বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স (এসবিএসি) ব্যাংকের চেয়ারম্যান। আগে থেকেই শিল্প প্রতিষ্ঠার নামে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়েছেন বিভিন্ন ব্যাংক থেকে। ঋণের নামে নেওয়া আত্মসাৎ করা টাকার অংশ থেকে হয়েছেন এসবিএসি ব্যাংকের বড় অংশীদার। ব্যাংকের চেয়ারম্যান হওয়ার পর নিজেই ঋণ হাতিয়ে নেওয়ার নানা ফন্দি বের করেন।

ভাই-ভাতিজা, ভাতিজির মালিকানা দেখিয়ে ব্যাংক থেকে নিয়েছেন বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ। অনুসন্ধানে সাউথ-বাংলা ব্যাংক থেকে ২৭৩ কোটি টাকা এবং দেশের আরও তিনটি ব্যাংক থেকে ৫৬৪ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার তথ্য জানা গেছে। এই ঋণের বড় অংশই খেলাপি। অভিযোগ রয়েছে, ঋণের একটি অংশ আমেরিকা ও ভারতে পাচার করেছেন।

২০১২ সালে রাজনৈতিক বিবেচনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে ৯ ব্যাংকের অনুমোদন দেয়, তার একটি সাউথ-বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক। এই ব্যাংকের মূল উদ্যোক্তা খুলনা অঞ্চলের অন্যতম শিল্প প্রতিষ্ঠান লকপুর গ্রুপের এসএম আমজাদ হোসেন। প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই তিনি চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। একাধিক অনুসন্ধানে জানা গেছে, চেয়ারম্যান পদে থেকেই তিনি ব্যাংকের ঋণ আত্মসাতে ও অন্যান্য অনিয়মে সরাসরি জড়িয়ে পড়েন। তার অনিয়মের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে অভিযোগও করেছেন একাধিক উদ্যোক্তা ও পরিচালক।

সাউথ-বাংলা ব্যাংকের সবচেয়ে বড় অনিয়ম হচ্ছে- আলফা এক্সেসরিজ অ্যান্ড এগ্রো এক্সপোর্ট কোম্পানির নামে নেওয়া ঋণ। ওই কোম্পানির কাছে ব্যাংকটির বর্তমান পাওনা ২১৭ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে গঠিত ওই কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরজান আলী ও পরিচালক মাহফুজা খানম রিশার নামে যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের কার্যালয় (আরজেএসসি) থেকে নিবন্ধন নেওয়া। আরজান আলীর সঠিক পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি, তবে মাহফুজা খানম রিশা আমজাদ হোসেনের মৃত ভাই ফরহাদ হোসেনের মেয়ে। এ ছাড়া পরিচালক হিসেবে পরিচয় দিয়ে কোম্পানি দেখাশোনা করেন মাহফুজা খানমের ভাই তৈয়মুর ইসলাম রাসেল। সাউথ-বাংলা ব্যাংকের বাগেরহাটের কাটাখালী শাখার মাধ্যমে ২০১৬ সালে সর্বপ্রথম ৪৮ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়, পর্যায়ক্রমে এই ঋণ বাড়ানো হয়েছে।

কিন্তু এরা চেয়ারম্যানের আত্মীস্বজন হলেও ঋণ প্রস্তাবে তা উল্লেখ করা হয়নি। তথ্য গোপন করে ঋণ নিয়ে পরে লকপুর গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ওই টাকা স্থানান্তর করা হয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে প্রমাণিত হয়। কিন্তু অজানা কারণে ঋণ জালিয়াতির তথ্য উদ্ঘাটন করেও ব্যবস্থা নেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর পর দফায় দফায় ঋণ বাড়ানো হয়েছে। এমনকি খেলাপি হয়ে যাওয়ার পর দুই দফায় পুনঃতফসিল করা হয়েছে। পুনঃতফসিল সুবিধা দেওয়ার সময় সাড়ে ১৩ শতাংশ সুদে বিতরণ করা ঋণের সুদ এখন ৯ শতাংশ। আলফার নামে ৫টি পৃথক ঋণে ১১৭ কোটি ফান্ডেড, আর ১০০ কোটি টাকা নন-ফান্ডেড।

স্থানীয় ও বিদেশি ঋণপত্রের (এলসি) জন্য নেওয়া হয়েছে ১০০ কোটি টাকা, এলটিআর হিসেবে ৮ কোটি, সিসি হাইপো হিসেবে ২৫ কোটি, মেয়াদি ঋণ হিসেবে ৮২ কোটি ৪ লাখ এবং লিজ ফাইন্যান্স হিসেবে নেওয়া হয়েছে ২ কোটি টাকা। এসব ঋণের জামানত ফকিরহাটের ৩২০ শতাংশ জমি ও আলফার কারখানার বিল্ডিং। যার মূল্য দেখানো হয়েছে ৯০ কোটি টাকা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই ঋণ সম্পর্কে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- ঋণের প্রকৃত সুবিধাভোগী এসএম আমজাদ হোসেনকে আড়াল করতেই আলফার মালিকদের প্রকৃত পরিচয় গোপন করা হয়েছে। এটি আসলে পৃথক কোনো কারখানা নয়।

সাউথ-বাংলার খুলনা করপোরেট শাখায় সহযোগী প্রষ্ঠিানগুলোর নামে এলসি খুলে কাটাখালী শাখা থেকে কৌশলে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন। আগের দিন এলসি মার্জিনের টাকা জমা দিয়ে পর দিন আবার তা চেয়ারম্যানের অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা হয়েছে। এর বাইরে খুলনা বিল্ডার্সের নামে ২০ কোটি ২৬ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন। এই ঋণের বিপরীতে কোনো জামানত নেই। নিজের স্ত্রী বেগম সুফিয়া আমজাদের ব্যক্তিগত গ্যারান্টিতে এই ঋণ দেওয়া হয়েছে। নিজের একজন কর্মচারীর নামে খুলনা করপোরেট শাখা থেকে নিয়েছেন ৩৬ কোটি টাকা।

অফিসে গিয়েও আরজান আলীর খোঁজ জানা যায়নি। গতকাল শনিবার আরজান আলীর মোবাইলে কল দিলে তিনি একটি ‘ফাংশনে’ ব্যস্ত আছেন বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। পরে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি আর রিসিভ করেননি।

বাগেরহাটের ফকিরহাটে কারখানাস্থল সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে লকপুর গ্রুপের কারখানাগুলো এবং আলফা এক্সেসরিজের কারখানা একই জমিতে অবস্থিত। স্থানীয়রাও সবগুলোকেই লকপুর গ্রুপের কারখানা বলে জানেন। খুলনা থেকে ১০-১২ কিলোমিটার দূরত্বে কাটাখালী। আর কাটাখালী মোড় থেকে মোংলার দিকে সামান্য সামনে যেতেই হাতের বামে সাউথ-বাংলা ব্যাংকের কাটাখালী শাখা, যা লকপুর গ্রুপের জায়গায় অবস্থিত। ব্যাংক শাখার পাশেই লকপুর গ্রুপের প্রধান কার্যালয়, তবে সেখানে কোনো সাইনবোর্ড নেই। এর পাশেই বাংলাদেশ পলিমার প্রিন্টিং প্রেস ও মুন স্টার পলিমার। এর পেছনে মুন স্টার সিরাসিক্সের কারখানা। এর পাশে দেয়াল তুলে গড়ে তোলা হয়েছে আলফা এক্সেসরিজ অ্যান্ড এগ্রো এক্সপোর্ট। এর মধ্যে চারটি প্রতিষ্ঠান- স্ন্যাকস, সবজি প্রক্রিয়াকরণ, মাছ ও চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ এবং প্যাকেজিং ইউনিট। আরও সামান্য দূরত্বে গড়ে তোলা হয়েছে মেট্রো ব্রিকস নামে অটো ইটভাটা। আলফার সিনিয়র কর্মচারীরা নিজেদের লকপুর গ্রুপের হিসেবে পরিচয় দেন। লকপুর গ্রুপের পরিচালক তৈয়মুর ইসলাম রাসেল (এসএম আমজাদের ভাতিজা) নিজেকে আলফা এক্সেসরিজের পরিচালক পরিচয় দেন। তিনি বলেন, আলফার সঙ্গে অন্যগুলোর সম্পর্ক নেই।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অল্প বয়সে এসএম আমজাদ হোসেন আমেরিকা পাড়ি দেন। এর পর দেশে নানা শিল্প গড়ে তোলেন। এসব শিল্প দেখাশোনা করেন তার অপর ভাই এবং তাদের ছেলে মেয়েরা। তার ভাই আবুল হোসেন স্থানীয় লকপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান।

নিজের ব্যাংক প্রতিষ্ঠার আগে দেশের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নেন এসএম আমজাদ হোসেন। এসব ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। মুন স্টার জুট মিলসের নামে ইসলামী ব্যাংক থেকে ১২৯ কোটি, সোনালী ব্যাংক থেকে শম্পা আইস অ্যান্ড কোল্ডস্টোরেজ ৯ কোটি ৭৩ লাখ, বাগেরহাট সি ফুডের নামে ২২ কোটি ২৬ লাখ এবং লকপুর ফিশ প্রসেসিংয়ের নামে ১৯ কোটি ৩২ লাখ টাকা। সবচেয়ে বেশি ঋণ রয়েছে জনতা ব্যাংকের ৩৮৪ কোটি টাকা। এই তিন ব্যাংকে ঋণের পরিমাণ ৫৬৪ কোটি টাকায় খেলাপি ঋণ। তবে সম্প্রতি সেই খেলাপি ঋণ বিশেষ ছাড়ে পুনঃতফসিলের চেষ্টা চলছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, সাউথ-বাংলা ব্যাংকের চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেনের ঋণসংক্রান্ত অভিযোগ তদন্ত করা হবে। যদি ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়, অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৪ সালে সোনালী ব্যাংক থেকে বাগেরহাট সি ফুডের নামে নেন ৩৩ কোটি ৯৯ লাখ ১০ হাজার টাকা। ২০১৭ সালের জুনের পর থেকে কিস্তি দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। বর্তমানে পাওনা ২২ কোটি ২৫ লাখ ৮১ হাজার টাকা মন্দমানের খেলাপি ঋণ। এই কোম্পানির এমডি এসএম আমজাদ হোসেন এবং পরিচালক তার স্ত্রী সুফিয়া আমজাদ। স্বামী ও স্ত্রীর নামে প্রতিষ্ঠিত আরেকটি কোম্পানি শম্পা আইস অ্যান্ড কোল্ডস্টোরেজ। ২০১৪ সালের জুনে সোনালী ব্যাংক থেকে নেন ১৪ কোটি ৯৪ লাখ ৪১ হাজার টাকা। ২০১৭ সালের জুনের পর আর কোনো কিস্তি দেননি। বর্তমানে পাওনা ৯ কোটি ৭৩ লাখ ৪২ হাজার টাকার পুরোটাই খেলাপি। সোনালী ব্যাংক থেকে লকপুর ফিশ প্রসেসিংয়ের নামে নিয়েছেন আরও ১৯ কোটি ৩২ লাখ টাকা।

নিজে চেয়ারমান ভাই আবুল হোসেন ও স্ত্রী সুফিয়া আমজাদকে পরিচালক দেখিয়ে গঠন করা হয়েছে মুন স্টার জুট মিল। ২০১৮ সালের বিভিন্ন সময়ে নেওয়া ঋণের পরিমাণ ১৪১ কোটি ৪৪ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ১২৯ কোটি ৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এই কোম্পানির নামে ২৬টি ঋণ অনুমোদন করে ইসলামী ব্যাংক। ২৩ বার ঋণ বিতরণ করা হয়। জামানতবিহীন এসব ঋণ পরে খেলাপি হয়ে যায়। প্রায় প্রতিটি ঋণ ১ থেকে ২ বার পর্যন্ত পুনঃতফসিল করার পরও আবার খেলাপি হয়ে গেছে।

ইস্টার্ন পলিমার ও মুন স্টার পলিমারের নামে জনতা ব্যাংকের খুলনা করপোরেট শাখায় ৩২৭ কোটি এবং মতিঝিল করপোরেট শাখায় রয়েছে ৫৭ কোটি টাকার ঋণ। বর্তমানে দুটি কারখানাই বন্ধ রয়েছে। ঋণের টাকা ফেরত না দেওয়ায় ওই ঋণ খেলাপি হয়ে যায়। জনতা ব্যাংকের বোর্ডসভায় ইতোমধ্যে ৩২৭ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল অনুমোদন করা হয়েছে। তা চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠানো হয়েছে।

এদিকে অনুসন্ধানে কোনো দালিলিক প্রমাণ পাওয়া না গেলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে, আমেরিকায় আমজাদ হোসেন কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, দুটি বাড়ি এবং ভারতে দুটি শিল্প কারখানা স্থাপন করেছেন। অবৈধভাবে এসব টাকা বিদেশে নিয়ে গেছেন। কলকাতায় একটি প্রতিষ্ঠানের নাম রূপসা ফিশ প্রাইভেট লিমিটেড। তার বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগের মধ্যে গত মাসে তিনি আমেরিকায় চলে গেছেন বলে জানা গেছে। ব্যাংক সূত্রও তার বিদেশ গমনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। বিদেশে থাকায় তার বক্তব্য জানা যায়নি। তবে লকপুর গ্রুপের সিনিয়র নির্বাহী পরিচালক কাওসার পারভেজের সঙ্গে কথা হয় আলফা এক্সেসরিজের কারখানায় বসে। তিনি বলেন, আলফা এক্সেসরিজ অত্যাধুনিক ভারী মেশিন দিয়ে তৈরি কম্পোজিট কারখানা। এখানে চারটি ইউনিটের মধ্যে তিনটি ইউনিটের উৎপাদিত শতভাগ পণ্য বিদেশে রপ্তানি করা হয়। তবে আলফা এক্সেসরিজের কারখানাকে সরাসরি লকপুর গ্রুপের কারখানা বলা যাবে না বলে জানান তিনি।

১৯৮৬ সালে লকপুর গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন এসএম আমজাদ হোসেন। তার কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প-রূপসা ফিশ, বাগেরহাট সি ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ, লকপুর ফিশ প্রসেসিং, শম্পা আইস অ্যান্ড কোল্ডস্টোরেজ, প্রিন্টিং প্যাকেজিং কোম্পানি খুলনা প্রিন্টি অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড, বাংলাদেশ পলি প্রিন্টিং ইন্টারন্যাশনাল, ইস্টার্ন পলিমার, আইডিয়াল পলিমার, মুন স্টার পলিমার, মুন স্টার জুট মিল, মুন স্টার সিরামিক, মুন স্টার অ্যাগ্রো এক্সপোর্ট, মুন স্টার ফ্যাশন, মেট্রো ব্রিকস, খুলনা বিল্ডার্স, ইন্টারন্যাশনাল কোর ফ্যাক্টরি, ওশান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, লকপুর শিপিং এজেন্সি, ওয়েস্টার্ন ইনন ইন্টারন্যাশনাল হোটেল।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

five × 3 =