আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক অস্তিত্ব সংকটে

0
658

আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকে মারাত্মক রূপ নিচ্ছে অস্তিত্ব সংকটের নানা উপসর্গ। অনিয়ম দুর্নীতির দায়ে বদল হচ্ছে মালিকানা। আস্থা সংকটের কারণে একাধিকবার পাল্টাতে হয়েছে ব্যাংকটির নাম। তবুও কোনো সুখবর মিলছে না বেসরকারি খাতের এ ব্যাংকটিতে। তলানিতে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য। শূন্যের কোঠায় ঋণের জন্য গ্যারান্টার। বেড়েই চলছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। দায় বেড়ে সম্পদের চেয়ে দ্বিগুণ। কোম্পানিটি পড়েছে বিপুল অঙ্কের মূলধন ঘাটতির কবলে। শেয়ারপ্রতি আয়ের জায়গায় লোকসান যেমন বেড়েছে, তেমনি নিট সম্পদমূল্যও কমেছে। বছরের পর বছর কোনো লভ্যাংশ বিতরণ দূরের কথা নিজেদের সঞ্চয় নিয়ে শঙ্কিত বিনিয়োগকারীরা। সব মিলিয়ে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক।

আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিগত কয়েক বছরের মতো এ বছরও ব্যাংকটি কোনো লভ্যাংশ দিতে পারেনি। ক্রমেই কমছে মোট সম্পদের পরিমাণ। ২০১৭ সালে ব্যাংকটির মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ১৭৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা, ২০১৮ সালে ১ হাজার ১৪২ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। গেল বছর তা আরও কমে ১ হাজার ১২৪ কোটি ১ লাখ টাকা হয়েছে। ২০১৭ সালে ব্যাংকটির মোট দায় ছিল ২ হাজার ২২৩ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। ২০১৮ সালে তা বেড়ে ২ হাজার ২৩৮ কোটি ৩ লাখ টাকায় দাঁড়ায়। ২০১৯ সালে এই দায় আরও বেড়ে ২ হাজার ২৬১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা হয়। অর্থাৎ ১ বছরের ব্যবধানে ব্যাংকটির দায় বেড়েছে ২৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা। আমদানি রফতানির করুণ অবস্থা। গেল বছর ব্যাংকটির মাধ্যমে আমদানি হয়েছে ৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। রফতানি বাণিজ্য মাত্র ৮৩ লাখ টাকা। কোনো গ্যারান্টার ব্যাংকটিতে ঋণের জন্য গ্যারান্টি দিতে আসেনি। চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত ব্যাংকটির ৮৪২ কোটি ঋণের মধ্যে ৮০.৮২ শতাংশ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। এজন্য ১ হাজার ৬২২ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতির কবলে এই ব্যাংক।

এ সম্পর্কে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ শফিক বিন আব্দুল্লাহ বলেন, ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের কাছ থেকে মালিকানা গ্রহণের পর থেকে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক বিভিন্ন কিস্তিতে ১১শ কোটি টাকা দেনা পরিশোধ করেছে। এই বিপুল অঙ্কের দেনা পরিশোধ করতে গিয়ে ব্যাংকটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে। তাই লভ্যাংশ দিতে পারছে না। এটা আমাদের জন্য অস্বস্তিকর।

সর্বশেষ হিসাব বছরে কোম্পানির শেয়ারপ্রতি লোকসান (ইপিএস) হয়েছে ৬৪ পয়সা। আগের বছরের একই সময়ে লোকসান ছিল ৭৩ পয়সা। চলতি বছরের প্রথম ও ২য় প্রান্তিকের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কোম্পানির শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ৯ পয়সা ও ২৩ পয়সা। অর্থাৎ বছরের ৬ মাসে কোম্পাটির লোকসান ৩২ পয়সা, যা আগের বছর এই সময়ে ছিল ২৯ পয়সা। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির শেয়ারপ্রতি সম্পদ মূল্য (এনএভিপিএস) ঋণাত্মক ১৭ টাকা ১১ পয়সা। চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত এ এনএভিপিএস ঋণাত্মক ১৭ টাকা ৪৩ পয়সা। অর্থাৎ ৬ মাসে শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য আরও ৩২ পয়সা কমেছে।

আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ব্যাংকটি বছরের পর লোকসান গুনলেও তাদের কর্মচারীর সংখ্যা বাড়ছে। ২০১৭ সালে ব্যাংকটির কর্মচারী ছিল ৪৭৬ জন, ২০১৮ সালে ৪৮৫ জন। ২০১৯ সালে কর্মচারীর সংখ্যা আরো বেড়ে দাঁড়ায় ৪৯৭ জন। চলতি বছর আরো ৩৩ জন নিরাপত্তা প্রহরীর নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেয় কোম্পানিটি। এদিকে ব্যয় সাশ্রয়ে অধস্তনদের বেতন-ভাতা কমলেও বেড়েছে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের। ২০১৮ সালে কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতা বাবদ খরচ হয় ১৯ কোটি ২৪ লাখ টাকা আর ২০১৯ তা কমে ১৭ কোটি ৯৯ লাখ টাকা হয়। অর্থাৎ ১ বছরের এ বেতন-ভাতার পরিমাণ কমানো হয় ২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। অথচ কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ২০১৮ সালে বেতন-ভাতা বাবদ ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা পেলেও পরের বছর তিনি উত্তোলন করেন ১ কোটি ৪২ লাখ টাকা। অর্থাৎ তার আর্থিক সুবিধা ২ লাখ টাকা বেড়েছে।

সৌদিপ্রবাসী শিল্পপতি আমানুল্লাহ মিয়া ও বাংলাদেশের শিল্পপতি আবুল খায়ের লিটুর মালিকানায় ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশে আল-বারাকা ব্যাংক কার্যক্রম শুরু করে। আমানুল্লাহ মিয়ার মৃত্যুর পর তার ছেলে তাদের শেয়ার বিক্রি করে দেয় হংকংভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে। এরপর বিধিলঙ্ঘন করে ব্যাংকটির সিংহভাগ শেয়ার কিনে ওরিয়ন গ্রুপ। ২০০৩ সালে ব্যাংকটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ওরিয়েন্টাল ব্যাংক। গ্রাহকের টাকা তসরুপের অভিযোগে ২০০৬ সালের ১৯ জুন ব্যাংকটিতে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রশাসক নিয়োগ দেয়। সে সময় এ ব্যাংকে ৭০০ কোটি টাকা তসরুপের অভিযোগ ওঠে ওরিয়ন শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। ২০০৭ সালের ২৩ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক ওরিয়ন ব্যাংকের ব্যবসায়িক কার্যক্রম স্থগিত করে এবং পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয় স্কিম তৈরি করে। তখন আইসিবি ফিন্যান্সিয়াল গ্রুপ ব্যাংকটির প্রায় ৫১ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয় ৩৫১ কোটি টাকায়। আইসিবি গ্রুপ ব্যাংকটির নাম পরিবর্তন করে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক নামকরণ করে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

1 + 6 =